লাইফ জ্যাকেট দূরে সরে যাওয়ার পেছনের ঘটনাটা অর্পিতার কাছে এখনো অজানা। বিষয়টা যে কতটা ভয়াবহ বিপদের হাতছানি তাও আঁচ করতে পারেনি অর্পিতা।
পুব আকাশ ফর্সা হওয়ার আগেই বালিঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ছে অর্পিতা। দিনের বেলায় সৈকত নরখাদকদের দখলে থাকে। ওরা কারণে অকারণেই সৈকতে যাতায়াত করে। তখন সৈকতে ঘুরে বেড়ানো খুবই বিপজ্জনক। তাই যতটা সম্ভব বনে লুকিয়ে-চুকিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। আরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে বনে প্রবেশের আগে ডাব-নারকেল খাবে। সন্ধ্যা পর্যন্ত বনে থাকলে পানি না খেয়ে থাকা যাবে না। বনে ফলমূল পাওয়া গেলেও বিশুদ্ধ পানির সংকট রয়েছে। সব ভেবেচিন্তে নারকেল তলায় গিয়ে একটা বড়সড় ডাব কুড়িয়ে পাথর দিয়ে ফাটিয়ে পানি আর শাঁস খেলো পেটভরে। খেয়েদেয়ে আরেকটা ডাব হাতে নিয়ে বনে প্রবেশ করল। সে জানে ভোরের আলো ফুটে উঠলেই ঝুঁকি বেড়ে যাবে। নারকেল তলায় আর আসতে পারবে না; যেকোন সময় নরখাদকের দল চলে আসতে পারে। তাই বাড়তি সঞ্চয় হিসেবে ডাবটা সংগ্রহে রাখল।
অর্পিতা একখণ্ড ধারালো পাথর সঙ্গে রেখেছে। পাথরটা হাতছাড়া করবে না; আত্মরক্ষার প্রয়োজনে কাজে লাগবে। হিংস্র পশুরা তেড়ে এলে কিছুটা হলেও প্রতিহত করতে পারবে। এখন সে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে জায়গাটা সৈকতের চেয়ে খানিকটা নিরাপদ। বনে লুকিয়ে-চুকিয়ে থাকা যায়, সৈকতে তা মোটেও সম্ভব নয়। সতর্ক হয়ে হিংস্র প্রাণীদের এড়িয়ে চলতে পারলে বনে মোটামুটি টিকে থাকতে পারবে সেই ভরসাও আছে। অথবা হেলেপড়া গাছের সন্ধান পেলে তাতে চড়ে লুকিয়ে থাকতে পারবে।
সৈকতের কাছাকাছি বনের এদিকটায় গাছ-গাছালি, ঝোপ-জঙ্গল তেমন বেশি নেই। জঙ্গল খুব বেশি না থাকলেও প্রচুর বড় বড় পাথরের চাঁই রয়েছে। ইচ্ছে করলে পাথরের আড়ালেও লুকিয়ে থাকতে পারবে। তাছাড়া পাথরের খাঁজে বসে থাকলে হিংস্র প্রাণীর কবল থেকে কিছুটা হলেও নিরাপদ থাকবে। অর্পিতার ধারণা এই বনে ভয়ানক কোন হিংস্রর প্রাণী নেই। বিশেষ করে রাতে পাতিশিয়ালের চেঁচামেচি ছাড়া আর তেমন কোনো জীবজন্তুর হাঁকডাক শোনেনি। অন্যান্য প্রজাতির হিংস্র প্রাণী থাকলে বিগত সময়ের মধ্যে অন্তত একবার হলেও হাঁকডাক শোনা যেত। তাছাড়া বিপজ্জনক জীবজন্তু থাকলে দ্বীপবাসীদের ডেরা—কুটির এতটা ঠুনকো নড়বড়ে হতো না। কাজেই ধরে নেওয়া যায়, দ্বীপ বনে ওরকম ভয়ানক কোন হিংস্র প্রাণীর অস্তিত্ব নেই।
অর্পিতার বিশ্বাস আছে পাথরের আড়ালে লুকিয়ে নিরাপদে কাটাতে পারবে। তবে এটা ঠিক, গুহাটুহা থাকলে রাত কাটাতে খুব সুবিধা হতো। প্রয়োজনে গুহার মুখে আগুন জ্বালিয়ে রাখতে পারত। দ্বীপে আগুন জ্বালানোর বেশ ভালো ব্যবস্থাও রয়েছে। পাথরে পাথরে ঘঁষে সহজেই আগুন জ্বালানো সম্ভব। আগুন জ্বালানোর সহজ পদ্ধতি স্কাউটে শিখেছেও সে। অবশ্য সেই শিক্ষাটা দ্বীপে কাজে লাগাতে পারেনি অর্পিতা।
