ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ফিরে দেখা : সাহিত্যবর্ষ ২০১৪ | ড. ফজলুল হক সৈকত

সালতামামি/শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৪
ফিরে দেখা : সাহিত্যবর্ষ ২০১৪ | ড. ফজলুল হক সৈকত

পেছনে ফিরে তাকাতে হয় মাঝে-মধ্যে। দেখে নিতে হয় পাওয়া-না-পাওয়ার কথা ও কল্পনাগুলো।

হারানোর কষ্টও থাকে কিছু। সম্ভবত সামনে এগোনোর তাগিদ থেকেই পেছনে তাকানোর এই অভিপ্রায় মানুষকে নাড়িয়ে তোলে। আনন্দ আর কষ্টকে সাথী করে, নতুন করে নিজেকে, সমাজকে, সংস্কৃতিকে, সভ্যতাকে গড়ে তোলার প্রত্যয়ের পাঠ গ্রহণ করতে হয় প্রতিদিন প্রতিবছর। সাহিত্য যে মানুষকে সভ্যতার পথে পা রাখতে এবং অগ্রসর হতে নানানভাবে সহায়তা করছে, তা অস্বীকার করা যায় না। আর ভবিষত্যের আলোকময় জীবন ও সমাজ তৈরি করতেও শিল্প-সাহিত্য রসদ যোগান দিয়ে যাচ্ছে সব সময়।
বোধকরি, সাহিত্যের বাজারে সবচেয়ে আকর্ষণীয় খবর— নোবেল পুরস্কার। যদিও বছরের সেরা সাহিত্যিকের নাম জানতে অপেক্ষা করতে হয় বছরের প্রায় শেষপাদ পর্যন্ত। অক্টোবরে আসে নোবেল বিজয়ীর নাম। ২০১৪ সালে নোবেল পেয়েছেন ফরাসি কথানির্মাতা প্যাত্রিক মোদিয়ানো। ইতিহাসকে সাহিত্যে কীভাবে স্থান দিয়ে সৌন্দর্য, প্রেরণা আর সাফল্যের সন্ধান করা যায়, সেই বার্তা দিয়েছেন মোদিয়ানো। তিনি সমকালে ফ্রান্সে এবং জার্মানিতে বেশ গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় কথাশিল্পী। নিজ দেশ ফ্রান্সের চেয়ে বরং জার্মানিতেই তাঁর পরিচিতি ও সমাদর বেশি। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রায় শেষপ্রান্তে ১৯৪৫ সালে জন্মগ্রহণ করেছেন। উপন্যাসে তুলে ধরেছেন অধিকৃতদের জীবনেতিহাস। কাজেই তিনি ফরাসিদের প্রাণের মানুষ। আর এখনতো মোদিয়ানো সারা দুনিয়ার সাহিত্য-রসিক ও সাহিত্য-সাধকদের কাছের লোক।

নোবেল ভাষণে প্যাত্রিক বলেছেন: ‘আপনারা আমাকে সাহিত্যের নোবেল পুরস্কার প্রদান করে সম্মানিত করেছেন; তাতে আমি মুগ্ধ হয়েছি। আপনাদের মধ্যে আমি উপস্থিত হতে পেরেছি; তাতে খুব খুশি হয়েছি। আমি সোজাসুজি এ দুটি অভিব্যক্তির কথাই বলতে চাই আপনাদের কাছে। এত বড় দর্শক সমাবেশে এটাই আমার প্রথম বক্তব্য প্রদানের অভিজ্ঞতা। ঠিকমতো বলতে পারবো কি না সে ব্যাপারে আমি কিছুটা শঙ্কিত। খুব সহজেই কল্পনা করা যায়, কোনো লেখকের জন্য সহজ-স্বাভাবিক কাজ এটা। কিন্তু কোনো লেখকের—নিদেনপক্ষে কোনো ঔপন্যাসিকের সঙ্গে বক্তব্য প্রদানের সম্পর্ক কখনো কখনো অস্বস্তিকর হয়ে উঠতে পারে। স্কুলের পড়াশোনার অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, লিখিত আর মুখে বলা পাঠের মধ্যে রয়েছে তফাৎ। কোনো ঔপন্যাসিকের মুখে বলার পারদর্শিতার চেয়ে লেখার প্রতিভা বেশি থাকে। তিনি চুপ থাকতেই অভ্যস্ত হয়ে থাকেন। কোনো আবহকে আত্মস্থ করতে চাইলে তাকে ভিড়ের মধ্যে মিশে যেতে হয়। সরাসরি আগ বাড়িয়ে না এসেও তিনি চারপাশের মানুষদের কথোপকথন শুনতে থাকেন; আর যদি তিনি আলাপের মধ্যে ঢুকে পড়েন তাহলে সেটা করে থাকেন তাঁর চারপাশের নারী-পুরুষদের আলাপ সম্পর্কে নিজের অবগতিকে আরো পরিষ্কার করার লক্ষ্যে কোনো বিচক্ষণ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার অভিপ্রায় নিয়ে। তাঁর বক্তব্যের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকতে পারে; কারণ লেখার মধ্যে তিনি অহরহই শব্দ কাটাকুটি করে বাতিল করেন। ’

