ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কৃষি

সৌদির সাম্মাম চাষ হচ্ছে কুষ্টিয়ায়

মো. জাহিদ হাসান জিহাদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৩৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৭, ২০২১
সৌদির সাম্মাম চাষ হচ্ছে কুষ্টিয়ায় গাছে ঝুলন্ত “সাম্মাম”। ছবি: বাংলানিউজ

কুষ্টিয়া: করোনাকালে বন্ধ রয়েছে কলেজ। তাই মেস থেকে বাড়ি ফিরে অলস সময় কাটাচ্ছিলেন কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী নাঈম ইসলাম খোকন।

 
 
বাড়িতে বসে না থেকে আধুনিক কৃষি কাজ করার ইচ্ছা জাগে তার। প্রবাসী বড় ভাইয়ের পরামর্শে সৌদি আরবের ফল “সাম্মাম” চাষ করার উদ্যোগ নেন তিনি। পরে ইন্টারনেট ও কৃষি অফিসের পরামর্শে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করেছেন তিনি। প্রথমবার চাষেই বেশ সাফল্য পেয়েছেন।

কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার কচুবাড়ীয়া গ্রামের তরুণ কৃষি উদ্যোগতা নাঈম প্রথম ৩৩ শতাংশ জমি বর্গা নিয়ে এ চাষ করেছেন।

পুষ্টিগুণে ভরপুর বিদেশি এ ফল চাষাবাদের তেমন একটা প্রচলন নেই দেশে। সাম্মাম চাষে ঝুঁকি এবং চাষাবাদ সম্পর্কে প্রচারণার অভাবে চাষ কম হয়।

ভিনদেশি রসালো ফল উৎপাদনের খবরে প্রতিদিন তার ক্ষেত দেখতে আসছেন আশপাশের কৃষকরা। কেউ কেউ আগামীতে এ ফল উৎপাদনের জন্য পরামর্শও নিচ্ছেন নাঈমের কাছ থেকে।

রোববার (২৫ এপ্রিল) দুপুরে নাঈমের ক্ষেত্রে গিয়ে দেখা যায়, তিনি তার সাম্মাম ক্ষেত পরিচর্যা করছেন। কুমড়া গাছের মতো লতানো গাছ। গাছের ফাঁকে ফাঁকে ঝুলছে গোল গোল ফল। প্রায় প্রতিটি গাছেই ভরপুর ফল। বাঁশের বাতা আর পলিথিনের জালের ফাঁকে ফাঁকে পুরো ক্ষেত যেনো ফলে ভরে রয়েছে। ছোট কুমড়ার আকারের সাম্মাম ফলের ভেতরটা দেখতে ও খেতে বাঙ্গির মতো।  

নাঈম বাংলানিউজকে বলে, কলেজ বন্ধ, তাই বাড়িতে অবসর সময় কাটাচ্ছিলাম। বিদেশ থেকে ভাই ফোন দিয়ে এ সাম্মাম চাষ করার সম্পর্কে বললেন। আমি ইউটিউব থেকে এটি কীভাবে চাষ করে সেটা জানলাম। পরে উপজেলা কৃষি অফিস থেকে পরামর্শ নিয়ে বগুড়ার একটি খামার থেকে এ ফলের চারা সংগ্রহ করি। সেই সঙ্গে সেখানে গিয়ে চাষ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই।

নাঈম আমাদের দেখে নতুন এ ফল সম্পর্কে বলেন, সাম্মাম ফল খুবই পুষ্টি সমৃদ্ধ। বহির্বিশ্বে এ ফলের চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশে এটির প্রচলন এখনো কম। এ ফলকে সৌদিতে সাম্মাম বলে, তবে বিভিন্ন দেশে এটি রক মেলন, সুইট মেলন, মাস্ক মেলন, হানি ডিউ নামেও পরিচিত। সাম্মামের দু’টি জাত রয়েছে। একটি জাতের বাইরের অংশ সবুজ আর ভেতরের অংশ লাল, আরেকটি জাতের বাইরের অংশ হলুদ এবং ভেতরের অংশ লাল। তবে খেতে দুই ধরনের ফলই খুব মিষ্টি ও রসালো।

চাষ সম্পর্কে তিনি বলেন, দোঁয়াশ মাটিতে সাম্মাম চাষ করা ভালো। মাটি ভালোভাবে চাষ করে বেড এবং নালা করে, মালচিং দিয়ে এ ফলের চাষ করতে হয়। তাহলে বেশ ভালো ফলন পাওয়া যায়। এটি খুবই অল্প সময়ের ফসল। গাছ লাগানোর দেড় মাসের মধ্যেই হয় সাম্মাম ফল।

প্রথমে ভাইয়ের কথা মতো ঝুঁকি নিয়ে এ ফলের চাষ শুরু করার কথা উল্লেখ করে নাঈম বলেন, এক বিঘা জমিতে আমার তিন হাজার সাম্মাম গাছ রয়েছে। প্রতিটি গাছে দুই-তিনটি করে ফল রয়েছে। বেশি ফল রাখলে ফলন কম হয়। একেকটি ফলের ওজন হয় দেড় থেকে দুই কেজি। প্রতিটি গাছেই ফল বেশ ভালো এসেছে। এক বিঘা জমিতে আমার খরচ হয়েছে প্রথমবার হওয়ায় এক লাখ টাকার মতো। আগামীতে খরচ কম হবে। আশা করছি, এ বছর দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার মতো লাভ হবে।

