ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কৃষি

মেঘনার চরে হাঁসের বিপ্লব

মাসুক হৃদয়, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩২ ঘণ্টা, এপ্রিল ৫, ২০১৬
মেঘনার চরে হাঁসের বিপ্লব ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চরসোনারামপুর (আশুগঞ্জ) ঘুরে এসে: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জের ভৈরবের মধ্যবর্তী স্থানে মেঘনা নদীর বুকে জেগে ওঠা চরের নাম চরসোনারামপুর।

এই চরের জনবসতি প্রধানত মাছ শিকারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।

কিন্তু দূর-দূরান্ত থেকে আসা খামারিরা মেঘনার এই চরে গড়ে তুলেছেন হাঁসের খামার।

এই চর ছাড়াও মেঘনার মোহনায় জেগে ওঠা নবীনগর, আশুগঞ্জ ও সরাইল উপজেলার বিভিন্ন চরে রীতিমতো হাঁসের বিপ্লব ঘটিয়েছেন কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম, ইটনা, নিকলী, মিঠামইন ও হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসা খামারিরা।

চরের চারপাশের পানিতে এখন ভেসে বেড়ায় অসংখ্য হাঁস। মেঘনার ঢেউয়ে তাল মিলিয়ে হাঁসের হেলে-দুলে ভেসে বেড়ানোর দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয় সবাই।
জানা যায়, মেঘনা তীরবর্তী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার বাইশমৌজা, আশুগঞ্জের লালপুর ও সরাইলের পানিশ্বর এলাকার ছোট-বড় চরে গড়ে তোলা হয়েছে অর্ধশতাধিক হাঁসের খামার। শুধুমাত্র আশুগঞ্জের চরসোনারামপুরে রয়েছে ২৩টি হাঁসের খামার। এসব খামারে বর্তমানে ২৫ হাজারেরও বেশি হাঁস রয়েছে।  
যেভাবে শুরু:
প্রায় আট/১০ বছর ধরে চরসোনারামপুরে হাঁসপালন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। নিকলী উপজেলার মরকোনা গ্রামের করিম মিয়া প্রথমে এই চরে হাঁসের খামার গড়ে তোলেন। পরে তার দেখাদেখি ওই গ্রামের আরও আটজন চরসোনারামপুরে হাঁসের খামার করেন। পরে লোকমুখে এই চরের নাম ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের এলাকায়। এভাবে অষ্টগ্রাম, ইটনা, মিঠামইন ও লাখাই উপজেলা থেকে খামারিরা চরসোনারামপুরে এসে খামার করেন।
যে কারণে জনপ্রিয়:
আশুগঞ্জের এই চরের চারপাশ পানি বেষ্টিত থাকায় হাঁস পালনের জন্য অনুকূল একটা পরিবেশ বছর জুড়েই থাকে। আর এই চরে হাঁসের খাবারেরও সহজলভ্যতা রয়েছে। চরে বসবাসরত জেলে পরিবারের অন্তত ৪০ জন নদী থেকে মাছ ধরার পাশাপাশি শামুক তুলে এনে খামারিদের কাছে বিক্রি করে থাকেন।

শামুক বিক্রেতা ফালু চন্দ্র দাস জানান, কার্তিক মাস থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত তারা শামুক তোলেন। প্রতি বস্তা শামুক ১৩০/১৪০ টাকায় বিক্রি করেন খামারিদের কাছে। শামুক বিক্রি করে প্রতিদিন তাদের হাজার টাকারও বেশি আয় হয়।

খামারিদের ভাষ্য, আশুগঞ্জে বড় ধানের মোকাম থাকায় সারাবছরই ধান পাওয়া যায়। খাবারের পর্যাপ্ততা ও সহজলভ্যতার কারণে দ্রুত বেড়ে উঠে হাঁস। ডিমও দেয় বেশি। তাছাড়া নদীর দুই তীরে দুই উপজেলা শহর থাকায় ডিম বিক্রি থেকে শুরু করে সব কাজেই সুবিধা পাওয়া যায়।

নিকলী উপজেলার মরকোনা গ্রামের শামীম মিয়ার খামারে কাজ করেন তারই চাচাতো ভাই হৃদয় মিয়া।

হৃদয় মিয়া বাংলানিউজকে জানান, তাদের খামারে এক হাজার হাঁস রয়েছে। এর মধ্যে ১৫/২০টি পুরুষ হাঁস। প্রতিদিন প্রায় ৯শ’ হাঁস ডিম দেয়। ভোরে টিন আর নেটে ঘেরা খামারের নিচের দিকটা ডিমে সাদা বর্ণ ধারণ করে।