বর্তমান প্রজন্মের নবীন লেখকদের জন্য মোদিয়ানোর নোবেল ভাষণটি হতে পারে ক্রিয়েটিভ রাইটিংস বিষয়ে একটি ওয়ার্কশপের লেকচারের মতো। লেখককে যে একইসাথে সম্পাদকও হতে হয়, তা এই ঔপন্যাসিক স্পষ্টভাবে বলেছেন; নিজের লেখাকে ফেলে দেবার মতো সাহসও অর্জন করতে হয় লেখককে। আবার একজন সাহিত্যিককে তন্দ্রাচ্ছন্নতার মধ্যেও থাকতে হয় সদা সতর্ক। ২০১৫ সালে সাহিত্যে কে নোবেল পাবেন, তা নিয়ে এখনো কথা ওঠেনি। সম্ভবনাময় আলোকিত কোনো ব্যক্তি তাঁর সাহিত্যভাস্বর নিয়ে হাজির হবেন আসছে অক্টোবরে।

সাহিত্যের খবরাখবর, প্রকাশ-চর্চা-পর্যালোচনার প্রায় প্রধান জায়গা সাহিত্য-সাময়িকী। শিল্পকলা-সাহিত্য-দর্শন-রাজনীতি-সমাজচিন্তা ও নিরীক্ষামূলক লেখালেখি স্থাপন পায় সাহিত্যপাতায়।

এ বছরে সাহিত্য সাময়িকীর জন্য বিপুল সাড়া জাগানো খবর ছিল বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত আমেরিকার নাগরিক ব্যাংকার জিয়া হায়দার রহমানের উপন্যাস ‘ইন লাইট অব হোয়াট উই নো’ (‘আমাদের জানাশোনার আলোয়’ অথবা ‘আমরা যদ্দুর জানি তার আলোয়’)। পিকাডো থেকে প্রকাশ হয়েছে বইটি। আর প্রকাশের পরপরই রিভিউ এবং লেখকের সাক্ষাৎকার ছেপেছে ‘নিউইয়র্ক টাইমস’। উপন্যাসটিতে বন্ধুত্ব, প্রতারণা, আর কাউকে কোনো বিষয়ে সম্পূর্ণরূপে জানার ক্ষেত্রে আমাদের যে সামর্থ্য—তা নিয়ে আবর্তিত হতে হতে কহিনীতে একের পর এক খোলাসা হতে থাকে নানান বিষয়। আছে ইংরেজ স্বভাব-চরিত্র ও সংস্কৃতির বিশিষ্টতা, শ্রেণিচারিত্র্য, গণিতের তত্ত্ব, মানবাধিকার সম্বন্ধে তীব্র সমালোচনা। প্রকৃতপক্ষে মানুষ পৃথিবী সম্পর্কে নিজের অভিজ্ঞতা ও ধারণার ওপর নির্ভর করতে পারে কি না, তা নিয়ে তীক্ষ্ণ-জাগর দৃষ্টি অনুসন্ধান চালিয়েছেন লেখক চরিত্র ও ঘটনার অন্ধিসন্ধিতে। আর এই উপন্যাসের অজ্ঞাতনামা বর্ণনাকারী এক পাকিস্তানি-আমেরিকান পাঠকের জন্য নিয়ে আসে নতুন আকর্ষণ।

সাড়া জাগিয়েছে অহিংস মানবতাবাদী দার্শনিক-রাজনীতিক মহাত্মা গান্ধীর ওপর রচিত ২টি সময়োচিত গবেষণাগ্রন্থ। গান্ধীজির সত্যান্বেষণ, ধর্মভাবনা এবং শান্তির সন্ধান নিয়ে ড. ফাদার হেমন্ত পিউস রোজারিও লিখেছেন ‘মহাত্মা গান্ধী: ট্রুথ অ্যান্ড নন-ভায়োলেন্স’ এবং ‘মহাত্মা গান্ধী: অন রিলিজিয়ন’ নামের গ্রন্থদুটি।

