ঢাকা, শনিবার, ১৩ পৌষ ১৪৩১, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

কৃষি

আমন ক্ষেতে ‘কট’ ইঁদুরের হানা 

মো. নিজাম উদ্দিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১২ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৬, ২০২৩
আমন ক্ষেতে ‘কট’ ইঁদুরের হানা 

লক্ষ্মীপুর: ফসলি ক্ষেতে বড় ও দ্রুতগামী এক ধরনের ইঁদুরের আক্রমণে দিশেহারা লক্ষ্মীপুর জেলার শত শত কৃষক।  
আমন ও সবজি ক্ষেতে হঠাৎ করে ব্যাপকহারে আক্রমণ শুরু করেছে ইঁদুর।

 

ক্ষেতের সব কাঁচা ধানের গাছ কেটে ফেলছে। এতো বড় ইঁদুর আগে দেখেননি এখানকার কৃষকরা। তাই এর নাম দিয়েছেন ‘কট’ ইঁদুর। এদের আক্রমণে এখন ফসল নিয়ে উৎকণ্ঠায় আমন চাষিরা।

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা, কমলনগর ও রামগতি উপজেলার অধিকাংশ মাঠে নতুন ধরনের এ ইঁদুর আক্রমণ করেছে বলে জানিয়েছেন কৃষকেরা। বিষটোপ ও প্রাকৃতিক কোনো পদ্ধতিতেই থামানো যাচ্ছে না এদের।  

সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ, চররমনী মোহন এবং কমলনগর উপজেলার চর লরেঞ্চ ইউনিয়নের ২০ থেকে ২৫টি ক্ষেতে গিয়ে দেখা গেছে, প্রত্যেকটি ক্ষেতেই কাঁচা ধান কেটে ফেলেছে ইঁদুর। এতে কাঁচা ধান গাছ মরে গেছে। একই এলাকার সবগুলো ক্ষেতে ইঁদুর আক্রমণের খবর জানিয়েছেন কৃষকরা। ইঁদুরের এমন আক্রমণ দেখে দিশেহারা কৃষকরা।

কৃষকরা বলছেন, প্রতিদিনই নতুন নতুন ক্ষেতে আক্রমণ করছে ইঁদুর। তাদের আক্রমণ থেকে ফসল বাঁচাতে রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা কামনা করেছেন অনেকে।

শিশু নিকেতন নামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আবদুস শহীদ বলেন, ইঁদুরের অত্যাচারে তার এলাকার কৃষকরা অসহায় হয়ে পড়েছেন। ইঁদুর দমনে কৃষি বিভাগের সহায়তা কামনা করেন তিনি।  

কমলনগর উপজেলার চর লরেঞ্চ ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. ইসমাইল হোসেন জানান, চলতি আমন মৌসুমে সাড়ে চার একর জমিতে আমন ধান চাষ করেছেন তিনি। তার সবগুলো জমিতেই ব্যাপকহারে ইঁদুর আক্রমণ করেছে। ধানে থোড় (ফুল ধরার আগের পর্যায়) আসার আগেই ইঁদুর অন্তত ১০ শতাংশ জমির ধান পুরোপুরি কেটে ফেলেছে।

তিনি আরও জানান, অতীতে এলাকায় এমন বড় ইঁদুর দেখেননি তিনি। প্রায় বিড়াল আকৃতির খুবই বড় বড় ইঁদুর রাতে নদীর পানিতে সাঁতার কেটে ক্ষেতে ঢুকে কচি ধানগাছ কেটে দিয়ে চলে যায়। এতে গাছগুলো শুকিয়ে মারা যায়। কোনোভাবেই ইঁদুরগুলোকে দমন করতে পারছেন না তিনি। ইঁদুরের এমন আক্রমণ দেখে ধান চাষ নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন তিনি।

সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের চর উভূতি গ্রামের কৃষক নুর মোহাম্মদ জানিয়েছেন, তার ৬৪ শতাংশ জমির আমন ধানের প্রায় চার শতাংশ কেটে ফেলেছে ইঁদুর।

চর কালকিনি এলাকার কৃষক রহমান মিঝি বলেন, নদীপাড়ের সব জমিতে বিশাল আকৃতির ‘কট’ ইঁদুরের আক্রমণ শুরু হয়েছে। ইঁদুর তাড়াতে রাতে ক্ষেতের পাশে পুরোনো টায়ার পোড়াই, পটকা ফোটাই, বিষটোপ ব্যবহার করি। কিন্তু কাজ হচ্ছে না।