গতরাতেও সে বালিঘরের পাশে আগুন জ্বালিয়ে রাখতে চেয়েছিল। পরে খেয়াল হয়েছে, আগুন জ্বালালে হিংস্র প্রাণীর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবে ঠিকই, অন্যদিকে নরখাদকদের নজরে পড়ে যাবে খুব দ্রুত। দূর থেকে আগুনের শিখা নজরে পড়লে তাৎক্ষণিক ছুটে এসে ওকে ধরে ফেলবে। পালিয়ে থাকতে পারবে না আর। কিন্তু অর্পিতার জানা নেই নরখাদকদের আগুন ভীতির বিষয়টা। জানা থাকলে বেশ ভালো হতো। সবকিছু বিবেচনা করে রাতে আগুন জ্বালানো থেকে বিরত রইল অর্পিতা।
নিজের সামান্য বিহিত হতেই অর্পিতার মনে পড়ল বিপদগ্রস্ত লোকটার কথা। গভীর রাতে লোকটা জোরে জোরে চিৎকার দিয়েছে, পরবর্তীতে আর জানা হয়নি তার পরিণতি সম্পর্কে। অবশ্য ভোর পর্যন্ত আর সাড়া-শব্দও পাওয়া যায়নি তার। লোকটা কী ধরনের বিপদে পড়েছে কে জানে? রাতের আঁধারে তো নরখাদকদের তাড়া করার কথা নয়, তবে কি হিংস্র প্রাণীর কবলে পড়েছে লোকটা? জীবজন্তুর কবলে পড়লে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তারপরেও বিপদগ্রস্ত লোকটার খোঁজ নিতে ইচ্ছে হচ্ছে অর্পিতার। বন-বাদাড়ে কেউ সঙ্গে থাকলে ভয়-ডর কম পেতো, আবার বুদ্ধিশুদ্ধি করেও বেঁচে থাকার চেষ্টা করা যেত। লোকটা সম্পর্কে যদিও তেমন কিছু জানা নেই অর্পিতার, তথাপিও সে নিশ্চিত বিপদগ্রস্ত লোকটা বাঙালিদের কেউ। তার সাহায্যের আকুতি পরিষ্কার বাংলায় শুনেছে। তাছাড়া অর্পিতা ভালো করেই জানে, নরখাদকেরা বাঙালি নয়; বাঙালিরা নরখাদকও নয়। বাঙালিরা অতিথিপরায়ণ, যেচে উপকার করা বাঙালির সহজাত স্বভাব। সেই স্বভাবে উদ্বুব্ধ হয়ে অর্পিতা বিপদগ্রস্ত লোকটাকে খোঁজার চেষ্টা করছে। তবে লোকটাকে খুঁজে বের করতে হলে কী করার আছে তা বুঝতে পারছে না অর্পিতা। বেঁচে থাকলে লোকটা নিশ্চয়ই আশেপাশেই আছে। চিৎকারটা খুব বেশিদূর থেকে আসেনি। এমতাবস্থায় তাকে খুঁজতে হলে জোরে জোরে আওয়াজ করতে হবে। এছাড়া বিশাল বনে কাউকে খুঁজে বের করা সম্ভবও নয়।
অর্পিতা আওয়াজ করতে দু’হাত মুখের কাছে নিলো। অমনি মনে হলো এই কাজটা করা ওর একদম ঠিক হচ্ছে না। আত্মঘাতীর পর্যায়ে পড়ছে। নরখাদকের দল যদি আশপাশে থাকে তাহলে আওয়াজ শুনে খুব সহজেই ওকে খুঁজে বের করতে পারবে। কাজেই এভাবে নিজের নাক কাটার কোনো মানেই হয় না। মা-বাবা, তিয়াস নিশ্চয়ই ওর অপেক্ষায় আছে। ওকে বেঁচে থাকতেই হবে। আবেগে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না। বেঁচে থাকলে কোনো না কোনো উপায়ে মূল ভূখণ্ডে ফিরে যেতে পারবে। বিশেষ করে জেলেরা যদি দ্বীপের কাছাকাছি মাছ ধরতে আসে, তাহলেও উদ্ধারের সম্ভাবনা আছে। দ্বীপে ফলমূল অথবা খাবার জলের সংকট হবে না। রাত কাটানোর ব্যবস্থাও হবে। বালিঘরে একরাত যখন নিরাপদে কেটেছে, তাহলে আশা করা যায় দ্বীপে টিকে থাকতে পারবে। একটু সাহস রেখে বুদ্ধি করে চলতে পারলেই বিপদের মুখোমুখি হবে না।
