ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

কৃষি

টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত রোগমুক্ত কলার চারায় বাজিমাত

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮০৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০২৩
টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত রোগমুক্ত কলার চারায় বাজিমাত

রাজশাহী: কলা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় একটি ফল। এটি যেমন পুষ্টিকর, তেমনই সুস্বাদু।

নানা পুষ্টিগুণে ভরা এ ফলটি অন্যান্য ফলের তুলনায় সস্তা এবং সহজলভ্য। প্রায় সারা বছরই পাওয়া যায় এই পুষ্টিকর ফল। তাই সব শ্রেণী-পেশার মানুষের কাছেই সব সময়ের জন্যই কলা বেশ প্রিয়।

খনার বচনে আছে, ‘কলা রুয়ে না কেটো পাত, তাতেই কাপড়, তাতেই ভাত’। অর্থাৎ কলার গাছ লাগানোর পর তার পাতা কাটা যাবে না। তাহলে কলার ফসল ভালো হবে। আর সেই কলা বিক্রি করে অধিক মুনাফা পাওয়া যাবে। কিন্তু দেশের সব স্থানে কলার চাষ হলেও ইদানীং ছত্রাকজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে দ্রুতই মারা যাচ্ছে এই গাছ। এছাড়াও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ায় কলার ফলন দিন দিন যেন কমে যাচ্ছে। এতে খুব বেশি লাভও করতে পারছেন না চাষিরা। তবে এই রোগ থেকে পরিত্রাণের পাশাপাশি তুলনামূলক কম সময়ে অধিক ফলনসমৃদ্ধ উন্নত জাতের কলার চারা উদ্ভাবন হয়েছে এরই মধ্যে।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কলা চাষ ব্যবস্থাপনা যখন এমন সংকটময়, তখন নতুন তিন ধরনের উন্নত কলার জাতের উদ্ভাবন করে সাড়া ফেলে দিয়েছেন এক গবেষক। তিনি হচ্ছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন। দীর্ঘ পাঁচ বছরে থেকে গবেষণা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।  

গবেষণায় ফুল থেকে টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত এই কলার খবর এরই মধ্যে দেশ জুড়ে সারা ফেলে দিয়েছে। আর কেবল এই রোগমুক্ত কলার চারাই নয়, এছাড়াও এখন তিনি সৌদি আরবের খেজুরের চারা নিয়েও গবেষণা শুরু করছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিভাগে গেলেই তার নতুন গবেষণালব্ধ রোগমুক্ত কলার চারা, গাছ ও ফলনের দেখা মিলবে।

ফুল থেকে টিস্যু কালচার পদ্ধতি ব্যবহার করে রোগমুক্ত এবং তুলনামূলক কম সময়ে অধিক ফলনসমৃদ্ধ এসব জাতের উদ্ভাবন করেছেন। বিভাগের প্ল্যান্ট মলিকুলার বায়োটেকনোলজি ল্যাবে এই উন্নত জাতের উদ্ভাবন করা হয়েছে। দীর্ঘ পাঁচ বছরেরও বেশি সময়ের গবেষণায় এই সফলতা পেয়েছেন বলেও জানিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষক আনোয়ার হোসেন।

ওই অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বাংলানিউজকে জানান, কলার স্যুট টিপ বা ফুলের টিস্যু প্রথমে জীবাণুমুক্ত করা হয়। এরপর ল্যাবের মধ্যে সেই টিস্যুকে কাচের পাত্রে নির্দিষ্ট তাপমাত্রা ও নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে নেওয়া হয়। সেখানে উদ্ভিদের বিভিন্ন ধরনের হরমোন ও প্রয়োজনীয় কৃত্রিম খাবার ব্যবহার করে ৫ থেকে ৬ মাস ধরে তৈরি করা হয় মাইক্রোস্যুট।

পরে এই মাইক্রোস্যুটগুলোতে হরমোন ব্যবহার করে তৈরি করা হয় শিকড়। এরপর ল্যাব থেকে বের করে বিশেষায়িত পলিনেট হাউজের ভেতর নিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে সেই চারা পর্যায়ক্রমে বাইরের আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়ানো হয়। একপর্যায়ে মাঠে রোপণের উপযুক্ত হলে চারাগুলো হস্তান্তর করা হয় কৃষকদের কাছে।  