তিনি আরও বলেন, যেহেতু এ ফল কাঁচা-পাকা দুই অবস্থাতেই খাওয়া যায়, এজন্য কীটনাশকের পরিবর্তে আমি ফেরামন ফাঁদ, আগাছা যাতে না হয় এজন্য মালচিং দিয়েছি। সেই সঙ্গে বিষমুক্ত উপায়ে চাষ করছি।

নাঈম ইসলাম খোকন জানান, শ্রমিক খরচ বলতে জমি প্রস্তুতের সময় এক বিঘা জমিতে বেড তৈরির জন্য চারজন শ্রমিক লেগেছে। আর মাদা তৈরির জন্য ১০ জন শ্রমিক লেগেছে। এছাড়া একজন শ্রমিক সব সময় কাজ করেন। শ্রমিকের দিন হাজিরা ৩০০ টাকা করে। নিজেই জমিতে কাজ করায় শ্রমিক খরচ কম লাগে।

এখনো ফল পাকেনি। তবে এরই মধ্যে বিভিন্ন এলাকা থেকে দশনার্থীরা এসে ফল কেনার জন্য আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এছাড়া ঢাকায় বিক্রির ব্যবস্থা করেছি। পাইকারি দুইশ’ টাকা কেজি দরে বিক্রি করব। যেহেতু নতুন ফল, আশা করছি, স্থানীয় বাজারেও এর চাহিদা ভালো হবে। ১০ থেকে ১৫ দিন পর থেকে ফল সংগ্রহ শুরু করব, যোগ করেন তিনি।  

নতুন এ ফল এবং ফলের চাষাবাদ দেখতে অনেক দূরের এলাকা থেকেও লোকজন নাঈমের জমিতে আসছেন। আগতদের এ ফল চাষে উদ্বুদ্ধ করছেন নাঈম।

রবিউল ইসলাম নামের এক কৃষক বাংলানিউজকে বলেন, আমি এ গাছ লাগানো থেকে শুরু করে এ জমিতে দৈনিক হাজিরা হিসেবে কাজ করছি। এ জমিতে খুব ভালো ফল এসেছে। আর ফলগুলো খেতেও খুব ভালো। আগামীতে আমার জমিতে আমি এ ফলের চাষ করবো।
নাজিম উদ্দিন নামে আরেক কৃষক বাংলানিউজকে বলেন, আমরা মনে করেছিলাম, এ ছেলে পাগলের মতো কি চাষ করছে? কিন্তু এখন তো দেখছি বেশ ভালো গাছ আর ফল ধরেছে। শুনেছি এটি বিদেশি ফল, খেতেও খুব ভালো। এর আগে এ ফল আমাদের এলাকায় হয়নি। দুইশ’ টাকা কেজি করে বিক্রি করছে কিছু কিছু। যদি লাভ হয়, তাহলে আগামীতে অনেকেই এ ফল চাষ করবে।

নাঈমের সাম্মাম ক্ষেত দেখতে আসা মস্তফা কামাল নামে এক শিক্ষক বাংলানিউজকে বলেন, সৌদি আরবের ফল এখানে চাষ হয়েছে বলে দেখতে এসেছি। দেখে খুবই ভালো লেগেছে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নভাবে চাষ করা হয়েছে। নতুন এ ফল দেখে দেখে মন ভরে গেছে।  

বিদেশি এ ফল অধিক লাভজনক উল্লেখ করে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা সাদ্দাম হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, আধুনিক কৃষি গতানুগতিক কৃষিকাজের চেয়ে লাভজন। সাম্মাম বিদেশি ফল, তবে আমাদের এখানেও চাষ করা সম্ভব। নাঈম নামে এক তরুণ কৃষককে আমরা চাষে পরামর্শ দিয়ে সার্বক্ষণিক সহায়তা করছি। তিনি বিষমুক্ত আধুনিক উপায়ে চাষ করে বেশ সাফল্য পেয়েছেন। আগামীতে এ চাষ বৃদ্ধি পাবে বলেও আশা করছি।  

মিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রমেশ চন্দ্র ঘোষ বাংলানিউজকে বলেন, রক মেলন বা সাম্মাম বেদেশি ফল হলেও আমাদের দেশে এটি চাষ করা সম্ভব। মিরপুর উপজেলার কচুবাড়ীয়া এলাকার তরুণ নাঈম এক বিঘা (৩৩ শতক) জমিতে এ বছর এ ফল চাষ করেছেন। তিনি খুব ভালো ফলও পাচ্ছেন।

তিনি বলেন, বর্তমানে পুষ্টি সমৃদ্ধ ফলমূল এবং আধুনিক চাষাবাদে তরুণরা এগিয়ে আসছেন। মিরপুর উপজেলা কৃষি কার্যালয়ের পক্ষ থেকে শিক্ষিত তরুণ কৃষকদের অগ্রাধিকার দিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে আধুনিক উপায়ে লাভজনক ফসল চাষের জন্য উদ্বুদ্ধ করছি।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৭, ২০২১
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।