প্রয়াত মার্কিন লেখক জে ডি স্যালিঙ্গারের প্রথম দিককার ৩টি গল্প নিয়ে প্রায় ৭০ বছর পর ২০১৪-তে প্রকাশিত হলো ‘থ্রি আরলি স্টোরিজ’ নামের গ্রন্থ। গল্পগুলো সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশিত হলেও এতদিন ছিল অগ্রন্থিত। ১৯৬৫ সালে ‘হাপওয়ার্থ ১৬, ১৯২৪’ নামের গল্পটিই ছিল তাঁর শেষ প্রকাশিত রচনা।

চলতি বছরে শতবর্ষে পা দেয়া চিলির কবি নিকানোর সেগুনদো পাররা সানদোভালকে নিয়ে খবর প্রকাশ করেছে সাহিত্য সাময়িকীগুলো। স্প্যানিশ ভাষার গুরুত্বপূর্ণ এই কবি একাধিকবার নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হওয়ার পাশাপাশি পেয়েছেন স্পেনের মর্যাদাপূর্ণ সারভান্তেস ও চিলির পাবলো নেরুদা পুরস্কারের মতো সম্মাননা। নেরুদার সমসাময়িক কবি পাররা তাঁর রচনাকে বলেন, ‘এন্টি পোয়েট্রি’ আর নিজেকে দাবি করেন, ‘এন্টি পোয়েট’ বলে। তাঁর কবিতায় সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন সমস্যার কথা সাধারণ মানুষের ভাষায়ই প্রকাশ পায়, তিনি কবিতার এই বৈশিষ্ট্যকেই বলেন ‘এন্টিপোয়েট্রি’। ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত তাঁর কাব্য-সংকলন ‘পোয়েমাস ই আন্তিপোয়েমাস’ (পোয়েমস অ্যান্ড এন্টিপোয়েমস)-কে বিবেচনা করা হয় লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের এক ধ্রুপদী গ্রন্থ হিসেবে। বইয়ের কাটতির বিবেচনায় এ বছর শীর্ষে ছিলেন যুক্তরাজ্যের জনপ্রিয় লেখক জুলিয়া ডোনাল্ডসন। এই শিশুসাহিত্যিক গত ৫ বছর ধরে তিনি বইয়ের বিক্রিতে রেকর্ড সৃষ্টি করে চলেছেন।

অক্টোবরে ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে ‘উর্দু রাইটার্স অ্যান্ড রিডার্স ফেস্টিভ্যাল’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক একটি সাহিত্য উৎসবে যোগদানের জন্য সম্মানী দাবি করে আলোচনায় উঠে আসেন নোবেলজয়ী ত্রিনিদিয়ান-ব্রিটিশ লেখক ভি এস নাইপল।

দেশে কয়েকটি গ্রন্থ নানান কারণে আলোচনার টেবিলে জায়গা করে নেয়, ‘অবসর’ থেকে প্রকাশিত জগলুল আলমের ‘বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান (১৯৬৯-৭৫): মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের গোপন দলিল’, ‘বাংলাপ্রকাশ’-এর মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান রচিত ‘দেশভাবনা’, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ থেকে প্রকাশিত হাসান আজিজুল হকের আত্মজীবনীর ৩য় পর্ব ‘এই পুরাতন আখরগুলি।

মোহাম্মদ আবদুল হাই সম্পাদিত ‘বাঙালির ধর্মচিন্তা’ (সূচীপত্র), আহমদ রফিকের ‘দেশবিভাগ: ফিরে দেখা’ (অনিন্দ্য) শারমিন আহমদ রচিত ‘তাজউদ্দীন: নেতা ও পিতা’ (ঐতিহ্য), এ কে খন্দকারের ‘১৯৭১: ভেতরে বাইরে’ (প্রথমা প্রকাশন), ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের লেখা ‘বাংলাদেশ: ইমার্জেন্সি অ্যান্ড দি আফটারম্যাথ: ২০০৭-২০০৮’ (ইউপিএল)।

