ঢাকা, সোমবার, ১৩ মাঘ ১৪৩১, ২৭ জানুয়ারি ২০২৫, ২৬ রজব ১৪৪৬

কৃষি

শুখসাগর পেঁয়াজ এবার দুঃখের হাতছানি দিচ্ছে মুজিবনগরের কৃষকদের

জুলফিকার আলী কানন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০২৫
শুখসাগর পেঁয়াজ এবার দুঃখের হাতছানি দিচ্ছে মুজিবনগরের কৃষকদের নষ্ট হয়ে যাওয়া পেঁয়াজ গাছ ও রোকরাল বালাইনাশক

মেহেরপুর: শুখসাগর পেঁয়াজ এবার দুঃখের হাতছানি দিচ্ছে মুজিবনগরের কৃষকদের। মানহীন কোম্পানি “মার্সাল এগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিমিটেডের নিম্নমানের য়োকরাল নামক বালাইনাশক (পেস্টিসাইড) পেঁয়াজ ক্ষেতে ব্যবহার করে পথে বসতে যাচ্ছেন উপজেলার অর্ধশতাধিক চাষি।

পাঁচ/ছয়দিন আগে কৃষকরা স্থানীয় সার কীটনাশক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে য়োকরাল নামক এই ছত্রাকনাশক (পেস্টিসাইড) কিনে তাদের জমির উঠতি পেঁয়াজের পচন রোধে ব্যবহার করেছিলেন।

শুক্রবার (২৪ জানুয়ারি) দুপুরে সরেজমিনে মুজিবনগরের নাজিরাকোনা গ্রামের নাগার মাঠসহ এলাকার বিভিন্ন মাঠে গিয়ে দেখা গেছে, এলাকার প্রায় অর্ধাশতাধিক কৃষকের পেঁয়াজ গাছ জমিতে নুয়ে পড়েছে। পেঁয়াজের কলি হলুদ হয়ে চুপসে যাচ্ছে। ডগা শুকিয়ে লুটিয়ে পড়ছে মাটিতে। পাশের জমির পেঁয়াজ গাছ বড় হয়ে গেলেও আক্রান্ত জমির পেঁয়াজ মাটির সঙ্গে নুয়ে রয়েছে।

এবারের শীত মৌসুমে এমন পরিস্থিতিতে পড়েছেন মুজিবনগর উপজেলার নাজিরাকোনা, শিবপুর, ভবরপাড়া, কেদারগঞ্জ, মানিকনগর গ্রামের অর্ধ শতাধিক কৃষক।  

তাদের অভিযোগ, স্থানীয় ব্যবসায়ীদের পরামর্শে পেঁয়াজের ছত্রাকজনিত রোগ থেকে বাঁচতে “মার্সাল এগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিমিটেডের নিম্নমানের য়োকরাল নামক বালাইনাশক (পেস্টিসাইড) প্রয়োগের পরেই এ অবস্থা হয়েছে পেঁয়াজ ক্ষেতের।  

স্থানীয় কৃষকের মতে, প্রায় অর্ধশত বিঘা জমির পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কয়েক লাখ টাকার ক্ষতি হতে পারে।

মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার নাজিরাকোনা গ্রামের পেঁয়াজ চাষি আবুল হোসেন জানান, বর্গা নেওয়া এক বিঘা জমিতে চাষ করছেন পেঁয়াজের। জানুয়ারি মাসের শুরুর দিকে পেঁয়াজ ক্ষেত ছত্রাকজনিত রোগ থেকে বাঁচাতে স্থানীয় ব্যবসায়ীর পরামর্শে “মার্সাল এগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিমিটেডের য়োকরাল নামক বালাইনাশক (পেস্টিসাইড) প্রয়োগ করেন। এর পর থেকেই পেঁয়াজের গাছ হলুদ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে। এমন অবস্থায় অসহায় হয়ে পড়েছেন তিনি।  
তিনি জানান, ইতোমধ্যে তার ৮০/৯০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। ধার দেনা করে এক বিঘা জমিতে পেঁয়াজের চাষ করেছেন তিনি। পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় চরম বিপদের মধ্যে আছেন। পেঁয়াজ বিক্রি করে এ বছর তার প্রায় আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা হতো বলে জানান তিনি।

এ বছর নাজিরাকোনা গ্রামের আফর আলী এক বিঘা জমিতে, আব্দুল আলীমের এক বিঘা, হাফিজুল ইসলামের এক বিঘা, অ্যাডভোকেট আব্দুল আলীমের এক বিঘা, শহিদুল ইসলামের এক বিঘা, জনি মণ্ডলের ৫ বিঘা জমির পেঁয়াজের মধ্যে ২ বিঘা জমিসহ এই গ্রামের প্রায় ১৫ জন কৃষকের প্রায় ৩০ বিঘা জমিতে এই ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করে সব পেঁয়াজ ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে।

শিবপুর গ্রামের কৃষক হিরন আলী বলেন, আমি প্রতি বছরই পেঁয়াজের চাষ করি। এ বছরও আমি তিন বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষ করেছি। এছাড়া আমার ভাই হাফিজুল ইসলামেরও তিন বিঘা এবং রকিবুল সর্দারের এক বিঘা জমির পেঁয়াজ ক্ষেতে এই কীটনাশকটি ব্যবহার করেছিলাম। আমাদের মাঠে আরও বেশ কয়েকজন পেঁয়াজ চাষির ক্ষেতে এই কীটনাশকটি স্প্রে করে পেঁয়াজের চারা এখন ধুঁকে ধুঁকে মরছে।

