কুষ্টিয়া: কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের জংলি গ্রামের তরুণ কৃষক শামীম আহম্মেদ। জীবিকার তাগিদে বিদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন তিনি।
বাড়ি ফিরে মাঠে চাষাবাদ করার কথা ভাবছিলেন শামীম। এ ভাবনা থেকেই উপজেলা কৃষি অফিস থেকে তিনি উচ্চ মূল্যের ফসল চাষের ওপরে প্রশিক্ষণ নেন। সেই সঙ্গে মোবাইলে ভিডিও দেখে ধারণা নিতে থাকেন বিভিন্ন ফসল চাষের। কৃষি অফিসের সহযোগিতায় যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্প এর ২০ শতক জমিতে প্রদর্শনী হিসেবে চাষ করেন বারোমাসি তরমুজ। তাতেই করেন বাজিমাত। মাত্র দুই মাসেই ওই জমি থেকে তার লাভ আসে ২ লাখ টাকারও বেশি।
শামীম এখন রীতিমতো ওই এলাকার কৃষকদের কাছে মডেল। এত অল্প সময়ে এমন ফসল চাষ করে সাড়া ফেলেছেন তিনি।
শামীমের জমিতে ঘুরে দেখা যায়, ছোট ছোট মাচা। বাশের বাতার উপরে পলিথিনের জাল দিয়ে মাচায় ছাউনি দেওয়া। পুরো মাচাগুলো ভরে আছে সবুজ পাতায়। মাচার নিচে ঝুলছে হলুদ ও কালো রঙের বাহারী তরমুজ। ফলগুলো যাতে পড়ে না যায় এ জন্য জাল দিয়ে বেধে দেওয়া। বাহারী এসব তরমুজ দেখতে তার জমিতে প্রতিনিয়ত ভিড় করেন কৃষকরা। সেই সঙ্গে খুবই কম সময়ে এই ফসলে অধিক লাভ হওয়ায় এলাকায় চাষীদের মধ্যেও বেশ আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে।
কৃষক শামীম আহম্মেদ বাংলানিউজকে জানান, আমি দীর্ঘ নয় বছর ওমানে ছিলাম। দেশের বাইরের জীবনটা অনেক কষ্টের। তাই বাড়ি ফিরে এসে ভাবলাম কৃষি কাজ করে উন্নতি করা যায় কিনা। তাই আমি উপজেলা কৃষি অফিসে গেলে তারা উচ্চ মূল্যের ফসল চাষের কথা জানায়। এরপর আমি মোবাইলে বিভিন্ন ফসলের আবাদ কীভাবে করে সে সম্পর্কে ধারণা নিতে থাকি। একসময় এই এলাকার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন আমাকে বলেন গ্রীষ্মকালীন সময়ে তরমুজ চাষ বেশি লাভজনক। তারপর আমি যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্প থেকে চাষের প্রশিক্ষণ নেই। তারা আমাকে ২০ শতাংশ জমিতে প্রদর্শনী হিসেবে দেয়। তাদের সহযোগিতায় আমি এবার ইয়োলো গোল্ড (হলুদ) ও স্মার্ট বয় (কালো) জাতের তরমুজের চাষ করেছি।
তিনি আরও জানান, আমি প্রথমে এ তরমুজের বীজ সংগ্রহ করি। পরে যেহেতু এ চাষ এই এলাকায় নেই তাই নিজে নিজেই চাষ শুরু করি। এজন্য কৃষি অফিস থেকে বিভিন্ন সময়ে পরামর্শ নিয়েছি। জমিতে কীটনাশকের পরিবর্তে আমি জৈব পদ্ধতি ব্যবহার করেছি। এজন্য আমি হলুদ ফাঁদ ব্যবহার করেছি। সেই সঙ্গে আমি মালচিং ব্যবহার করায় সেচ ও শ্রমিক খরচ অনেক কম হয়েছে। ২০ শতক জমিতে মাত্র ১৩ হাজার টাকা খরচ করেছি।
