ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কৃষি

লটকনের রাজ্য থেকে ৩৫০ কোটি টাকার ফল বিক্রির আশা

সুজন বর্মণ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২৩ ঘণ্টা, আগস্ট ৪, ২০২৩
লটকনের রাজ্য থেকে ৩৫০ কোটি টাকার ফল বিক্রির আশা

নরসিংদী: নরসিংদীর লটকন ফলের নাম ডাক আছে। দেশি এই ফলের বাণিজ্যিক উৎপাদনও হয় এখানে বেশি।

স্বাদে ও পুষ্টি গুণে ভরপুর লটকন ফল স্থানীয় বাজার ছাড়াও ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় যায়। এ বছর লটকনের ফলন ভালো হয়েছে এবং ভালো দামে লটকন বিক্রি হচ্ছে বলে জানান বাগান মালিকরা। অম্লমধুর লটকন চাষে গত দুই দশকে পাল্টে গেছে এ জেলার গ্রামীণ অর্থনীতি।  

জানা যায়, দেশের কয়েকটি জেলায় লটকন চাষ হলেও আকারে বড়, দেখতে হলদে মসৃণ আর স্বাদে সুমিষ্ট হওয়ায় এখানকার লটকনের চাহিদা আর সবাইকে ছাড়িয়ে। অল্প খরচে বেশি লাভ হওয়ায় স্বাবলম্বী হয়েছে অনেক চাষি। প্রচণ্ড দাবদাহ ও খরার কারণে এবার লটকনের সাইজ কিছুটা ছোট। তবে ফলন বেশি হওয়ায় কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। এখানকার লটকন খেতে মিষ্টি ও সুস্বাদু হওয়ায় দেশ-বিদেশে চাহিদাও অনেক।

লটকন চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০ বছর আগে শিবপুর উপজেলার আজকিতলা গ্রামের আজিজুল হক প্রথম বাণিজ্যিকভাবে লটকনের বাগান করেন। এরপর লটকনের চাহিদার সঙ্গে বেড়েছে আশপাশের গ্রামে বাগানের সংখ্যা। দেখতে সুন্দর এবং সুস্বাদু হওয়ায় ধীরে ধীরে এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে।

মার্চ মাসের দিকে লটকন গাছে ফুল আসে। গাছের গোড়া থেকে শুরু করে শাখাপ্রশাখা পর্যন্ত ঝুলন্ত মঞ্জরিতে থোকায় থোকায় ফল আসে। প্রতিটি পুষ্পমঞ্জরিতে পাঁচ থেকে পঞ্চাশটি ফল দেখা যায়। ফল পরিপক্ব হতে সময় লাগে চার থেকে পাঁচ মাস। ফলের রং হলুদ ও ভেতরে দুই থেকে পাঁচটি বীজ হয়। বীজের গায়ে জড়ানো রসাল অংশই ফলের শাঁস। জাত ভেদে টক বা টক-মিষ্টি স্বাদের হয়ে থাকে। জুনে লটকন বাজারে আসতে শুরু করে। জুলাই ও আগস্ট মাসে পরোধমে বাজারে পাওয়া যায়।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, নরসিংদীর শিবপুর, রায়পুরা ও বেলাব উপজেলার পাহাড়ি এলাকার লটকন বাগানগুলো এখন ফলে ভরপুর। গাছের গোড়া থেকে ওপরের অংশের শাখাপ্রশাখা পর্যন্ত লটকন ফলে জড়িয়ে আছে। এ বছর জেলায় এক হাজার ৮৯০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে সুস্বাদু লটকনের। এর মধ্যে শিবপুর উপজেলায় এক হাজার ৬০০ হেক্টর, বেলাব উপজেলায় ২০০ হেক্টর, রায়পুরা উপজেলায় ৫০ হেক্টর ও মনোহরদী উপজেলায় ৪০ হেক্টর জমিতে লটকন চাষ হয়েছে। হেক্টরপ্রতি প্রায় ১৭ মেট্রিক টন হিসাবে এসব জমি থেকে মোট লটকন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩২ হাজার মেট্রিক টন। যার বাজারমূল্য ৩৫০ কোটি টাকা।

