ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কৃষি

ধান বেচতে সরকারের নাগাল পান না চাষি

আসাদ জামান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮১৫ ঘণ্টা, মে ২৬, ২০১৬
ধান বেচতে সরকারের নাগাল পান না চাষি ছবি-বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: ধান-চাল সংগ্রহে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে এবারের বোরো মৌসুমে কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ৭ লাখ মেট্রিক টন ধান কেনার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার।  

 

ধারণা করা হয়েছিল, সরকারের এ উদ্যোগে ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্য কমবে।

আর্থিকভাবে লাভবান হবেন সাধারণ কৃষকরা। কিন্তু ধান বেচতে সরকারের নাগাল পাচ্ছেন না তারা।
 
মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে জানা গেছে, উৎপাদিত ধানের মাত্র ৫ শতাংশ কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় খুবই অল্প সংখ্যক কৃষক সরকারের কাছে ধান বিক্রির সুযোগ পাবেন।

 
অনেক কৃষক আবার জানেনই না যে, কোথায়-কিভাবে সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে হয়। কোনো কোনো এলাকায় আবার ধান ক্রয়কেন্দ্রই স্থাপন করেনি সরকার। বেঁধে দেওয়া শর্ত পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় অনেকেই আবার সরকারের কাছে ধান বিক্রির সুযোগ পাবেন না।
 
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এবারের বোরো মৌসুমে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ কোট ৩৫ লাখ মেট্রিক টন ধান। এখান থেকে মাত্র ৭ লাখ মেট্রিক টন ধান কিনবে সরকার। আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ধান সংগ্রহ অব্যাহত থাকবে।
 
বাকি ১ লাখ ২৮ হাজার মেট্রিক টন ধানের মধ্য থেকে নিজেদের খাবার অংশটুকু রেখে পুরোটাই ফড়িয়া, মহাজন, ব্যবসায়ী বা চাতাল মালিকদের কাছে বিক্রি করতে হবে কৃষকদের। যদিও গত মৌসুমের তুলনায় এবার সাতগুণ বেশি ধান কিনছে সরকার। ধানের দামও কেজি প্রতি বাড়ানো হয়েছে ১ টাকা।
 
সরকারের হিসাব মতে, এ বছর প্রতি কেজি ধানের উৎপাদন খরচ পড়েছে ২০ টাকা ৭০ পয়সা। সেই হিসেবে ২৩ টাকা দরে ধান কিনলে কৃষকের লাভ হবে কেজিপ্রতি ২ টাকা ৩০ পয়সা।

 
কিন্তু সরকারের এই ‘সাদামাটা’ হিসাব অনেকটা কেতাবি ও নথিভিত্তিক হিসাব হয়েই থাকছে। কারণ, উৎপাদিত ধানের ৫ শতাংশের দায় নিচ্ছে সরকার। বাকি ৯৫ শতাংশ ধান নিয়ে কৃষক পড়েছেন বিপাকে।
 
দায়-দেনা মেটাতে উৎপাদন খরচের সমান টাকায়, ক্ষেত্র বিশেষ লোকসান দিয়ে ধান বিক্রি করছেন তারা। সরকার যে লাভের হিসাব দেখিয়েছে, তার ধারের কাছে পৌঁছাতে পারছেন না প্রান্তিক কৃষকরা।
 
সরকার এবার প্রতি মণ ধান কিনছে ৯২০ টাকায়। কিন্তু যেসব কৃষক সরাসরি সরকারের কাছে ধান বিক্রির সুযোগ পাচ্ছেন না, তারা ফড়িয়া, সাধারণ ব্যবসায়ী, চাতাল মালিক ও মহাজনদের কাছে গড়ে সাড়ে ৫শ’ টাকা থেকে সাড়ে ৬শ’ টাকা মণ দরে ধান বিক্রি করছেন। অর্থাৎ সরকার নির্ধারিত মূল্য থেকে কৃষক গড়ে কম পাচ্ছেন মণপ্রতি ৩শ’ থেকে সাড়ে ৩শ’ টাকা।
 
