ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ পৌষ ১৪৩১, ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯ রজব ১৪৪৬

কৃষি

সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে সারের ‘কৃত্রিম সংকট’, বিপাকে ডিলার-কৃষক

তানভীর আহমেদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭২২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০২৫
সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে সারের ‘কৃত্রিম সংকট’, বিপাকে ডিলার-কৃষক সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে সারের ‘কৃত্রিম সংকট’

ঢাকা: দেশের প্রায় সমগ্র অঞ্চলেই সারের সংকট দেখা দিয়েছে। একইসঙ্গে বাড়ানো হয়েছে সারের দাম।

এতে কৃষকের এখন নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম। আমদানিকারকদের সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে সারের এই কৃত্রিম সংকট বলে অভিযোগ করছেন ডিলার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা।

তারা বলছেন, আমদানিকারকরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ডিলারদের সার সরবরাহ করতে গড়িমসি করছেন। এতে করে ডিলারদের সার পেতে ১৫ থেকে ২৫ দিন সময় বেশি লাগছে। ফলে তৃণমূলে সার সরবরাহে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে সারের কৃত্রিম সংকটের। এতে বিপাকে পড়ছেন ডিলার ও প্রান্তিক কৃষকেরা।

এক্ষেত্রে অভিযোগের তীর দেশের বৃহত্তর সার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান নওয়াপাড়া ট্রেডার্সের দিকে।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) কয়েকজন ডিলার অভিযোগ করে বলেন, সরকারি (জি টু জি) ও বেসরকারি দু’ভাবেই সার আমদানি করে প্রতিষ্ঠানটি। পরিবহন কাজ পরিচালনাও করছে এ প্রতিষ্ঠান তারা। এজন্য ১২টি প্রতিষ্ঠানকে নির্ধারণ করে দিয়েছে সার উত্তোলনের প্রতিনিধি হিসেবে। কেবল এই ১২ প্রতিষ্ঠানই সার উত্তোলন করতে পারবে, আর কেউ নয়। এই ১২ প্রতিষ্ঠানকে দিয়েই সার সরবরাহ করা হচ্ছে ডিলার প্রান্তে।

এভাবেই সিন্ডিকেট গড়ে সার সরবরাহে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে নওয়াপাড়া ট্রেডার্স।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব ডিলারের ভাষ্য, ‘ডিলারদের মানুষই মনে করে না আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। ইতঃপূর্বে প্রতিনিধির মাধ্যমে কাগজ পাঠালে সার উত্তোলন করা যেত। এখন আর সেটি করা যাচ্ছে না। এখন ভর্তুকির সার নিতে হলে ডিলারের নিজস্ব প্রতিনিধি মোকামে গিয়ে সার তুলতে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে দীর্ঘদিন নওয়াপাড়ায় অপেক্ষা করতে হয়, নানা ধরনের ভোগান্তি পোহাতে হয়। ডিসেম্বর মাসের সার উত্তোলনের জন্য ১২ ডিসেম্বর টাকা পাঠিয়েছি। সেই সার পেয়েছি ২ জানুয়ারি। তারা নিজস্ব পরিবহনের মাধ্যমে সার নিতে বাধ্য করছে। আমরা লোক পাঠালাম, টাকাও পাঠালাম, সারও পেলাম দেরিতে। ’

আমাদের টাকায় কেনা সার আমাদেরকে দিতে এত দেরি কেন-প্রশ্ন এসব ডিলারের।

ডিলারদের এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অনুসন্ধান করে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের আমলে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট বহাল তবিয়তে রয়েছে। এই সিন্ডিকেটের মূলহোতা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান নওয়াপাড়া গ্রুপ। তারা বিভিন্ন নামে সরকারের ভর্তুকির সার আমদানি করে। যেসব প্রতিষ্ঠানের নামে এলসি করেন তাদের মধ্যে সাইফুল্লাহ পাকোয়া, সাইফুল্লাহ গাল্ফ, ফায়াজ ট্রেডিং, দীপা এন্টারপ্রাইজ, সুফলা ট্রেডিং করপোরেশন অন্যতম। এসব নামে সরকারি সার বরাদ্দ হয়ে থাকে। আর সারা দেশের বৃহত্তম মোকাম নওয়াপাড়া বন্দর থেকে ডিলাররা উত্তোলন করে তাদের মোকামে নিয়ে যায়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নওয়াপাড়া ট্রেডার্স বর্তমানে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ডিলারদের সার সরবরাহ করতে গড়িমসি করছে। প্রতিষ্ঠানটি ডিলারদের কোনো প্রতিনিধির মাধ্যমে সার সরবরাহ করছে না। তারা বলছে, সার নিতে হলে ডিলারকে অবশ্যই নওয়াপাড়ায় এসে কাগজপত্র দিয়ে সার নিতে হবে। এতে করে ডিলাররা বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছে। অন্যদিকে কৃষি অফিসার ডিলারকে দ্রুত সার উত্তোলনের জন্য চাপ দিচ্ছেন। এতে করে ডিলাররা বিপাকে পড়েছেন।

ডিলার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বলছেন, নওয়াপাড়ায় আরও আমদানিকারক রয়েছেন। তাদের কাছ থেকে কোনো প্রকার ঝামেলা ছাড়াইসার উত্তোলন করা যাচ্ছে। শুধু নওয়াপাড়া ট্রেডার্সের কাছ থেকে ভর্তুকির সরকারি সার উত্তোলনের ক্ষেত্রে নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) রংপুর সদর উপজেলার এক ডিলার জানান, গত কয়েক বছর ধরে ভর্তুকির সার তুলতে সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আর এই অসুবিধা হচ্ছে শুধু আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান নওয়াপাড়া ট্রেডার্সের বরাদ্দ সার উত্তোলনের ক্ষেত্রে।