সরেজমিনে জেলার বেলাব উপজেলার আমলাব ইউনিয়নের আবদুল্লানগরে সবচেয়ে বড় লটকন বাগান ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি গাছের গোড়া থেকে শুরু করে মাথা পর্যন্ত ঠোকায় ঠোকায় ঝুলছে লটকন। লটকনগুলো দেখতে যেমন সুন্দর এটি খেতেও তেমন সুস্বাদু। বাগান থেকেই পাইকাররা এসে লটকন কিনে নিয়ে যাচ্ছে। তারা গাছ থেকে লটকন পেরে থরে থরে ঝুড়িঁতে সাজাচ্ছে। পরে তা নিয়ে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।

বাগানের মালিক ইঞ্জিনিয়ার নূরুল আমিন ভূইয়া বলেন, ১০০ বিঘা জায়গার ওপর লটকন বাগানটি করেছি। আমার বাগানে প্রায় ২০০০ মেট্রিকটন লটকনের ফলন হয়েছে। কিন্তু তাপপ্রবাহের কারণে কিছু লটকন ঝড়ে গেছে। তারপরও আশা করা হচ্ছে ৫০ লাখ টাকার মত লটকন বিক্রি হবে। কৃষি অফিস থেকে আমাদের পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করলে লটকনের ফলন আরও বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে আমাদের এলাকার চাষিরা লটকন চাষে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে।

বাগানের শ্রমিক আবুল কাশেম বলেন, আমরা ১২ থেকে ১৩ জন শ্রমিক বাগানে কাজ করি। গাছগুলোতে গোবর সার দেই ও আগাছা বাছাই করে থাকি। এছাড়া লটকন গাছগুলোতে তেমন কোনো যত্ন নিতে হয় না। অল্প খরচেই অধিক লাভবান হওয়া যায়।

আসাদ মিয়া নামে আরেক কৃষক বলেন, আমি দুই কানি জমিতে লটকন চাষ করেছি। ইতোমধ্যে হাটে ৪ লাখ টাকা লটকন বিক্রি করেছি আশা করছি আরও ২ লাখ টাকার লটকন বিক্রি করতে পারবো।

বর্তমানে লটকনের মৌসুমে বাগান কিনেও লাভবান হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। সোহেল মিয়া নামে এক ব্যবসায়ী বাংলানিউজকে বলেন, আমার নিজের লটকন বাগান রয়েছে। পাশাপাশি আরও ৫টি বাগান ২৫ লাখ টাকা দিয়ে কিনেছি। বাজারে লটকনের চাহিদা থাকায় আশা করছি এবার ৩২ লাখ টাকার লটকন বিক্রি করতে পারবো।

এদিকে, লটকনের মৌসুম ঘিরে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে জমে উঠেছে বৃহৎ মৌসুমি বাজার। নরসিংদী জেলায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে রায়পুরা উপজেলার মরজাল বাজার ও শিবপুরের চৈত্যান্য বাজারে বিক্রি হয় লটকন।  
এসব বাজারে গিয়ে দেখা যায়, ভোর থেকে সকাল ১১টা পর্যন্ত আশপাশের এলাকা থেকে চাষিরা ঝুড়িতে লটকন নিয়ে ভ্যানে করে মহাসড়কের বাজারে ভিড় করছেন। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা ও রপ্তানিকারকরা স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে লটকন কিনে ট্রাকে করে নিয়ে যাচ্ছেন যার যার গন্তব্যে।  

প্রতিদিন মরজালের লটকন হাটে প্রায় কোটি টাকার লটকন বিক্রি হয় বলে জানান বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এবছর প্রকার ও আকারভেদে প্রতি মণ লটকন দুই হাজার ৫০০ টাকা থেকে ছয় হাজার টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ২৫০ টাকা।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা থেকে হাটে এসেছেন পাইকারি বিক্রেতা মোহাম্মদ মিন্টু। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, অন্যান্য এলাকার লটকন টক আর নরসিংদীর লটকন সুস্বাদু। এজন্য এখানকার লটকনের ব্যাপক চাহিদা। এবার হাটে গতবছরের তুলনায় লটকনের দাম একটু কম। লটকনের মান ও সাইজ অনুসারে মণ ২৫০০ থেকে ৬০০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে।

কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর থেকে এসেছেন লোকমান মিয়া। তিনি বলেন, প্রতিদিন ৫ থেকে ৬ মণ লটকন নিয়ে বাজারে বিক্রি করি। আমার লটকন সুস্বাদু হওয়ায় বাজারে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিক্রি হয়ে যায়। ফলে দামও ভালো পাচ্ছি।

আরেক পাইকারি বিক্রেতা মনির হোসেন বলেন, আমি প্রায় ১৮ বছর ধরে হাট থেকে লটকন কিনে নিয়ে কুমিল্লায় বিক্রি করে থাকি। এবার দুই মাস ধরে প্রতিদিন হাট থেকে ১৫০০ থেকে ১৬০০ কেজি লটকন কিনে নিয়ে যাচ্ছি। আমরা ৮০ থেকে ১০০ টাকায় কিনে নিয়ে ৯০ থেকে ১৫০ টাকায় লটকন বিক্রি করে থাকি।

লটকন যেমন সুস্বাদু তার বাগান দেখতে আরো মায়াবীময়। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে বাগানগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে। লটকনের চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া সৌন্দর্য উপভোগ করতে মানুষ দূরদূরান্ত থেকে ঘুরতে আসছেন। বাগানেই স্বাদ নিচ্ছেন পাকা লটকনের। আর পাশাপাশি ছবির ফ্রেমে বন্দি করছেন নিজেদের এই সুন্দর মুহূর্ত।

গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মুজিবুর রহমান কাজল পরিবার নিয়ে ঘুরতে এসেছেন লটকন বাগানে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, লটকন আমরা সাধারণত বাজার থেকে কিনে খাই। তাই এবার পরিবার নিয়ে ঘুরতে বাগানে এসেছি। পুরো বাগান এখন লটকনময়। দেখতে খুবই ভালো লাগছে। আমরা গাছ থেকে পেরে লটকন খেতে পারছি। খুবই ভালো সময় কাটছে।

ঢাকার দক্ষিণখান থেকে লটকন বাগানে ঘুরতে এসেছেন পারভীন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, টিভিতে সুন্দর সুন্দর লটকন বাগানের ভিডিও দেখি। তাই এবার পরিবার নিয়ে সরাসরি বাগানে চলে এসেছি। ভিডিওতে যা দেখেছি তার চেয়েও লটকন বাগান আরও সুন্দর।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, লটকনে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি-২ ও ভিটামিন-সি রয়েছে। প্রতিদিন আমাদের দেহের জন্য যে পরিমাণ ভিটামিন-সি প্রয়োজন চারটি লটকন সে চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট। এছাড়া রুচি বাড়াতে ও মানসিক অবসাদ দূর করতেও এটি উপকারী।

নরসিংদী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জেলা প্রশিক্ষণ অফিসার ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রশিদ বাংলানিউজকে বলেন, গত ছরের তুলনায় এবারের লটকনের ফলন বেশি হয়েছে। তবে এপ্রিল-মে মাসে বৃষ্টি না হওয়ার কারণে অতি তাপদাহের কারণে লটকনের সাইজ কিছুটা ছোট হয়েছে। তবে বাজারে চাহিদা থাকায় কৃষকরা দাম ভালোই পাচ্ছেন। এবার প্রায় ২ হাজার ৫০০ মেট্রিকটন লটকন বিদেশে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।  

স্থানীয় কৃষি বিভাগ চাষীদের পরামর্শ, প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা দিচ্ছে। এছাড়া লটকনের বহুমুখী ব্যবহার করা যেতে পারলে লটকন থেকে আরও বেশি আয় করা যেতে পারে। আমরা লটকনের গুণগতমান বৃদ্ধি ও লটকনের সময়কাল বৃদ্ধির জন্য কাজ করছি।

বাংলাদেশ সময়: ১৯২১ ঘণ্টা, আগস্ট ০৪, ২০২৩
এসএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।