শামীম জানান, আমি যখন প্রথমে এ চাষ করি, মালচিং দেয় তখন এলাকার চাষিরা আমাকে পাগল বলতো। আমার বাবাও আমাকে না করেছিলেন এটা বলে যে, এই এলাকায় তরমুজ হয় না। আর মাচায় তরমুজ হবে তারা কেউ আশাও করেনি। যখন ছোট ছোট তরমুজ ধরে আবার বাবা তখন বকাবকি শুরু করেছিলেন এটা ভেবে যে, ছোট ছোট তরমুজের গুটিগুলো নষ্ট হয়ে হয়ে হলুদ হয়ে গেছে। এ হবে না গাছ কেটে ফেলতে হবে। তখন আমি তাকে বোঝাই যে এই তরমুজের রংই এমন হলুদ। এখন বীজ রোপণের পরে মাত্র ৬৫-৭০ দিনের মাথায় আমি তরমুজ পেয়েছি। খুবই সুন্দর সুন্দর হলুদ, কালো তরমুজ। দেখতে বাঙ্গির মতো হলেও ভেতরটা তরমুজের মতো টকটকে লাল এবং মিষ্টি বেশি। অনেকেই আগ্রহ দেখাচ্ছেন এ চাষে। আমি তাদের পরামর্শ দিচ্ছি।
এই কৃষি উদ্যোক্তা আরও বলেন, আমি মাত্র ১৩ হাজার টাকা খরচ করেছি সব মিলিয়ে। আমার এই জমিতে ইতোমধ্যে ২০ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করেছি। এখনও গাছে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ মতো তরমুজ আছে। যার এক একটির ওজন প্রায় আড়াই থেকে তিন কেজি করে গড়ে। স্থানীয় বাজারেই আমি চাহিদা মতো তরমুজ দিতে পারছি না। ৭০ টাকা কেজি হিসাবে ক্রেতারা মাঠ থেকেই তুলে নিয়ে যাচ্ছেন। আশা করছি প্রায় ২ থেকে আড়াই লাখ টাকার মতো তরমুজ বিক্রি করতে পারবো। মাত্র দুই মাসে এমন লাভ অন্য ফসলে কখনও হতো না।
একই এলাকার কৃষক আলি আক্কাস বাংলানিউজকে জানান, আমি কলা, বেগুন, ঝিঙা, শসা চাষ করি বেশি। এই এলাকার এই তরমুজের চাষ কখনও হয়নি। শামীমই প্রথম এই তরমুজ চাষ করেছেন। এটা খুবই সট টাইমের ফসল। খুবই লাভজনক। তার দেখাদেখি যদি এলাকার কৃষকরা এটি চাষ করেন তাহলে অবশ্যই তারা লাভবান হবেন।
কৃষক আলমগীর হোসেন বলেন, আসলে এটি তরমুজের সময় না বলে সবাই বিষয়টি হাস্যকর ভাবতো। শামীম দুই মাসে ২ লাখ টাকা লাভ দেখাচ্ছেন। আর এটা বিষমুক্ত হওয়ায় খুবই ভালো খাওয়ার জন্য। এই গ্রামের কৃষকরা এই তরমুজ চাষ দেখে খুশি এবং আগামীতে আরও চাষ হবে। আমরা আশা করছি এই এলাকা থেকে একসময় তরমুজ বাইরে রপ্তানি করা হবে।
শামীম আহম্মেদের বাবা এলাহী মণ্ডল বলেন, আমি তো প্রথমে মনে করেছিলাম যে পাগলের কাজ। কিন্তু এখন দেখছি এই তরমুজ চাষ আসলেই খুব লাভজনক। কম সময়ে এটির ফলনও বেশি আর দামও ভালো। আগামীতে আরও বেশি করে লাগাবো বলে ভাবছি।
কৃষক শরীফ আলী বলেন, সরকার যদি আরও বেশি করে এভাবে প্রশিক্ষণ দেয় তাহলে কৃষকরা অনেক লাভবান হবেন। আমরা মাচায় তরমুজ চাষ জানতাম না। এখন চোখের সামনে দেখছি। আগামীতে বড় পরিসরে এভাবে আবাদ করবো।
উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন বাংলানিউজকে জানান, গ্রীষ্মকালীন তরমুজ চাষ অন্য ফসলের তুলনায় কম সময়ে অধিক লাভজনক। তবে এই এলাকায় এটা নতুন হওয়ায় চাষটা চ্যালেঞ্জিং হিসাবে নিয়েছিলাম। কৃষক শামীমের সাফল্য দেখে এলাকার অনেক কৃষক এই তরমুজ চাষে আগ্রহ দেখিয়েছেন। আগামীতে এ চাষ আরও বাড়বে বলে আশা করি।