বহুল আলোচিত ম্যান বুকার পুরস্কার ২০১৪ লাভ করেছেন অস্ট্রেলীয় লেখক রিচার্ড ফ্ল্যানাগান। ‘দ্য ন্যারো রোড টু দ্য ডিপ নর্থ’ উপন্যাসের জন্য তাঁকে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়। উপন্যাসটির ক্যানভাসে আঁকা হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আর নর-নারীর প্রেম-ভালোবাসা। কেউ কেউ এটিকে বলেছেন, ‘প্রেম ও মৃত্যুর আখ্যান’।

ছোটগল্পের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে দামি পুরস্কার হিসেবে খ্যাত ফ্রাঙ্ক ও’কনর সাহিত্য পুরস্কারটি পেয়েছেন আইরিশ লেখক কলিন ব্যারেট। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘ইয়াং স্কিনস’-এর জন্য দেয়া হয় পুরস্কারটি। বিচারকদের মতে, একটি সুনির্দিষ্ট ধ্রুপদী সাহিত্যের সবগুলো বৈশিষ্ট্য এই বইটির মধ্যে রয়েছে।

ব্রিটেনের সবচেয়ে পুরনো ‘জেমস টেইট ব্ল্যাক মেমোরিয়াল সাহিত্য পুরস্কার-২০১৪’ জিতেছে ইংল্যান্ডের প্রত্যন্ত এলাকার একটি জনগোষ্ঠীর ধীরে ধীরে খণ্ড খণ্ড হয়ে যাওয়ার কাহিনী-নির্ভর উপন্যাস ‘হারভেস্ট’ এবং একজন বুকার পুরস্কারজয়ী ঔপন্যাসিকের জীবনীগ্রন্থ ‘পেনেলোপ ফিটজেরাল্ড’। ‘হারভেস্ট’ লিখেছেন, ব্রিটেনের প্রখ্যাত কথানির্মাতা জিম ক্রেস আর ‘পেনেলোপ ফিটজেরাল্ড’-এর লেখক ডেম হারমিওন লি। প্রয়াত প্রকাশক জেমস টেইট ব্ল্যাকের নামে ১৯১৯ সালে এই পুরস্কার প্রবর্তিত হয়।

স্কটল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব এডিনবরার লিটারেচার বিভাগের শিক্ষক ও পোস্ট গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গঠিত বিচারক প্যানেল প্রতিবছর প্রায় ৪০০ বইয়ের ভেতর থেকে সেরা বইগুলো নির্বাচন করে থাকেন। পিছনে ফেলে আসা বছরে ‘ইন্টারন্যাশনাল ডিলান থমাস প্রাইজ’ লাভ করেছেন ৩৯ বছর বয়সী আমেরিকান লেখক জোসুয়া ফেরিস। তাঁর ৩য় উপন্যাস ‘টু রাইস এগেইন অ্যাট অ্যা ডিসেন্ট আওয়ার’-এর জন্য দেয়া হয় পুরস্কারটি।
সাহিত্যে পুলিৎজার জয় করেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত কবি বিজয় শেষাদ্রি।

ভারতের প্রয়াত প্রখ্যাত লেখক ও সাংবাদিক খুশবন্ত সিং-এর নামে ২০১৪ সালে একটি সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়েছে। দেশব্যাপী কাব্যচর্চাকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে কাব্যগ্রন্থের জন্য এ পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। পুরস্কারের অর্থমূল্য ২ লাখ রুপি।

যুক্তরাষ্ট্রের উইল ইজনার কমিক ইন্ডাস্ট্রি অ্যাওয়ার্ড বা সংক্ষেপে ইজনার অ্যাওয়ার্ড হচ্ছে গ্রাফিক নভেলের সবচেয়ে বড় পুরস্কার। একে কমিকসের অস্কারও বলা হয়। ২৪টিরও বেশি ক্যাটাগরিতে দেওয়া হয় এই পুরস্কার। ২০১৪ সালে সর্বোচ্চ ৩টি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার জিতেছে ব্রায়ান কে ভন ও ফিওনা স্ট্যাপলসের মহাকাশ অপেরা সিরিজ ‘সাগা’।

২০০৫ সালে প্রবর্তিত ব্রিটেনে রহস্যোপন্যাসের (ক্রাইম নভেল) জন্য পুরস্কার ‘থিকস্টোনস ওল্ড পিকুলিয়ার’ ২০১৪ সালে লাভ করেছেন ব্রিটিশ লেখক বেলিন্ডা বাওয়ার।