নানান উৎকণ্ঠা নিয়ে পাথরের খাঁজে বসে রইল অর্পিতা। তখনো বনে আবছা আঁধার। ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে মাত্র। এমনই সময় কানে ভেসে এলো রাতের মতো আর্ত চিৎকারের প্রতিধ্বনি। এবার নিশ্চিত হয়েছে চিৎকারটা বেশি দূর থেকে আসেনি। ডান দিক থেকে আসছে। আওয়াজের উৎসস্থল কাছাকাছি মনে হচ্ছে। ইচ্ছে করলেই খুঁজে বের করতে পারবে লোকটাকে।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই পাথরের খাঁজ থেকে নেমে ডানে অগ্রসর হলো অর্পিতা। সতর্ক দৃষ্টি রেখে হাঁটছে সে। খুব বেশি দূর অগ্রসর হয়নি, দেখতে পেলো নরখাদকের দল একজন সভ্য মানুষকে টেনে হিঁচড়ে বন থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছে। তা দেখেই অর্পিতা থরথর করে কাঁপতে লাগল।
অর্পিতার দুঃখ হচ্ছে, মানুষটাকে আগে খুঁজে পায়নি ভেবে। তবে সে এখনো জানতে পারেনি এই মানুষটাই গতকালের দেখা সে—ই কি না। বিষয়টা ওর কাছে অজানাই রয়ে গেছে। তাই অর্পিতা ধরে নিয়েছে দ্বীপে আরও সভ্য মানুষের পদচারণা রয়েছে। খুঁজলেই হয়তোবা তাদের সাক্ষাৎ পেয়ে যাবে।
নরখাদকেরা বনত্যাগ করতেই পেছন থেকে তাকিয়ে রইল অর্পিতা। লোকটার জন্য ওর খুব মায়া হচ্ছে। ইচ্ছে করছে দৌড়ে গিয়ে ওদের কাছে আবেদন জানাতে লোকটাকে ছেড়ে দিতে। কিন্তু কাজটা করতে পারছে না, ওদের হিংস্রতার কথা মনে হতেই।
অর্পিতা ঝোপ থেকে বের হয়নি এখনো। বের হলে ওকে দেখে ফেলার সম্ভাবনা আছে। তাই জড়োসড়ো হয়ে ঝোপের ভেতরেই বসে রইল।
দূর থেকে অর্পিতা দেখতে পাচ্ছে নরখাদকেরা বন প্রান্তরে দাঁড়িয়ে আছে লোকটাকে ঘিরে। সেদিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে অর্পিতা। মুহূর্তের জন্যেও চোখের পলক ফেলেনি। সে জানে পরবতীর্তে কী ঘটতে যাচ্ছে, তারপরেও সেখান থেকে পালিয়ে আসেনি। লোকটার শেষ পরিণতি দেখতে ইচ্ছে করছে ওর।
খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি অর্পিতাকে। দেখেতে পেলো হৃষ্টপুষ্ট একজন নরখাদক বন্দির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তারপর ইশারায় কী যেন নির্দেশ দিয়ে বন্দির দিকে নিশানা করে তীর ছুড়ল। এই পর্যন্তই স্বচোখে দেখেছে অর্পিতা, পরবর্তী ঘটনাটা আর দেখার সুযোগ হয়নি, অচেতন হয়ে পড়ায়।
ঘণ্টাখানেক পর চেতনা ফিরে আসতেই দ্রুত ঝোপের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো অর্পিতা। এখানে আর দেরি করা যাবে না। নরখাদকের দল এদিকে চলে এলে নির্ঘাৎ ধরা পড়বে। তাই সে পূর্বের জায়গায় অর্থাৎ পাথরের চাঁইয়ের কাছে চলে এলো। এই জায়গাটাই ওর জন্য নিরাপদ মনে হচ্ছে এখন।