একই চরে হবিগঞ্জের লাখাই উপেজেলার শিবপুর গ্রামের ফরিদ মিয়ার খামারে ১১৬০টি হাঁস ছিল। প্রথমে সাড়ে চার লাখ টাকার হাঁসের বাচ্চা কিনে এই খামার গড়ে তুলেছিলেন তিনি। পরে মওসুম শেষে হাঁস ও ডিম বিক্রি হয়েছে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকার।

খাবার-দাবার সহজে মিললেও সবই কিনে নিতে হয়। তা না হলে লাভটা আরও বেশি হতো। তাছাড়া কয়েক মওসুম গেলে হাঁসের দাম কমে যায় বলেও জানান তিনি।  

চরেসানারামপুরে গিয়ে দেখা যায়, নদী তীরের বালু চরে বাঁশের খুঁটি ও জালের বেড়া দিয়ে হাঁসের ঘর তৈরি করা হয়েছে। রাতে এসব ঘরে হাঁস থাকে। প্রতিটি খুপড়ির কাছেই তৈরি করা হয়েছে বাঁশের মাচা। যেখানে রাত কাটান খামারিরা। আর দিনের বেলায় হাঁসের বিচরণ ও খাবারের জন্য নদীর তীরেই জালের বেড়া দিয়ে ঘর তৈরি করা হয়েছে।

ডিম-হাঁস বিক্রিতে আয়:
চরের খামারিরা জানান, প্রতিদিন সকালে খামার থেকে ডিম সংগ্রহ করে নৌকায় করে ভৈরব ও আশুগঞ্জ বাজারে আড়তদারদের কাছে বিক্রি করা হয়।

খামারি ফরিদ মিয়া জানান, প্রতিদিন তার ডিম বিক্রি করে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা আয় হয়। আর দুই/তিন মওসুম পরে পুরনো হাঁসগুলো বিক্রি করে আবার বাচ্চা হাঁস কিনে খামারে তোলা হয়। প্রতিটি হাঁস গড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা দরে বিক্রি হয়।

খামারিদের যতো সমস্যা:

কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম উপজেলার আব্দুল্লাহপুর গ্রাম থেকে আসা খামারি গফুর মিয়া, একই গ্রামের আক্তার মোল্লা, রোকন মিয়া, আদমপুর গ্রামের হক মিয়া, নিকলী উপজেলার দামপাড়ার ইয়াছিন মিয়া, মরকোনা গ্রামের করিম মিয়া ও কাঞ্চন মিয়া জানান, বারো মাসই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাঁস মারা যায়। কিন্তু চরে কখনোই পশু চিকিৎসক আসেন না। ফলে পরামর্শের জন্য তাদের সমস্যায় পড়তে হয়। তাছাড়া সরকারিভাবে সরবরাহ করা কমদামি ভ্যাকসিনও তারা পান না। বাধ্য হয়ে বাইরের ফার্মেসি থেকে বেশি দামে কিনতে হয় ভ্যাকসিন।

পুঁজির অভাব:
অনেক খামারি পুঁজির সমস্যার কথাও বললেন। তারা জানান, ব্যাংক থেকে তারা কখনোই ঋণ পাননি। বাধ্য হয়েই স্থানীয় আড়তদারদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করতে হচ্ছে। ফলে আশানুরূপ লাভের মুখ দেখতে পান না তারা। লাভ চলে যায় আড়তদারের পেটে।

তারা সহজ শর্তে ঋণ দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

যা বললেন প্রাণিসম্পদ বিভাগ:

খামারিদের বিভিন্ন সমস্যার ব্যাপারে জানতে চাইলে আশুগঞ্জ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আছির উদ্দিন বলেন, আমাদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণে ডাকপ্লেগ-এর ভ্যাকসিন রয়েছে। বিগত চার মাসে ১২ হাজারেরও বেশি ভ্যাকসিন বিতরণ করা হয়েছে। কিন্তু চরসোনারামপুরের খামারিরা আমাদের কাছে কম আসেন। ভৈরবের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বেশি।

বাইরের ফার্মেসি থেকে ভ্যাকসিন কেনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আশুগঞ্জে এমনটি হওয়ার কথা নয়। এ রকম প্রমাণ দেখাতে পারলে ওইসব ফার্মেসিকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা করা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৫, ২০১৬
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।