ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কৃষি

মধ্যসত্ত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে ধানের ন্যায্যমূল্য বঞ্চিত কৃষক

শামীম হোসেন, সিনিয়র নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০০৩ ঘণ্টা, মে ২২, ২০১৬
মধ্যসত্ত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে ধানের ন্যায্যমূল্য বঞ্চিত কৃষক ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ। আবহাওয়া অনুকূলে থাকার কারণে বাংলাদেশে তিন মৌসুমে (আমন, বোরো, ইরি) ধান চাষ হয়।

এখন বোরো মৌসুমের ফসল কৃষকের ঘরে উঠেছে। এবার বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হওয়ায় বোরো ধানের ফলন ভাল হয়েছে।

ধানের ‘বাম্পার’ ফলন হলেও ন্যায্য দর পাওয়া নিয়ে অনেকটাই শঙ্কিত কৃষক। বিশেষ করে বোরো ধানের দরপতন উত্তরাঞ্চলের ৪৩ লাখ কৃষকের মুখের হাঁসি ম্লান করে দিয়েছে। মাঠে সোনালী ফসলের দোল দেখে কৃষকের চোখে-মুখে যে হাসি ফুটে উঠছিল, ধান পাকার পর থেকে অজানা শঙ্কা ভর করে কৃষকের মনে।

বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি এখনো কৃষিনির্ভর। যে কারণে কৃষকের প্রধান ফসল ধানের দরপতনে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিরুপ প্রভাব পড়ে।

প্রতি বিঘা জমিতে ধান চাষ করতে খরচ হয় ১২ থেকে সাড়ে ১২ হাজার টাকা। আর বিঘা প্রতি ধান উৎপাদন হয় ২০ থেকে ২২ মণ। উৎপাদন থেকে শুরু করে ধান কাটা, মাড়াই সব মিলিয়ে যে খরচ হয়েছে বিক্রি করতে গিয়ে সে খরচও উঠছে না। ধানের এমন দরে হতাশ কৃষকরা।

এ বছরও সরকারিভাবে ৫ মে থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশ থেকে ১৩ লাখ মেট্রিক টন ধান-চাল সংগ্রহের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ধান ৭ লাখ এবং চাল ৬ লাখ মেট্রিক টন। কৃষকদের কাছ থেকে ২৩ টাকা দরে ধান কেনার ঘোষণাও দিয়েছে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ।

তবে অনেক জেলায় সরকার নির্ধারিত দামে কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযানের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র উত্তরাঞ্চলে এ অভিযোগ বেশি।  

উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন বাজার থেকে পাওয়া তথ্য মতে, বোরো মৌসুমের ধান মণ বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। আবার ধানের জাত ভেদে দাম ৫শ থেকে সাড়ে ৫শ টাকাও পাওয়া যাচ্ছে।
 কিন্তু এতেও উৎপাদন খরচ উঠছে না।  
 
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকার নির্ধারিত দামে ধান বিক্রি করতে সরাসরি গুদামে গেলে সংশ্লিষ্টরা কৃষকের কাছ থেকে ক্রয় করতে অনিহা প্রকাশ করছেন। এজন্য বাধ্য হয়ে কম দামে অন্যত্র বিক্রি করতে হচ্ছে। কৃষকদের দাবি, সরকার ঘোষিত দামে ধান ক্রয়ের ক্ষেত্রে অনিয়মগুলো যদি দূর করা যায় তাহলে ক্ষতি অনেকটাই পুষিয়ে নেওয়া যেত।

প্রতিবছর উত্তরাঞ্চলে থেকে সবচেয়ে বেশি ধান-চাল সংগ্রহ করা হয়। এ অঞ্চলের কৃষকদের অভিযোগ, মিল মালিকদের কারসাজিতে ন্যায্য মূল্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। কৃষকদের বিভিন্ন ভাবে জিম্মি করে মিল মালিকরা কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য করেন। এর মধ্যে আবার অনেক কৃষক ধান উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন মিল মালিক ও এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতেও বাধ্য হন। এজন্য মৌসুমের ধান ঘরে তোলার সঙ্গে সঙ্গে তা বিক্রি করে ঋণের টাকা শোধ করার একটা তাড়া থাকে। এতে লোকসান হলেও বিক্রি করতে বাধ্য হন প্রান্তিক কৃষকরা।  