বাংলাদেশ রাসায়নিক শিল্প করপোরেশন বা বিসিআইসি ইউরিয়া সার সরবরাহ করে। আর এমওপি, ডিএপি ও টিএসপি সার সরবরাহ করে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন বা বিএডিসি।

কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে সরকারি (জি-টু- জি) চুক্তির আওতায় ৫৮২ কোটি ২৪ লাখ ১২ হাজার টাকা ব্যয়ে কাতার, সৌদি আরব ও মরক্কো থেকে তিন ক্যাটাগরির মোট এক লাখ টন সার আমদানির অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে ৩০ হাজার টন বাল্ক গ্র্যানুলার ইউরিয়া সার, ৪০ হাজার টন ডিএপি সার ও ৩০ হাজার টন টিএসপি সার রয়েছে।

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে গত ২ জানুয়ারি সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত ক্রয় কমিটির সভায় এ অনুমোদন দেওয়া হয়। সভায় শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে কাতার এনার্জি মার্কেটিং থেকে প্রতি টন ৩৫৪ দশমিক ৬৭ ডলার দরে ৩০ হাজার টন বাল্ক গ্র্যানুলার ইউরিয়া সার আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে মোট ১২৭ কোটি ৬৮ লাখ ১২ হাজার টাকা।  

এছাড়া সৌদি আরব এবং বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির আওতায় কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবের আলোকে সৌদি আরবের মা’ডেন থেকে প্রতি টন ৬১৭ ডলার দরে ৪০ হাজার টন ডিএপি সার আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৯৬ কোটি ১৬ লাখ টাকা।  

অন্যদিকে মরক্কোর ওসিপি নিউটিক্রপস এসএ থেকে প্রতি টন ৪৪০ ডলার দরে ৩০ হাজার টন টিএসপি সার আমদানিতে ১৫৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয় হবে।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) রাজশাহী, নাটোর ও কুষ্টিয়া অঞ্চলের ডিলারদের সঙ্গে কথা হলে সারের সংকটের বিষয়ে তারা বলেন, সরকারি ভর্তুকির সার আমরা আমদানিকারকের মাধ্যমে নিজস্ব মোকামে নিয়ে আসি। কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বরাদ্দ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার সত্যায়িত কাগজের মাধ্যমে প্রতিনিধির মাধ্যমে দেশের অন্যতম বৃহত্তম মোকাম নওয়াপাড়া থেকে আমরা এই ভর্তুকির সার উত্তোলন করে থাকি। তবে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান নওয়াপাড়া ট্রেডার্সের সিন্ডিকেটের কারণে সার পেতে মাস পেরিয়ে যায়। টাকা জমা দেওয়ার ১৫-২০ দিন পরে সার হাতে পৌঁছায়। অথচ প্রতিনিধির মাধ্যমে দুই-তিন দিনের মধ্যে ইতঃপূর্বে সার উত্তোলন করেছি। ডিসেম্বর মাসের বরাদ্দের সার উত্তরণের জন্য ১৫ ডিসেম্বর টাকা পরিশোধ করলেও সেই সার পেয়েছি ১ জানুয়ারি।

ডিলারদের এমন অভিযোগের বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. মনিরুজ্জামান বলেন, আমদানিকারকদের সিন্ডিকেটের কারণে ডিলারদের সার পেতে দেরি হচ্ছে -এই ধরনের অভিযোগ এর আগে পাইনি। তবে লিখিত বা মৌখিক অভিযোগ পেলে অবশ্যই তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ বিষয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও কৃষক দলের সাবেক সভাপতি শামসুজ্জামান দুদু বলেছেন, পতিত আওয়ামী স্বৈরাচারী সরকারের আমল থেকেই কৃষি ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট চলে আসছে। যা এখনও বিদ্যমান। এই সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে যত দ্রুত সম্ভব একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর হতে হবে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নওয়াপাড়া ট্রেডার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো. ফাইজুর রহমান বকুল বলেছেন, আমি দেশের বাইরে আছি। হাসপাতালে আছি। এখন কিছু বলতে পারব না। যা বলার রিয়াজ সাহেব (বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সচিব) বলবেন।

বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সচিব রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকারের যে বিপণন পদ্ধতি তাতে বলা আছে, সার নিতে যেকোনো জেলা থেকে ডিলার অথবা ডিলারের প্রতিনিধি বা প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মচারী আসতে পারেন। এর আগে যে প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপোর্ট করতো তাকেই নির্ধারণ করত সার উত্তোলনের জন্য। মূল বিষয় হলো আরো বেশি আস্থাশীল ও ট্রান্সপারেন্ট হওয়ার জন্য এটা করা হয়েছে।

পরিবহন সিন্ডিকেটের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, আমদানিকারকরা যদি কোনো ট্রান্সপোর্টকে নির্ধারণ করে দেন এটা অন্যায়, এটা করার কোনো সুযোগ নেই। ডিলার যাকে ইচ্ছা তাকে দিয়ে ট্রান্সপোর্ট করাতে পারবেন। এতে কোনো অসুবিধা নেই।

সার সরবরাহে দেরি হওয়ার অভিযোগ বিষয়ে এ নির্বাহী সচিব বলেন, যথাযথভাবে টাকা জমা দেওয়ার দুই দিনের মধ্যে ডিলারদের সার দিতে বাধ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান।

বাংলাদেশ সময়: ০৭২২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০২৫
টিএ/এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।