ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কৃষি

বিষের চারা বুনছেন চাষিরা

খোরশেদ আলম সাগর, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭০২ ঘণ্টা, নভেম্বর ৯, ২০২১
বিষের চারা বুনছেন চাষিরা তামাক। ছবি: বাংলানিউজ

লালমনিরহাট: বিকল্প লাভজনক ফসল না থাকায় অধিক মুনাফার আশায় নিজের ও পরিবারে স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর জেনেও লাভের আশায় বিষবৃক্ষ তামাকের চারা বুনছেন ভুট্টা ব্রান্ডিংয়ের জেলা লালমনিরহাটের চাষিরা।

জানা যায়, কৃষিপণ্য ভুট্টাকে জেলার ব্র্যান্ডিং ঘোষণা করা হলেও ভুট্টার বাজার মূল্য নির্ধারণ না করা ও ভুট্টাজাত শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠা না করায় লাভের আশায় তামাকেই ঝুঁকছেন চাষিরা।

এছাড়াও ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা তামাক কোম্পানিগুলোর লোভনীয় অফারেও বাড়ছে বিষবৃক্ষ তামাকের চাষাবাদ। ঋণ ও বিনামূল্যে বীজ, সার-কীটনাশনক সরবরাহসহ কোম্পানির কর্মীরা নিয়মিত চাষিদের মাঠ পরিদর্শন করে পরামর্শ দিচ্ছেন। তামাক উঠে এলে নির্ধারিত মূল্যে তামাক বিক্রয়ের নিশ্চয়তা দিচ্ছেন সকল তামাক কোম্পানি।

প্রতিটি কোম্পানির রয়েছে নিজেস্ব চাষি। তারা চাষিদের জমি দেখে চাষি কার্ড দেন। তৈরি করেন চাষিদের ব্যাংক হিসাব নম্বর। তামাক পাতা বিক্রির সময় ঋণের টাকা কেটে নিয়ে চাষিদের নিজস্ব ব্যাংক হিসাব নম্বরে চলে যায় তামাকের টাকা। ফলে বিক্রির নিশ্চয়তা পেয়ে তামাক চাষে আগ্রহী হচ্ছেন চাষিরা।

চাষিরা জানান, তামাক চাষ করলে তামাক কোম্পানি বীজ সার কীটনাশক ও চাষাবাদ খরচ হিসেবে নগদ অর্থও ঋণ হিসেবে আগাম দিয়ে থাকেন। ফলে তামাক চাষে কম পুঁজি বিনিয়োগ করেই ফসল ঘরে তোলা যায়। তামাক বিক্রিতেও ঝামেলা নেই। কোম্পানি তাদের নির্ধারিত মূল্যে ক্রয় করেন। কার্ড দিলেই চাষিদের উৎপাদিত তামাক ক্রয় করতে বাধ্য কোম্পানি। তামাক চাষে খরচ বেশি হলেও অন্য ফসলের তুলনায় মুনাফা বেশি। পরিবারের সকল সদস্য মিলে তামাক ক্ষেতে পরিচর্যা করা যায়। বাড়ির শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সকলেই তামাকের কাজ করতে পারেন। বর্তমানে তামাকের চারা তৈরিতে ব্যস্ত চাষিরা।


তামাক ক্ষেতে ও তামাক পাতা সংগ্রহের কারণে তামাক পাতার গন্ধে কিছুদিন বাড়িতে থাকা কিছুটা কষ্ট হয়। তামাকের কাজ করলে সর্দ্দি কাশিতে আক্রান্ত হলেও লাভের আশায় তামাক চাষে ঝুঁকছে চাষিরা। তামাকের পাতা সংগ্রহের সময় ঘর বাড়ি, উঠানসহ রাস্তার দুইধারেও শুকানো হয় তামাক পাতা। ফলে শিশু ও বৃদ্ধসহ পরিবারের অধুমপায়ীরাও স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েন। ভোগেন নানা ধরনের রোগে। তামাক ক্ষেতে কাজ করলে শরীরের নানা রোগ বাসা বাধে। এসব জেনেও অধিক মুনাফার আশায় তামাক চাষ বাড়ছে।

সরকারিভাবে তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করতে নানা উদ্যোগের কথা বলা হলেও বাস্তবে তা মাঠে দেখা যায় না। উল্টো অন্য ফসলের প্রণোদনা এবং প্রদর্শনীও বরাদ্দও পাচ্ছেন তামাক চাষিরা। ফলে সরকারি বরাদ্দের সার ও অর্থে চাষাবাদ হচ্ছে তামাকের। কৃষি বিভাগের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা তামাক কোম্পানির সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলে তামাক চাষিদের এমন সুযোগ দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। যারা তামাক চাষ ছেড়ে অন্য ফসলে ধাবিত হচ্ছে তাদের প্রণোদনা দিয়ে উৎসাহ দিলে তামাক চাষ কমে আসবে বলে জানিয়েছেন চাষিরা।