এ বছর বছর ভারতের সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন ৮জন কবি। বাংলা ভাষার উৎপলকুমার বসু, দিল্লির আদিল জুসাওয়াল, বোড়ো কবি উরখাও গৌড়া, কাশ্মিরী কবি শাদ রমজান, ওড়িয়া কবি গোপাল ক্রুষ্ণা, পাঞ্জাবি কবি যশবিন্দর, সিন্ধি কবি গোপ কামাল, ও উর্দু কবি মুনাওয়ার রানা।

স্পেনের ‘প্রিন্স অব আস্তুরিয়াস লিটারেচার অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন আইরিশ লেখক জন ব্যানভাইল। জ্যামাইকার কবি কেই মিলার পেয়েছেন ২০১৪ সালের ‘ফরওয়ার্ড পোয়েট্রি প্রাইজ’। সিঙ্গাপুরের শিল্প-সাহিত্যের সবচেয়ে বড় পুরস্কার ‘কালচারাল মিড্যালিয়ান’ পেয়েছেন তামিল কবি, গীতিকার ও গদ্যশিল্পী কে টি এম ইকবাল।

বিবিসি ‘ন্যাশনাল শর্টস্টোরি অ্যাওয়ার্ড’ জয় করেছে মার্কিন লেখক লিওনেল শ্রিভার। ২০০৬ সাল থেকে এই পুরস্কার দেয়া হচ্ছে।

স্পেনের গৃহযুদ্ধের (১৯৩৯-১৯৩৯) ওপরে লেখা লিদি স্যালভেরের ‘পাস প্লুরে’ (কান্না করো না) নামের উপন্যাস এ বছর ফ্রান্সের শীর্ষস্থানীয় সাহিত্য পুরস্কার ‘প্রি গঁক্যুর’ লাভ করেছে।

যুক্তরাজ্যে নন-ফিকশনের সবচেয়ে দামি ‘স্যামুয়েল জনসন’ পুরস্কারটি জিতেছে হেলেন ম্যাকডোনাল্ডের ‘এইচ ইজ ফর হৌক’ গ্রন্থটি।

২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বেসরকারি সম্মাননা ‘প্রেসিডেন্সিয়াল ফ্রিডম মেডেল’ পেয়েছেন ১৯ জন। তাঁদের মধ্যে চিলিয়ান-আমেরিকান বেস্টসেলিং লেখক ইসাবেলের নাম সবার আগে আলোচনায় আসে। ইবাবেলের ২১টি বই এ পর্যন্ত প্রায় ৬ কোটি কপি বিক্রি হয়েছে। আর তাঁর লেখা অনূদিত হয়েছে ৩৫টিরও বেশি ভাষায়।

চলতি বছরে ব্র্যাক ব্যাংক সমকাল সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছে ৩টি গ্রন্থ: কথাসাহিত্য শাখায় মঈনুল আহসান সাবেরের ‘এখন পরিমল’ (প্রকাশক: অনিন্দ্য); প্রবন্ধ-আত্মজীবনী-অনুবাদ শাখায় মাসরুর আরেফিন-এর ‘ফ্রানৎস কাফকা গল্পসমগ্র-১’ (প্রকাশক: পাঠক সমাবেশ) আর ‘হুমায়ূন আহমেদ তরুণ সাহিত্যিক পুরস্কার’ পর্বে পুরস্কৃত হয়েছে বদরুন নাহারের গল্পগ্রন্থ ‘বৃহস্পতিবার’ (প্রকাশক: শুদ্ধস্বর)।

২০১৪ সালে আমরা হারিয়েছি ‘সাদা বিশ্বের এক কালো শিখা’ মায়া এঞ্জেলোকে। পৃথিবী থেকে বর্ণবাদ এখনও মুছে যায়নি। বিদায় নিয়েছেন কালোদের সবচেয়ে বড় নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা। কিন্তু তাঁর প্রেরণা আর ত্যাগ তো শেষ হবার নয়। রাজনীতিতে যেমন নেলসন, তেমনি আফ্রিকার সাহিত্যে এক অনন্য নাম মায়া। কালো মানুষদের এই সোচ্চার কণ্ঠস্বর নিজের জীবন, কৃষ্ণাঙ্গ সচেতনতা, তাদের হতাশা-প্রেম, নারীর কালো-সচেতনতা প্রভৃতি প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন তাঁর লেখায়।