এছাড়া বল্লভপুর গ্রামের পেঁয়াজ চাষি জাহিদুল ইসলাম বলেন, আমিসহ এলাকার বেশ কয়েকজন চাষি পেঁয়াজ ক্ষেতে “মার্সাল এগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিমিটেডের য়োকরাল নামক বালাইনাশক (পেস্টিসাইড) প্রয়োগের পরেই ক্ষেতের এই অবস্থা হয়েছে।

নাজিরাকোনা গ্রামের আবুল হোসেন এবং হাফিজুল ইসলামই শুধু নন, এই উপজেলার কয়েকটি গ্রামের আরও অর্ধশতাধিক কৃষক একই পরিস্থিতে পড়েছেন। য়োকরাল নামের কীটনাশকটি ব্যবহার করার দুই-তিন দিন পর থেকেই পেঁয়াজের গাছগুলো শুকিয়ে যাওয়া শুরু করে। শেকড়ে পচন ধরে সব শেষ হয়ে গেছে। ধারদেনা করে আবাদ করা জমির ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন এসব কৃষক। এখন ওই কোম্পানির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ চান ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা।

কৃষকদের অনেকেই স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, কৃষি কর্মকর্তারা যদি মাঠে আসতেন, পরামর্শ দিতেন, তাহলে এ অবস্থা হতো না।

এদিকে কীটনাশক কোম্পানির নাজিরাকোনা গ্রামের সার ও কীটনাশক ব্যবসায়ী আব্দুল জুব্বার জানান, “মার্সাল এগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিমিটেডের য়োকরাল ব্যবহারের পর এ রকম অভিযোগ আসছে সব জায়গা থেকে।  

তিনি বলেন, ইতোমধ্যে, ওই কোম্পানির স্থানীয় ডিলার ও কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মাঠে এসে কৃষকদের ফসলের নমুনা সংগ্রহ করেছেন। তারা ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

কীটনাশক ব্যবসায়ী ও “মার্সাল এগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিমিটেডের ডিলার দানা মেম্বর বলেন, ‘শীতের সময় পেঁয়াজ ক্ষেতে ছত্রাকের আক্রমণ বাড়ে। তাই আমার কাছে যারা কীটনাশক নিতে আসেন, তাদের “মার্সাল এগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিমিটেডের য়োকরাল নামক কীটনাশক দেই। তবে যাদেরই ওই কীটনাশক দিয়েছি, তাদেরই ক্ষেতে সমস্যা হয়েছে। আমি কোম্পানির প্রতিনিধিকে জানাইছি। তারা এসে ওই কীটনাশক নিয়ে গেছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। ’

“মার্সাল এগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিমিটেডের টেরিটরি অফিসার আসাদুল ইসলাম বলেন, এখন পর্যন্ত আমার কাছে এলাকার ২০ জন কৃষক তাদের ৩৩ বিঘা জমির পেঁয়াজ ক্ষেত নষ্ট হয়েছে বলে অভিযোগ দিয়েছেন। আমি বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানালে কোম্পানির প্রধান কার্যালয় থেকে কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এলাকায় সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন। ক্ষতিগ্রস্ত পেঁয়াজ চাষিদের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং পেঁয়াজের স্যাম্পল পরীক্ষার জন্য নিয়ে গেছেন।
কৃষি কর্মকর্তা ডিডি বিজয় কৃষ্ণ হালদার বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। আমাদের কাছে কৃষকেরা অভিযোগ করেনি। এসময় তিনি এ প্রতিবেদককে উল্টো প্রশ্ন করেন- কৃষকরা কার পরামর্শে এসব কীটনাশক জমিতে প্রয়োগ করেন আমাকে বলতে পারেন? 

কীটনাশকের দোকান পরিদর্শন করে মাসে অন্তত দুটি নমুনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ে (প্লান্ট প্রটেকশন) পাঠানোর কথা সংশ্লিষ্ট কৃষি কর্মকর্তাদের, এটা পাঠানো হয় কিনা। এমন প্রশ্ন করা হলে- তিনি বলেন, এটা উপজেলা কৃষি অফিসের দায়িত্ব আমার না। উপজেলা কৃষি অফিসার আপনার আয়ত্বের মধ্যে পড়ে কিনা প্রশ্ন করা হলে তিনি প্রতিবেদকের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, এ ধরনের প্রশ্ন করলে আমার সঙ্গে কথা বলবেন না। বলেই কলটি কেটে দেন এই কৃষি কর্মকর্তা।

এদিকে হাতে গোনা কয়েকটি কীটনাশক কোম্পানি ছাড়া অধিকাংশ মানহীন বালাইনাশকের (পেস্টিসাইড) কারণে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন এলাকার কৃষকরা। আবার ডিলারনির্ভর ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত মুনাফার আশায় মানহীন বালাইনাশক (পেস্টিসাইড) ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে কৃষকদের মাঝে বিপণন করছেন।

দোকান পরিদর্শন করে সংশ্লিষ্ট কৃষি কর্মকর্তাকে মাসে অন্তত দুটি নমুনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ে (প্লান্ট প্রটেকশন) পাঠানোর কথা বলা হলেও সে নিয়মের পথে হাঁটছেন না কৃষি অফিস।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফসল আবাদের পরিধি ও ধরন বদলে গেছে। বেড়েছে ফসলের জন্য ক্ষতিকর রোগজীবাণু ও কীটপতঙ্গ। এসব দমনে কৃষক বালাইনাশকের ব্যবহারও বাড়িয়েছেন। আর এই সুযোগে কোম্পানিগুলো কাটছে কৃষকের পকেট। কৃষিতে কীটনাশক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে শক্ত নজরদারি দরকার বলে মনে করেন তারা।

বাংলাদেশ সময়: ১১৪২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০২৫
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।