চাষিরা জানান, একই জমিতে দীর্ঘদিন তামাক চাষের ফলে বার্লি জাত তামাকের বড় বড় শিকড় জমির উর্বর শক্তি নষ্ট করে। ফলে তামাকের জমিতে অন্য ফসলের উৎপাদনও কমে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন একই জমিতে তামাক চাষ করায় এক সময় ওই জমিতে তামাকের ফলনও কমে আসে। লালমনিরহাটে বার্লি জাত তামাক চাষের শুরুতে যে পরিমাণ ফলন হতো, বর্তমানে তা অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। ফলে এ জেলায় তামাক চাষেও লোকসানের শঙ্কা করছেন চাষিরা।

নীলকর জমিদারদের মতোই তামাক কোম্পানিগুলো চাষিদের সঙ্গে কৌশল প্রয়োগ করে তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করছেন। সরকারের কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা কৃষকদের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখলেও তামাক কোম্পানির লোকজন নিয়মিত চাষিদের খোঁজ খবর নেন। তামাকবিরোধী কোনো সংগঠন বা গণমাধ্যমকর্মীরা এলাকায় এলে তাদের সঙ্গে কথা বলার নিষেধাজ্ঞাও জারি করেছেন জাপান টোব্যাকো লিমিটেডের কর্মকর্তারা। যা তামাক চাষের কুফল চাষিদের নজরে না আসে সে কৌশল প্রয়োগ করে চাষিদের অন্ধ রেখে তামাক চাষে আগ্রহী করছেন বলেও কৃষকদের অভিযোগ।

তবে তামাক চাষিরা জানান, তামাক চাষ শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। কিন্তু তামাকে যেমন টাকা আসে অন্য ফসলে তেমন টাকা আসে না। ভুট্টা ও সবজিসহ অন্য ফসলের সরকার নির্ধারিত কোনো মূল্য ধরা নেই। যা তামাকে আছে। ফলে অধিক পরিশ্রম ও বিনিয়োগ করেও অন্য ফসলে প্রায় সময় লোকসান গুনতে হয়। কিন্তু তামাকের বাজার মূল্য নির্ধারিত ও বিক্রির নিশ্চয়তা রয়েছে। লাভবান ফসল ও তার বিক্রির নিশ্চয়তা পেলে তামাক চাষ ছেড়ে দিবেন বলেও জানান চাষিরা।

জাপান, আকিজ, নাসির, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোসহ বেশ কিছু তামাক কোম্পানি লালমনিরহাটের পাঁচটি উপজেলায় নিজস্ব বড় বড় ক্রয় কেন্দ্র ও গোডাউন করেছেন। সব থেকে বেশি তামাক চাষ হয় আদিতমারী উপজেলায়। যা প্রতিনিয়তই উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।


সাপ্টিবাড়ি এলাকার চাষি কোরবান আলী বাংলানিউজকে বলেন, গত বছর ১০ হাজার টাকা খরচ করে ৪০ হাজার টাকার তামাক পাতা বিক্রি করেছি। এ বছরও এক বিঘা জমিতে চাষ করব। দুই বছরের তামাকের টাকায় মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। তামাকের দুর্গন্ধে কাজ করা ও বাড়ি থাকাও কষ্টকর। কিন্তু কষ্ট না করলে তো টাকা আয় হবে না। গরীব চাষি যেখানে লাভ বেশি সেটাই চাষ করি। সরকার লাভজনক ফসল দিলে তামাক ছেড়ে দেবো।

সারপুকুরের চাষি হাজের আলী ও তাজের আলী দুই ভাই প্রতি বছর ৩ বিঘা জমিতে তামাক চাষ করেন। কিন্তু কোম্পানির নিষেধ থাকায় তারা গণমাধ্যমকর্মীর সঙ্গে কথা বলেন না। ছবি তুলতে গেলেও নিষেধ করেন। তারা বলেন, জানি তামাক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু খাবার না থাকলে পরিবারও উপোষ থাকে। তখন তো কেউ দেখে না। যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন চাষাবাদ করেই বাঁচতে হবে। দরকার টাকা। টাকা না থাকলে স্বাস্থ্য এমনিতেই নষ্ট হয়।

লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক শামীম আশরাফ বাংলানিউজকে বলেন, তামাক ছেড়ে ভুট্টা, পিঁয়াজ, রসুন, মিষ্টি আলুসহ নানা জাতের সবজি চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। কিন্তু চাষিরা যেখানে মুনাফা বেশি পাচ্ছে সেসব ফসল চাষে ঝুঁকে পড়ছে। তবুও তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করতে চেষ্টা অব্যহত রয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ০৭০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৯, ২০২১
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।