একই এলাকার কৃষক মনির জিলাদার জানান, গত কয়েক বছর আগেও এমন ইঁদুর তারা দেখেননি। একেকটি ইঁদুর বিড়াল আকৃতির। বিড়ালও এসব ইঁদুর দেখে ভয় পায়। ইঁদুরগুলো নদী সাঁতরে বহুদূর চলে যেতে পারে। পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে এমন ইঁদুর।

কৃষক মো. হানিফ জানান, তাদের এলাকায় অতীতে এমন বড় বড় ইঁদুর কখনো তারা দেখেননি। দেশীয় ফাঁদ পেতে কিংবা বিষটোপে এ ধরনের ইঁদুর দমন করা যাচ্ছে না।  

রামগতি উপজেলার চর বাদাম এলাকার কৃষক বিজয় কৃষ্ণদাস জানিয়েছেন, তার ৫০ শতাংশ জমিতে আমন চাষ করেছেন। এর মধ্যে ‘কট’ ইঁদুরের আক্রমণে প্রায় চার শতাংশ ধান নষ্ট হয়ে গেছে।
সদর উপজেলার চররমনী মোহন এলাকার নাছির, হোসেন আহমেদ ও মো. ওসমানসহ অনেক কৃষক জানান, প্রতি রাতেই তাদের আমন ক্ষেতে ‘কট’ ইঁদুর হানা দেয়। এতে তাদের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। কোনোভাবেই ইঁদুর দমন করা যাচ্ছে না।
 
ওই এলাকার কীটনাশক বিক্রেতা জিহাদ হোসেন বলেন, প্রতিদিন আমন ক্ষেতে বড় বড় ইঁদুরের আক্রমণ হচ্ছে। কৃষকরা ইঁদুর দমনে ক্ষেতে ‘জিংক ফসফাইড’ নামক এক ধরনের ওষুধ ব্যবহার করছেন। তাতেও নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না ইঁদুর।
 
সদর উপজেলার শাহাজাহান, বেলাল, আবুল বাশার, মো. হানিফ, মহিন উদ্দিন, মোশাররফসহ অন্তত ৫০ জন কৃষক ইঁদুরের এমন আক্রমণকে মহামারির সঙ্গে তুলনা করেছেন।

লক্ষ্মীপুর জেলার সার ও কীটনাশকের পরিবেশক আক্তার এন্টারপ্রাইজের পরিচালক আবদুর রহমান মোহন জানান, জেলার বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত তাদের তিনটি বিক্রয় কেন্দ্রে প্রতিদিনই শতশত কৃষক ইঁদুর মারার ওষুধ খুঁজছেন। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কট ইঁদুর নিয়ন্ত্রণের কোনো ওষুধ নেই।

তিনি জানান, এ ধরণের ইঁদুর বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসে অন্য কোনো জেলা থেকে পানি বা অন্য কোনো পথে লক্ষ্মীপুরে চলে এসেছে। এগুলো দমন করা না গেলে কৃষকদের ভবিষ্যৎ শোচনীয় হবে।

অবসরপ্রাপ্ত কৃষি বিশেষজ্ঞ ড. মহি উদ্দিন জানান, অতীতে কৃষকদের মাঠে ছিল পেঁচা, সাপ, গুই সাপ, শিয়ালসহ বিভিন্ন প্রাণী। যেগুলো ইঁদুর ধরে খেতো। এসব প্রাণী এখন তেমন দেখা যায় না। এসব প্রাণী সংরক্ষণ করলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি ইঁদুরের সমস্যা অনেকটা কমে যাবে।

লক্ষ্মীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক ড. জাকির হোসেন জানান, ইঁদুর দমনে মাঠ পর্যায়ের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা কৃষকদের সঙ্গে কাজ করছেন।  

তবে কি কাজ করছেন, তা জানাতে পারেননি এ কর্মকর্তা।

কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সূত্রে জানা গেছে, লক্ষ্মীপুর জেলায় চলতি মৌসুমে ৮৩ হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে আমন ধানের আবাদ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩০৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৬, ২০২৩
এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।