পাথরের খাঁজে বসে আছে অর্পিতা। চোখের পাতা ভারী ভারী লাগছে। রাতে ঘুমাতে পারেনি, চোখ ভেঙে ঘুম আসছে। দু’হাতে চোখ কচলে ঘুমের রেশ কাটানোর চেষ্টা করছে। অমনি দেখতে পেলো নরখাদকদের ছোট একটা দল সৈকতের দিকে এগিয়ে আসছে। ওদের দেখেই অর্পিতার হাত-পা কাঁপতে শুরু করল। যদি ওরা বনে প্রবেশ করে তাহলে নিশ্চিত ধরা পড়ে যাবে। এবড়োখেবড়ো পথ ডিঙিয়ে বনে দৌড়ে পালানো ওর পক্ষে কঠিন হবে।
সৈকতে এসেই নরখাদকেরা দূরে রাখা একটা ডিঙ্গি টেনে সাগর পাড়ে নিয়ে গেল। তারপর দু’জন ডিঙ্গিটাতে চড়ে মাছ ধরার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ডিঙ্গিটা গাছের গুঁড়ি দিয়ে বানানো; সরু। শক্তপোক্ত হলেও দূর সমুদ্রে ভেসে থাকার মতো উপযোগী নয়। তাই হয়তো ওরা বেশি দূরে না গিয়ে সৈকতের কাছাকাছি ভেসে মাছ ধরছে। তাছাড়া সমুদ্র এখন বেশ শান্ত। ফলে মাছ ধরতে তেমন সমস্যা হয়নি।
নরখাদকদের ব্যবহৃত ডিঙ্গিটা দেখে অর্পিতার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। নিশ্চয়ই শিকার শেষে ওরা ডিঙ্গিটা সৈকতে রেখে চলে যাবে। এই সুযোগে ডিঙ্গি নিয়ে পালিয়ে গেলে কেমন হয়? সমস্যা হচ্ছে পালিয়ে আশ্রয়ই বা নেবে কোথায়? খানিকটা দূরে একটা দ্বীপ দেখা যাচ্ছে যদিও, ছোট্ট এই ডিঙ্গির ওপর ভরসা করে উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ওই দ্বীপে নিরাপদে পৌঁছানো ওর পক্ষে সম্ভব নয়। সমুদ্রের বিশাল ঢেউয়ের কবলে পড়ে মুহূর্তেই ডিঙ্গিটা হারিয়ে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। নানান দিক বিবেচনা করে পালানোর পরিকল্পনাটা আপাতত স্থগিত করল অর্পিতা। মরতে হয় এই দ্বীপেই মরবে, সমুদ্রে নামার ইচ্ছে নেই আর। তবে আশা করা যায়, ডিঙ্গিটা কোনো একসময় কাজে লাগবে।
মাছধরা শেষ করে নরখাদকের দল সৈকত ত্যাগ করল। যাওয়ার সময় ডিঙ্গিটা সাগর পাড় থেকে টেনে জোয়ার ভাটার নাগালের বাইরে রেখে চলে গেল। অর্পিতা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। এই দিকটায় নরখাদকদের আনাগোনা থাকলেও জায়গাটা ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে নেই ওর। লুকিয়ে থাকার জন্য ভালো একটা জায়গা। বিশেষ করে পাথরের আড়ালে লুকিয়ে থাকার সুবিধাও আছে। এছাড়াও আরেকটা সুবিধা হচ্ছে, নারকেলতলা থেকে খুব কাছে বন; আবার সৈকতও কাছে। সব মিলিয়ে বলা যায় নিরাপদ একটা জায়গায় লুকিয়ে আছে সে।
অর্পিতা সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাতের আঁধার নেমে এলেই তবে বন থেকে বেরুবে। গত রাতের মতো বালিঘরেই কাটাবে। পাথরের আড়ালে থাকার চেয়ে বালিঘরে থাকার সুবিধাই বেশি। বিশেষ করে শীত নিবারণের জন্য বালিঘরই উত্তম।