চুয়াডাঙ্গা জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. আব্দুল ওয়াহেদ বাংলানিউজকে বলেন, সরকার তো আর সব ধান কিনতে পারবে না। বাজার দরের ওপর একটা প্রভাব বিস্তারের জন্য ধানের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। বেঁধে দেওয়া মূল্যে আমরা যেমন কিনছি, বেসরকারি উদ্যোক্তারাও যদি সেই মূল্যে কিনতেন, তাহলে কৃষকের সমস্যা হতো না।

 
এদিকে বেঁধে দেওয়া কিছু শর্ত ও প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে সাধারণ কৃষক সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে পারছে না।
 
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ১৪ শতাংশের বেশি আর্দ্রতা থাকলে কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনবে না সরকার। গুদামজাত করার জন্য ধানে আর্দ্রতা থাকতে হবে ১৪ শতাংশের নিচে।
 
ধানে ভিন্ন জাতের মিশ্রণ থাকতে পারবে মাত্র ৮ শতাংশ। এর চেয়ে বেশি মিশ্রণের ধান সরকারের ক্রয় নীতিমালার বাইরে।
 
ধানে বিজাতীয় পদার্থ থাকতে পারবে মাত্র দশমিক ৫ শতাংশ। চিটাও থাকতে পারবে দশমিক ৫ শতাংশ। অপুষ্ট ও বিনষ্ট ধান থাকতে পারবে মাত্র দশমিক ২ শতাংশ।
 
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারের বেঁধে দেওয়া এই শর্তগুলো পূরণ করা কৃষকের জন্য প্রায় অসম্ভব। যেহেতু মেঘ-বৃষ্টির মৌসুমে বোরো ধান কাটা শুরু হয়, সেহেতু ধানের আর্দ্রতা ১৪ শতাংশের নিচে নিয়ে আসা অর্থাৎ টাটকা রোদে শুকিয়ে ঝরঝরা করা কঠিন।
 
খাদ্য পরিদর্শক লিটন কুমার বিশ্বাস বাংলানিউজকে বলেন, সাধারণত এ ব্যাপারে কৃষককে কিছুটা ছাড় দেওয়া হয়। সরকারের ক্রয়কেন্দ্রগুলোতে ধান শুকানোর ব্যবস্থা থাকে। কৃষক তার উৎপাদিত ধান ক্রয়কেন্দ্রে এনে ভালো করে শুকিয়ে বিক্রি করে যেতে পারেন।
 
এদিকে কেউ চাইলেই সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে পারবেন না। কিছু প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে এগোতে হবে।

 
সূত্র মতে, যাদের কাছে কৃষক সহায়তা কার্ড আছে এবং যাদের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে, তারাই কেবল সরকারের কাছে ধান বিক্রির সুযোগ পাবেন। কারণ, কৃষকের ধানের মূল্য ব্যাংক চেকের মাধ্যমে পরিশোধ করবে সরকার। অধিকতর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতেই এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
 
গাইবান্ধা জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আমজাদ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, অনেক সময় অভিযোগ করা হয়, কিছু সিলেক্টেড ব্যক্তির কাছ থেকে আমরা ধান কিনি। এতে করে প্রকৃত কৃষক ধানের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন। এ অভিযোগ থেকে বের হয়ে আসার জন্যই সরকার এবার নতুন নীতিমালা করেছে। যারা প্রকৃত কৃষক, যাদের কাছে কৃষক সহায়তা কার্ড আছে এবং যারা ১০ টাকা দিয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলেছেন, তারাই কেবল সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে পারবেন। এতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৮০৭ ঘণ্টা, মে ২৬, ২০১৬
এজেড/এএসআর

**বীজ থেকেই শুরু ধানের দুঃখ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।