ফেনী: ফেনী শহরতলীর উত্তর কাশিমপুর এলাকার কৃষক মোহাম্মদ আবদুল মোমিন ৩৬ শতক জমিতে আবাদ করেছেন সরিষার। কৃষি বিভাগ থেকে বীজ ও অল্প কিছু সার বাদে সেচ, মজুরি ও সার সব মিলিয়ে খরচ হয়েছে ৭ হাজার টাকা।
স্থানীয় ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা প্রণব চন্দ্র মজুমদার জানান, সব ঠিক থাকলে এই ৩৬ শতকে প্রায় ১৭৫ কেজি সরিষা উৎপাদন হবে। প্রতি কেজি ১৩০ টাকা হারে যার বাজারমূল্য ২২ হাজার ৭৫০ টাকা। হিসাব কষলে দেখা যায়, লাভের পরিমাণ খরচের দ্বিগুণেরও বেশি।
লাভের দিক বিবেচনা করেই ফেনীতে বাড়ছে সরিষার আবাদ। প্রতি বছর ছাড়িয়ে যাচ্ছে কৃষি বিভাগের লক্ষ্যমাত্রা। কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন পুরো জেলার কৃষকদের এ বিষয়ে আগ্রহী করতে পারলে সরিষা তেল উৎপাদনে ফেনীতে বিপ্লব ঘটবে।
জেলার বিভিন্ন এলাকায় মাঠ পরিদর্শনে দেখা মিলে সম্ভাবনার এ চিত্র।
ফেনী সদরের পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের উত্তর কাশিমপুর গ্রামের আবদুল হক জানান, তিনি ৪২ শতক জমিতে বারি ১৪ সরিষার আবাদ করেছেন। কোনো ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়নি। গত বছরের মতো এবারও ভালো ফলনের আশা করছেন তিনি। পরিবারের জন্য তেল এবং গবাদিপশুর জন্য খৈলও মিলবে সরিষা থেকে। পরিবারের চাহিদার অতিরিক্ত তেল বিক্রি করেও ভালো আয় হবে।
একই গ্রামের দাস পাড়ার বাসিন্দা তেজেন্দ্র দাস জানান, স্থানীয় কৃষি অফিসারের পরামর্শে তিনি ৩৬ শতক জমিতে সরিষার অবাদ করেছেন। গত বছর মোট ৪ মণ সরিষা পেয়েছেন এবারও এমন ফলন আশা করছেন তিনি।
তেজেন্দ্র জানান, সারা বছর পরিবারের চাহিদা মিটিয়েও সরিষা বিক্রি করা যায়। খরচের তুলনায় লাভ বেশি থাকে।
বিরলী গ্রামের সৌখিন চাষি কাজী নজরুল ইসলাম বলেন, চলতি মৌসুমে তিনি ১ বিঘা জমিতে সরিষার আবাদ করেছেন। তিনি আশা করছেন সরিষায় ফলন ভালো হবে।
নজরুল ইসলাম জানান, এক বিঘা জমিতে সরিষা চাষে বীজ ও সামান্য সেচ খরচসহ খরচ পড়ে ৫ হাজার টাকা। খরচ বাদে বিঘা প্রতি কৃষকদের লাভ থাকে ৬ থেকে ৮ হাজার টাকা। জমিতে এক কেজি সরিষার বীজ বপন করে ১শ কেজি সরিষা পাওয়া যায়।
একই ধরনের আশা ব্যক্ত করেছেন কবির আহম্মদ ও আবিদ হাসান নামের আরও দুই কৃষক।
বেড়েছে আবাদ, বাড়বে উৎপাদন:
ফেনীতে সরিষা চাষে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকদের। বিগত মৌসুমের তুলনায় ফেনীর বিভিন্ন এলাকায় সরিষার আবাদ ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অন্যান্য ফলনের তুলনায় সরিষা চাষে লাভ বেশি পাওয়ায় কৃষকদের আগ্রহ আরও বেড়েছে। আগামীতে সরিষার আবাদ আরও বাড়বে বলে জানান স্থানীয় কৃষকরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানান, গত বছর এ জেলায় সরিষার আবাদ হয়েছিল ১হাজার ৮০৬ হেক্টর। চলতি বছরে চাষ হয়েছে ৩ হাজার ৪৯৪ হেক্টর। লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়ে আবাদের পরিমাণ বেড়েছে ১ হাজার ১৪৭ হেক্টর। চলতি বছরের চাষাবাদের হিসাবে ৪৬৭০ টন সরিষা উৎপাদন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কৃষি বিভাগ জানায়, প্রতি এক কেজি সরিষা থেকে ৪শ গ্রাম সরিষার তেল পাওয়া যায়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে সরিষার চাষ বাড়লে সরিষার তেলের চাহিদা পূরণে আমরা আরও বেশি ভূমিকা পালন করতে পারবো। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মিঠুন ভৌমিক এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
ফেনী সদর উপজেলা কৃষি অফিসার শারমীন আক্তার বলেন, কৃষক পর্যায়ে সরিষার আবাদের বিষয়ে আগ্রহ বাড়ছে। লাভের মুখ দেখায় কৃষকরা সরিষার আবাদ বাড়াচ্ছেন। চলতি মৌসুমে ফেনী সদর উপজেলায় ১ হাজার ৪৬২ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে বিগত বছর যা ছিল ৮ হাজার ৫০ হেক্টর।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অনুরুপভাবে জেলার সোনাগাজী, ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া ও দাগনভূঁঞাতেও লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে সরিষার আবাদ।
গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার, প্রণোদনা পাচ্ছে কৃষক:
বৈশ্বিক সংকটের কারণে সারা বিশ্বেই রয়েছে তেলের সংকট। এমন সংকটে সরিষা উৎপাদন বাড়ালে ভোজ্যতেলের চাহিদা মিটবে বলে মনে করছেন সরকার। সেলক্ষ্যেই মাঠপর্যায়ে সরিষা চাষের জন্য কৃষকদের আগ্রহী করে তোলা হচ্ছে। সরকার এ বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, ফেনীর উপ-পরিচালক মো. একরাম উদ্দিন বলেন, ভোজ্যতেলের দাম রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈশ্বিক অস্থিরতার কারণে আমদানি নির্ভর এ নিত্যপণ্যে সংকট ‘সাময়িক’। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার ৯০ শতাংশই আমদানি করতে হয়। তবে সরকার চাইছে আমদানি নির্ভরতা কিছুটা কমিয়ে দেশেই উৎপাদন বাড়তে। এজন্য বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা ও প্রকল্প হাতে নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। প্রতি বছর ২৮/৩০ হাজার কোটি টাকার ভোজ্যতেল আমদানি করতে হয়। আমাদের সরকারের লক্ষ্য হলো আগামী তিন বছরের মধ্যে ভোজ্যতেল আমদানি ৫০ শতাংশ কমিয়ে নিয়ে আসা।
সেলক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। সরিষার ব্যাপারে আমরা জোর দিচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন কোনো জমি যেন পতিত না থাকে। সেলক্ষ্যেই আমরা কাজ করছি। ফেনীর যে ১ হাজার ১৪৭ হেক্টর জমিতে এবার সরিষার আবাদ বেড়েছে সে জমিগুলো আগে অনাবাদী ছিল। আমরা আশা করছি, কৃষকরা সরিষার দিকে আরও ঝুঁকবেন। কৃষকরা এগিয়ে এলে এ জেলার সরিষার তেলের চাহিদা তাদের উৎপাদিত তেল দিয়েই সম্ভব।
ফেনী সদর উপজেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়ন কৃষি কর্মকর্তা প্রণব চন্দ্র মজুমদার বলেন, সরকার নির্দেশনা দিয়েছে যাতে কোনো জমি খালি না থেকে। সেলক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমরা কৃষকদের বিনামূল্যে সার ও বীজ সরবরাহ করছি।
তিনি জানান, তার ব্লকে মোট ৪০০ কৃষককে তিনি প্রণোদনা দিয়েছেন। ফুলগাজীর উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মনোজ কুমার বলেন, সরকারের নির্দেশনার আলোকে সার, বীজ থেকে শুরু করে প্রশিক্ষণ সবই দেওয়া হচ্ছে কৃষকদের।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলায় সরিষা আবাদের জন্য ১৩ হাজার ৫০০ জন কৃষককে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। প্রতিজনে এক বিঘা জমির জন্য সার ও বীজ সরবরাহ করা হয়েছে। সরিষার আবাদ বাড়ার জন্য ৪৬৭টি প্রদর্শনী করা হয়েছে। সেসব কৃষককে বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছে সার, বীজ, ট্রেনিংসহ যাবতীয় সহযোগিতা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মিঠুন ভৌমিক এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
আমন-বোরোর মাঝের সময়টা কাজে লাগছে:
আমন ধান উঠে যাওয়ার পর বোরো আবাদের আগের যে মাঝের সময়টুকু রয়েছে এ সময়তেই চাষ হয় সরিষার। মাত্র দেড় থেকে দুই মাসের মাথায় মিলে সরিষার ফলন।
কৃষি বিভাগ বলছে, সরিষা আবাদের ফলে জমিতে সরিষার পাতা পড়ায় জমির উর্বরতা বাড়ে, যার ফলে পরের বোরো আবাদও ভালো হয়।
ফেনী সদরের পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের কাশিমপুর গ্রামের কৃষক হারাধন দাস বলেন, এটি পরীক্ষিত। সরিষা আবাদ করলে বোরো ধানও ভালো ফলন হয়। সাধারণত নভেম্বরের শেষ দিক ও ডিসেম্বরের শুরুতে সরিষা লাগাতে হয়। জানুয়ারির মাঝামাঝি অথবা ফেব্রুয়ারির শুরুতে সরিষার ফলন ঘরে উঠে।
কৃষক হারাধন দাশ বলেন, বোরো আবাদের আগে খরচ পোষাতেই সরিষা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন এখানকার কৃষকরা। নতুন জাতের বারি সরিষা-১৪ রোপণে উৎসাহিত করায় কৃষকরা ভালো ফলন পাচ্ছেন। প্রতি হেক্টরে প্রায় দেড় টন ফলন হয় এ সরিষায়।
এছাড়া বারি সরিষা -৯, বারি সরিষা-১০, বারি সরিষা -১১, বারি সরিষা -১২, বারি সরিষা-১৩, বারি সরিষা -১৪, বারি সরিষা -১৫, বারি সরিষা -১৬, বারি সরিষা -১৭, বিনাসরিষা-৪, বিনা সরিষা-৭, বিনা সরিষা-৮, বিনা সরিষা-৯ এবং বিনা সরিষা-১০ জাতের সরিষাও চাষাবাদ করছেন কৃষকরা।
কৃষি বিভাগ বলছে, গত বছরের চেয়ে এবার বেশি জমিতে সরিষার চাষ হয়েছে। এর প্রধান কারণের মধ্যে রয়েছে, বাজারে সরিষা এবং ভোজ্য তেলের দাম বেশি। আবহাওয়া শেষ পর্যন্ত অনুকূলে থাকলে এবার সরিষার বাম্পার ফলন হবে বলে আশাবাদী তারা।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০২৩
এসএইচডি/এএটি