সারা দিন মাথায় টেনশন নিয়ে পাথরের খাঁজে বসে কাটিয়েছে অর্পিতা। সূর্যাস্তের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। দেখতে দেখতে বিকেল পেরিয়ে গেছে। সূর্যের তেজও কমে এসেছে। সাগরের বুকে নেমে এসেছে তামাটে আলোকরশ্মি। ধীরে ধীরে বনপ্রান্তর অন্ধকারাচ্ছন্ন হতে লাগল। শুরু হলো রাতচরা পাখিদের ডানা ঝাপটানো। পাতিশিয়ালের আর্তচিৎকারে বনভূমি প্রকম্পিত হতে লাগল। অর্পিতা আঁতকে উঠল। আর বনে কাটানো সম্ভব নয়, সময় হয়েছে বেরিয়ে যাওয়ার। রাতচরাদের তোড়জোড়ে ওর শরীরের রোম দাঁড়িয়ে গেল। এমতাবস্থায় যত দ্রুত বন থেকে বেরুনো যায় ততই মঙ্গল। দেরি হলে বিপদ অনিবার্য। এখন বনে যতটা আঁধার নেমেছে, সৈকতে ততটা আঁধার নেই। কাজেই আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই হবে।
আনুমানিক মিনিট পাঁচ-সাতেক অপেক্ষা করতেই আঁধার নেমে এসেছে। সৈকতের কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তেমনি এক আলো-আঁধারের সন্ধিক্ষণে বন থেকে বেরুচ্ছে অর্পিতা। পেছন থেকে ভেসে আসছে রাতচরা জানোয়ারের হাঁকডাক। ভাবতেও শরীর কাঁটা দিচ্ছে যে, কয়েক মিনিট আগেও সে বনে আশ্রয় নিয়েছে। পুনরায় বনে প্রবেশের চিন্তাই করতে পারছে না আর।
সৈকতে এসে বালিঘর প্রস্তুত করে ফেলল অর্পিতা। গত রাতের মতো আজও বালিঘরেই আশ্রয় নিতে হবে। এছাড়া আর কোনো নিরাপদ আশ্রয়স্থল নেই রাত কাটানোর মতো। তাই দেরি না করে দ্বীপের একমাত্র নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিলো অর্পিতা। তারপর মাথায় ছেঁড়া জ্যাকেটটা ভালোভাবে মুড়িয়ে চুপচাপ শুয়ে রইল। ভাবছে ডিঙ্গিটা নিয়ে দ্বীপত্যাগ করলে কেমন হয়? দ্বীপে থাকার মানে হচ্ছে, নরখাদকের পেটে চলে যাওয়া। তারচেয়ে ডিঙ্গি নিয়ে দূর দ্বীপের উদ্দেশে পালিয়ে গেলেই তো ভালো। অবশ্য তাতে প্রচণ্ড ঝুঁকিও রয়েছে। ঝুঁকি সামলানো ওর পক্ষে কঠিনই হবে। তারপরেও বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টা করবে সে।
ঘণ্টাখানেক বাদে পুব আকাশের খিড়কি ঠেলে বেরিয়ে এলো গোলগাল টুকটুকে রূপালি চাঁদ। মুহূর্তে পাতলা কুয়াশার চাদর ভেদ করে চন্দ্রের রূপালি আভা ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত দ্বীপজুড়ে। সমুদ্র ক্যানেল বা প্রণালীর মধ্যখানে দাঁড়িয়ে থাকা দ্বীপটাও আবছা নজরে পড়ছে এখান থেকে। অর্পিতার মনে সাহস এলো। ঝুঁকি নিতে চায় সে। যা করার রাতের মধ্যেই করতে হবে। বেঁচে গেলে তো ভালোই, না হলে অন্তত নরখাদকদের পেটে যেতে হবে না।
ঝটপট জ্যাকেট পরে ডিঙ্গিটার কাছে চলে এলো অর্পিতা। ডিঙ্গিতে বৈঠার মতো একটা গাছের ডাল দেখতে পেয়ে ওর আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে গেল। বিপদে খুব কাজে দেবে এটা। বিশেষ করে সমুদ্র যদি এরকম শান্ত থাকে তাহলে বৈঠা হিসেবে চালিয়ে নিতে পারবে। ঠিকমতো হাল ধরতে পারলে পাশের দ্বীপে পৌঁছাতে সমস্যা হবে না।