রাজশাহী ও রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, উত্তরাঞ্চলে ১৬ জেলায় এবার প্রায় ১৮ লাখ ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। হেক্টর প্রতি ধানের ফলন চার দশমিক পাঁচ ও চালের ফলন ২ দশমিক ৭ মেট্রিক টন ধরা হয়েছে। সে হিসাবে এবছর উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় (পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর, নীলফামারী, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, জয়পুরহাট, নওগাঁ, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী) ৮১ লাখ ৬৭ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন ধান ও ৪৯ লাখ ৫০০ মেট্রিক টন চাল উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে।

উত্তরাঞ্চলে ৫৫ লাখ ৭৩ হাজার ৮৮টি কৃষি পরিবার রয়েছে। এর মধ্যে রাজশাহী বিভাগে ২৯ লাখ ৯৮ হাজার ৩৬৫টি এবং রংপুর বিভাগে ২৫ লাখ ৭৫ হাজার ৫১৬টি। ভূমিহীন কৃষি পরিবার রয়েছে ১৬ লাখ ৩৪ হাজার ৩৮৭টি, প্রান্তিক চাষি পরিবার ২০ লাখ ৭৫ হাজার ৫১৬, ক্ষুদ্র চাষি পরিবার ১০ লাখ ৫৫ হাজার ৩২২, মাঝারি চাষি পরিবার ছয় লাখ ৫৫ হাজার ৬৬৬টি ও বড় কৃষি পরিবার এক লাখ ৫২ হাজার ৫৭৫টি।

এবার রংপুর জেলায় এক লাখ ৩৩ হাজার ২৫ হেক্টর জমিতে ধান চাষ করেছে কৃষকরা। ফলন ভাল হওয়ায় কৃষকের মুখে সুখের হাসি ফুটলেও দাম কম থাকায় সেই হাসি মলিন হয়ে গেছে। কৃষকরা বলছেন হাইব্রোট ধান,২৯ ধান, ৫৮ ধান,২৮ ধানে এবারে ভাল ফলন হয়েছে।

বদরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের কৃষক মমিনুল। তিনি ১৭ বিঘা (৬০ শতাংশে) জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছেন। ফলনও হয়েছে বাম্পার। কিন্তু তার মন ভালো নেই। কারণ ধানের দাম কম, বাজার মন্দা। শুধু মমিনুল নন, তার মতো এলাকার অনেক কৃষকের মাথায় হাত পড়েছে উৎপাদিত ধানের চিন্তায়।

রংপুর অঞ্চলের বাজারগুলোতে ধান প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ৩৬০ টাকায় (২৮ কেজিতে ১ মণ)। বিঘা প্রতি উৎপাদন খরচ ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা। সে হিসাবে বিঘা প্রতি মমিনুলের ৬ হাজার টাকা লোকসান হচ্ছে।

এরকম লোকসান হতে থাকলে ধান চাষ করা কমিয়ে দিতে বাধ্য হবে বলেও জানান তিনি।

বদরগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, এবার বোরো মৌসুমে ১৭ হাজার ৪২৫ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়েছে। এর মধ্যে উফসি-১৩২২৫ হেক্টর ও হাইব্রিড-৪২০০ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূল থাকায় ফলনও হয়েছে বাম্পার।
 
উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের মাষানডোবা খিয়ারপাড়া গ্রামের কৃষক নওশাদ আলী বলেন, একবিঘা জমি আবাদ করতে খরচ হয় প্রায় সাড়ে ১২ হাজার টাকা। অথচ ধানের দাম মণ প্রতি ৩৬০ টাকা। ৫০০ টাকা করে হলেও ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে যেতো।

তিনি অভিযোগ করেন, সরকারি খাদ্যগুদামে আমাদের মতো প্রান্তিক কৃষকরা ধান দিতে পারে না। আমরা ধান নিয়ে গেলে যে কোনো অজুহাতে খাদ্যগুদাম কর্তৃপক্ষ আমাদের বিদায় করে দেয়।

তার এই অভিযোগের বিষয়ে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক এনাম‍ুল হকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কৃষি অফিসের মাধ্যমে প্রকৃত কৃষকদের তালিকা নিয়ে ধান গুদামজাত করা হয়। চলতি মৌসুমে তালিকাভূক্ত কৃষকদের কাছ থেকেই ধান সংগ্রহ করা হচ্ছে।

তবে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হলেও দাম কিছুটা কম থাকায় কৃষকের লোকসান গুণতে হচ্ছে বলে স্বীকার করেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহবুবর রহমান।

দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে এক লাখ ৭৩ হাজার ৬৫১ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে উপশী জাতের ধান ১ লাখ ৫১ হাজার ৬৬৫ হেক্টর জমিতে ও হাইব্রিড জাতের ধান ২১ হাজার ৯৮৬ হেক্টর জমিতে চাষ করা হয়েছে।

এবার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ লাখ মেট্রিক টন ধান। এরমধ্যে উপশী জাতের ধান প্রতি হেক্টর জমিতে ৩ দশমিক ৮২ মেট্রিক টন ও হাইব্রিড জাতের ধান প্রতি হেক্টরে ৪ দশমিক ৭৫ মেট্রিক টন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।  

নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূ্ত্রে জানা গেছে, এবছর জেলায় প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ১৪ লাখ মেট্রিক টন। যা গত বছরের তুলায় প্রায় ৫০ হাজার মেট্রিক টন বেশি।  

জেলার ১১ উপজেলায় শুধু জিড়া শাইল জাতের ধানের আবাদ হয়েছে প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে। এ জাতের ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ৮ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন।

চলতি মৌসুমে প্রতি বিঘায় জিড়া শাইল জাতের ধানে ফলন পাচ্ছেন ২০ থেকে ২২ মণ। হিরা ও পারিজা জাতের ধানে ২৪ থেকে ২৫ ও হাইব্রিড ২৯ জাতের ধানের ফলন পাওয়া যাচ্ছে বিঘাপ্রতি ২৭ মণ পর্যন্ত।

নওগাঁর সাপাহার, পোরশা ও নিয়ামতপুর এলাকার বর্গাচাষিদের এবার এক বিঘা জমিতে বোরো চাষ করতে সেচ, হাল, শ্রমিক, সার ও বীজসহ মোট খরচ গুণতে হয়েছে প্রায় ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা। কিন্তু ধান ঘরে তুলে সব বিক্রি করেও সেই উৎপাদন খরচ উঠছে না।  

কৃষকদের অভিযোগ, সরকার তাদের কাছ থেকে সরাসরি যদি ধান সংগ্রহ করতো তাহলে লোকসান হতো না। গুদাম মালিকরা কৃষকদের কাছ থেকে না কিনে মিল মালিকদের কাছে থেকে কিনছেন।  

প্রতি মৌসুমেই বাজারে জিড়া জাতের ধানের চাহিদা থাকে বেশি। কিন্তু এবার মৌসুমের শুরু থেকেই সেই ধানের বাজার দর কম। চলতি বাজারে প্রতি মণ জিড়া ধান বিক্রি হচ্ছে ৬২০ থেকে ৬৩০ টাকায়। এছাড়া অন্যান্য জাতের ধান বিক্রি হচ্ছে ৫৩০ থেকে ৫৪০ টাকা মণ ধরে।  

ধানের এ দরপতনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রান্তিক চাষিরা। বোরো ধানের দরপতনে কৃষকরা হতাশা প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ পেশা পরিবর্তনেরও কথা ভাবছে। এরই মধ্যে অনেকে ধান চাষ বাদ দিয়ে অধিক লাভজনক ফসল চাষের দিকে ঝুঁকছে।

এদিকে ধানের দাম কম থাকায় এর প্রভার চালের বাজারে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রতি মণ বোরো ধানে কৃষক লোকসান দিচ্ছে ২০০ টাকা। ফলে কৃষকরা কাঙ্খিত দাম না পেয়ে অনেকটা দিশেহারা।  

এ দরপতনের পেছনে কেউ কেউ সরকারের ক্রয়নীতিকে দায়ী করছে। ধান সংগ্রহের ক্ষেত্রে সঠিক মনিটরিং ও নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এমনটা হচ্ছে। ফলে কৃষক তার ন্যায্য দাম পাচ্ছে না, কিন্তু এক শ্রেণীর দালাল বা মধ্যসত্ত্বভোগীরা সুবিধা নিচ্ছেন।  

কৃষকদের আরও অভিযোগ, এবারের বোরো মৌসুমের দরপতন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এক শ্রেণীর দালালরা বাজারে দরপতন ঘটিয়ে কৃষকদের গোলা শূন্য করে পরে তারা বেশি দামে বিক্রি করবে।

বাংলাদেশ সময়: ২০০৩ ঘণ্টা, মে ১৮, ২০১৬
এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।