কুমারখালী উপজেলা কৃষি অফিসার দেবাশীষ কুমার দাস বাংলানিউজকে জানান, বিদেশ থেকে ফিরে এসে এভাবে চাষ করে এতো লাভ করে কৃষক শামীম আহম্মেদ অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছেন। আমরা যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের মাধ্যমে তাকে তিন দিনের প্রশিক্ষণ ও প্রদর্শনী দিয়েছি। ২ মাসের মধ্যে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা লাভ হওয়াটা অন্য ফসলের তুলনায় অনেক বেশি। আশা করছি এ বছর উপজেলায় ২০ শতকের পরিবর্তে আগামী বছরে ২০ বিঘা জমিতে এ গ্রীষ্মকালীন তরমুজের আবাদ হবে।
যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের পরিচালক কৃষিবিদ রমেশ চন্দ্র ঘোষ বাংলানিউজকে জানান, কৃষিমন্ত্রীর নির্দেশনায় কৃষিকে লাভজনক ও বাণিজ্যিক করার লক্ষ্যে যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্প কাজ করছে। যশোর হচ্ছে কৃষিতে সমৃদ্ধ একটি অঞ্চল। কৃষিকে লাভজনক ও বাণিজ্যিক করার লক্ষ্যে প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা উচ্চ মূল্যের ফসল চাষে প্রশিক্ষণ, মাঠ দিবস ও প্রদর্শনীর মাধ্যমে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছি। এরই ধারাবাহিতায় তিনদিনের প্রশিক্ষণ নিয়ে ২০ শতাংশ জমিতে প্রদর্শনী নিয়ে কৃষক শামীম আহম্মেদ উচ্চ মূল্যের ফসল গ্রীষ্মকালীন তরমুজ চাষ করেছেন। তিনি আশা করছেন মাত্র ২ মাসে তার দুই লাখ টাকার মতো লাভ হবে। কম জমিতে কম সময়ে অধিক লাভজনক হওয়ায় আমরা এ চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছি। সেই সঙ্গে প্রকল্প মেয়াদে আমরা তরমেুজের মতো উচ্চমূল্যের নিরাপদ বিভিন্ন সবজির ১৪ হাজার ৩১০টি প্রদর্শনীর স্থাপন করবো। এতে কৃষকরা উচ্চমূল্যের ফসল চাষে আরও আগ্রহী হবেন।
কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. হায়াত মাহমুদ বাংলানিউজকে জানান, গ্রীষ্মকালীন তরমুজ চাষ কম সময়ে অধিক লাভজনক। তরমুজের বাজারমূল্য ভালো হওয়ায় এবং চাষাবাদ লাভজনক হওয়ায় এটি একটি সম্ভাবনাময়। সার্বক্ষণিক কৃষকদের সেবা দেওয়া হচ্ছে। এতে অনেক বেকার ও শিক্ষিত যুবকেরা আধুনিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন উচ্চমূল্যের ফসল চাষ করে বেশ লাভবান হচ্ছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক কৃষিবিদ হামিদুর রহমান জানান, দেশের উন্নয়নে, কৃষির উন্নয়নের, কৃষকের উন্নয়নে তরুণ উদ্যোমী কৃষকদের এগিয়ে আসতে হবে। নিরাপদ ফসল উৎপাদনে গ্যাপ নীতি অনুসরণ করে কৃষিকে টেকসই, লাভজনক ও বাণিজ্যিক করতে হবে। গ্রীষ্মকালীন তরমুজ কম সময়ে বেশি লাভজনক ও উচ্চমূল্যের একটি ফসল। এসব ফসল চাষে কৃষকেরা অধিক লাভবান হবেন এবং সেই সঙ্গে দেশও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮০৯ ঘণ্টা, জুন ১৪, ২০২৩
এফআর