কষ্টেসৃষ্টে ডিঙ্গিটাকে টেনে সমুদ্রের কিনারে নিয়ে এলো অর্পিতা। ডিঙ্গিতে চড়বে কি না ভাবছে। সাহস পাচ্ছে না। সে জানে বেঁচে থাকতে হলে একমাত্র ভরসা এখন ডিঙ্গিটাই। এছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই বেঁচে থাকার। কাজেই ডিঙ্গিতে চড়তেই হবে, না হলে পরিণতি হবে ভয়াবহ।
জলে ভাসছে ডিঙ্গি। ধীরে ধীরে বয়ে আসা ক্ষুদ্র ঢেউয়ের আঘাতে ডিঙ্গিটা টলমল করে দুলছে। আছড়ে পড়া একেকটা ঢেউ অর্পিতাকে হাতুড়ি পেটার মতো আঘাত করছে। স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে সমুদ্রের বুকে ভেসে থাকার ভয়াবহতার ঘটনা। পেছনের ঘটনাটা মনে হতেই শরীরের রোম দাঁড়িয়ে গেল অর্পিতার। কী করবে এখন! দিনের বেলায় হলে একটু সুবিধা হতো, ভয়—ডর কম পেতো। কিন্তু ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাবে না। দিনের বেলায় সৈকতে নরখাদকদের পদচারণা বেড়ে যায়। ওকে সমুদ্রে ভাসতে দেখলে নরখাদকদের দল নিশ্চয়ই বসে থাকবে না। ওর পেছন পেছন আরেকটা ডিঙ্গি ভাসিয়ে ধরে ফেলবে। সুতরাং দ্বীপ ত্যাগের মোক্ষম সুযোগ এখনই।
ভয়-ডর জয় করে সাহস নিয়ে ডিঙ্গিতে চেপে বসল অর্পিতা। সমুদ্র এখন বেশ শান্ত। নির্ভয়ে ঠাণ্ডা মাথায় বৈঠা ধরে রাখতে পারলে পাশের দ্বীপে নিরাপদে পৌঁছানো সম্ভব হবে। প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে সমুদ্রে এখন জোয়ার বইছে, ভাটার টান থাকলে এতক্ষণে ডিঙ্গিটাকে গভীর সমুদ্রে ভাসিয়ে নিয়ে যেত।
সাত—পাঁচ ভেবে অর্পিতা পা দিয়ে ডিঙ্গিটাকে সামান্য ধাক্কা দিল। অমনি ডিঙ্গি সৈকতের কিনার ঘেঁষে সাঁ সাঁ করে সমুদ্র প্রাণালীর দিকে ছুটতে লাগল। ডিঙ্গি কাঙ্খিত দ্বীপের দিকে ধাবিত হওয়ায় অর্পিতা কিছুটা আশ্বস্ত হলো। উঁচু ঢেউ তেড়ে না এলে এ যাত্রায় রক্ষা পাবে। মাছ ধরার ট্রলার বা জলযান সামনে পড়লেই তো আর কথাই নেই, নিশ্চিত বেঁচে যাবে।
প্রায় আধ ঘণ্টার মতো ডিঙ্গি ভেসে চলছে। ধীরে ধীরে অর্পিতার আত্মবিশ্বাস বাড়ছে। পাশাপাশি ভয়ও হচ্ছে যদি ভাটা লেগে যায় অথবা সমুদ্র ফুঁসে ওঠে, তাহলে ডিঙ্গিটা বিশাল সমুদ্রে নিমেষেই তলিয়ে যাবে।
ডিঙ্গি সামনে অগ্রসর হচ্ছে। এদিকে সমুদ্র অনেকটাই শান্ত। তবে কোনো কারণে ডিঙ্গি ক্যানেল থেকে বেরিয়ে গেলে সামলানো কঠিন হবে। এখন ভালোয় ভালো ভাটা না লাগলেই হয়।
ডিঙ্গি যতই অগ্রসর হচ্ছে, দ্বীপ ততই স্পষ্ট হচ্ছে। চন্দ্রের আলোতে এখন দ্বীপের অবয়বও দেখতে পাচ্ছে অর্পিতা। দেখে যতটা খুশি হয়েছে, ঠিক ততটাই শঙ্কিত হয়েছে। নয়া জীবনের স্বাদ অনুভব করলেও চিন্তিত হয়ে পড়ছে সে। যদি এই দ্বীপেও নরখাদকদের বসবাস থাকে, তাহলে পুরো মিশনটাই ব্যর্থ হবে। অনেকটা নিজ থেকে ধরা দেওয়ার মতো পরিস্থিতি হবে। বিষয়টা নিয়ে ভাবছে যখন, ঠিক তখনই ডিঙ্গি মৃদু ঝাঁকুনি খেয়ে পেছনের দিকে ধাবিত হতে লাগল।