উৎপাদনের দিক থেকে খাদ্য শস্যের মধ্যে বিশ্বেকলার অবস্থান চতুর্থ। অনেক দেশ শীতপ্রধান দেশগুলোতে কলা রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। বাংলাদেশের কৃষকরা সনাতন পদ্ধতিতে কলার চাষ করায় বিদেশে রপ্তানিযোগ্য কলা উৎপাদন করতে পারে না, এমনটাই দাবি করেন অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের।  

তিনি বলেন, টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল এই কলার চারা বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা গেলেই কেবল দেশের চাহিদা পূরণের পর তা বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব। আর অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের উদ্ভাবিত জাতের কলা অধিক পুষ্টিগুণসম্পন্ন, উচ্চ ফলনশীল ও কম সময়ে ফলন দেওয়ায় সারাদেশের চাষিদের মধ্যে সাড়া পড়ে গেছে। এরই মধ্যে এই রোগমুক্ত কলার চারা ৬৪ জেলায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আর যতই দিন যাচ্ছে রোগমুক্ত এই কলার চারার চাহিদা ততই বাড়ছে।
সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তারা টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে চারা উৎপাদনে এগিয়ে এলে বাংলাদেশও একদিন অধিক ফলন সমৃদ্ধ রোগমুক্ত কলার উৎপাদন বাড়িয়ে রপ্তানীর তালিকায় কলার নাম লেখাতে পারবে বলে মনে করেন রাবির ওই গবেষক।

অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, তিনি মূলত ২০১৭ সালে টিস্যু কালচারের মাধ্যমে কলার চারা উদ্ভাবনের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও রাবি প্রশাসন গবেষণার জন্য ৪ লাখ টাকা দেয়। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

ওই গবেষক জানান, কলা লাভজনক ফসল হওয়া সত্ত্বেও এটি বিদেশে রপ্তানি করা যাচ্ছে না। কারণ বাংলাদেশের চাষিরা সাধারণত যেসব জাতের কলার চাষ করেন সেসব কলা ফেটে যায়, গায়ে কালো দাগ পড়ে, ইউনিফরমিটি (সব কলার আকার আকৃতি একই হওয়া) না থাকা, কাঁদির সব কলা এক বয়সের না হওয়া এবং কলায় মাত্রারিক্ত কীটনাশকের কারণে রপ্তানির শর্তগুলো পূরণ করা যাচ্ছে না। কিন্তু টিস্যু কালচার কলার চারা লাগালে ৬-৭ মাসের মধ্যেই কলার মোচা বের হয়। যেখানে সাধারণ কলার চারার ক্ষেত্রে ১০-১১ মাস সময় লাগে। সেখানে এই কাঁদির সব কলার আকার আকৃতি একই হবে এবং মাত্র সাত-আট মাসের মধ্যে ফলনও বেশি হবে। আর এই কলার বাজার মূল্য বেশি হওয়ায় কৃষকের ৩০-৪০ শতাংশ বেশি লাভ হবে অন্যান্যা সাধারণ কলার চেয়ে।

তিনি জানান, টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত  কলার নতুন জাতগুলোর পুষ্টিগুণ অধিক। অল্পসময়ে অধিক ফলন পাওয়া যায়। এছাড়া সনাতন পদ্ধতির চেয়ে ২-৩ মাস আগে এই কলা সংগ্রহ করা যায়। দেশের অসংখ্য চাষিরা নতুন উদ্ভাবিত চারা চাষাবাদ শুরু করেছেন। কৃষকদের কাছ থেকে অভাবনীয় সাড়া পেয়েছেন। তবে চাহিদা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য বেসরকারি উদ্যোগে ল্যাবে টিস্যু কালচার চারা উৎপাদন করা দরকার।

এদিকে রাবি উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার সংস্থানের জন্য নতুন নতুন জাতের শস্য ও ফলমূল উদ্ভাবন একান্ত প্রয়োজন। সেলক্ষ্যে দেশের অন্যতম শীর্ষ গবেষণাকেন্দ্র রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে একদল উদ্ভাবনী গবেষক ও প্রয়োজনীয় গবেষণাগার। কৃতি গবেষকদের সাফল্যের স্বাক্ষর উন্নত জাতের ওই রোগমুক্ত কলা উদ্ভাবন। আগামীতে এই কলা এই অঞ্চলের পুষ্টির চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

বাংলাদেশ সময়: ০৮০২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০২৩
এসএস/এএটি
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।