হঠাৎ ডিঙ্গি পেছনের দিকে ধাবিত হওয়ায় অর্পিতা ঘাবড়ে গেল। বুঝতে পেরেছে নতুন কোনো বিপদের সম্মুখীন হয়েছে সে। চিন্তিত হয়ে পড়ল খুব। এদিকে ক্রমশই গতি বৃদ্ধি পেয়ে ডিঙ্গি পেছনে সরে যাচ্ছে। পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে ডিঙ্গি ভাটার কবলে পড়েছে। প্রণালী থেকে বেরিয়ে পড়লে জলস্রোত ডিঙ্গিটাকে একটানে গভীর সমুদ্রে নিয়ে যাবে।
অবস্থা বেগতিক। পাক খেতে খেতে তীর বেগে ডিঙ্গি পেছন দিকে ছুটছে। বৈঠাটা এখন কোনো কাজেই আসছে না। অবশ্য বৈঠা কাজে আসার কথাও নয়; যেখানে ডিঙ্গিতেই বসে থাকতে পারছে না, সেখানে আবার বৈঠা! ক্রমশই ডিঙ্গির গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেকোন সময় ছিটকে পড়তে পারে অর্পিতা। ভয়ে ওর দু’চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। ঠিক অমনি মুহূর্তে দূর থেকে ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে আসা সার্চ লাইটের ঝিলিক অর্পিতার চোখ ধাঁধিয়ে দিল। কয়েকবার ডিঙ্গির উপর আলোর ঝিলিক পড়তেই অর্পিতা বুঝতে পেরেছে জলযান অথবা কোস্ট গার্ডের নজরে পড়েছে সে। বিষয়টা নিশ্চিত হয়েই দু’হাত উঁচিয়ে আনন্দে চিৎকার দিতে লাগল অর্পিতা। (সমাপ্ত)
মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-২
মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-৩
মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-৪
মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-৫
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-৬
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-৭
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-৮
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-৯
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-১০
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-১১
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-১২
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-১৩
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-১৪
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-১৫
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-১৬
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-১৭
আলম শাইন: কথাসাহিত্যিক, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক কলামিস্ট
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৮ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০২৪
এমজেএফ