মারা গেছেন ‘অ্যাট প্লে ইন দ্য ফিল্ডস অব দ্য লর্ড’ উপন্যাসখ্যাত মার্কিন সাহিত্যিক ও পরিবেশবাদী পিটার ম্যাটথিয়েসেন। মৃত্যুর একদিন পরই তাঁর প্রকাশিত হয় তাঁর সর্বশেষ উপন্যাস ‘ইন প্যারাডাইস’। বিখ্যাত সাহিত্য সাময়িকী প্যারিস রিভিউয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন ম্যাটথিয়েসেন।

পরলোকে গমন করেছেন ব্রাজিলিয়ান লেখক, দার্শনিক ও তাত্ত্বিক রুবেম আলভেস। শিক্ষা ও মনস্তত্ত্বের ওপর আলভেসের দেড় শতাধিক গ্রন্থ বিশ্ববাসীর জন্য বিরাট সম্পদ হয়ে রয়ে গেছে। ক্যাম্পিনাসে তিনি একটি ইনস্টিটিউট চালাতেন, যার লক্ষ্য শিক্ষার মধ্য দিয়ে সামাজিক সংশ্লিষ্টতা সৃষ্টি করা। আলভেস কবিতা, গল্প এবং নিয়মিত কলামও লিখতেন।

বিশ্বসাহিত্যের একজন জনপ্রিয় লেখক, ‘নিঃসঙ্গতার একশো বছর’খ্যাত ঔপন্যাসিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ মারা যান গত এপ্রিলে।

দক্ষিণ আফ্রিকার লেখক নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক ও বর্ণবাদবিরোধী মানবাধিকার কর্মী নাদিন গার্ডিমার মারা যান ২৩ জুলাই।

আমেরিকার কবি আমিরি বারাকাকেও আমরা হারিয়েছি এ বছর। বারাকা টুইন টাওয়ার হামলা নিয়ে একটি কবিতা লিখে খুব বিতর্কিত হয়েছিলেন। এ জন্য তাঁকে নিউ জার্সির ‘পোয়েট লরিয়েট’ পদবীও হারাতে হয়েছিল।

প্রখ্যাত ভারতীয় লেখক খুশবন্ত সিং মৃত্যুবরণ করেন গত মার্চে।

ইংরেজ ঔপন্যাসিক, অভিনেত্রী ও মডেল এলিজাবেথ হাওয়ার্ড মারা যায় ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে। পুলিৎজার পুরস্কারজয়ী মার্কিন কবি, সম্পাদক, অনুবাদক ও ঔপন্যাসিক মার্ক স্ট্র্যান্ড ও তাঁর সমসাময়িক আমেরিকান ফিকশনের মাস্টার বলে খ্যাত কেন্ট হারুফও মারা গেছেন এ বছর।

চলে গেছেন ব্রিটিশ লেখক ও সাহিত্য-সমালোচক বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্য সাময়িকী ‘লন্ডন রিভিউ অব বুকস’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক কার্ল মিলার। সম্পাদনা ও লেখালেখির পাশাপাশি মিলার ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন-এ আধুনিক সাহিত্য পড়াতেন।

মৃত্যুবরণ করেছেন বার্নার্ডোস বয় হিসেবে পরিচিত ব্রিটিশ লেখক টমাস, ফরাসি লেখক, সম্পাদক ও কার্টুনিস্ট ফ্রাঁসোয়া কাভানা, ব্রিটিস লেখক ফিলিপ ডরোথি জেমস, মার্কিন লেখক ও অধিকারকর্মী লেসলি ফিনবার্গ।

মারা গেছেন জার্মান লেখক ও সাংবাদিক রাল্ফ জর্ডানো। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ সব ঘটনার সাক্ষী ছিলেন। প্রয়াত হয়েছেন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ভারতের তপন রায় চৌধুরী।

না ফেরার দেশে পা বাড়িয়েছেন ২০০৫ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পাওয়া প্রখ্যাত অনুবাদক ফখরুজ্জামান চৌধুরী। ভিন্নভাষার সাহিত্য বাংলা ভাষায় রূপান্তরে তাঁর অবদান মুছে যাবার নয়।

আমরা আরো যে সকল সাহিত্যিককে হারিয়েছি, তারা হলেন, চল্লিশের দশকের কবি ও বাংলাদেশের প্রথম আধুনিক কবি আবুল হোসেন, কবি ফজল শাহাবুদ্দিন, প্রখ্যাত দার্শনিক, শিক্ষাবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সরদার ফজলুল করিম, গবেষক-আইনবিদ ও অভিধান-প্রণেতা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, লেখক ও শিক্ষাবিদ জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী।

ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন, জাতীয় অধ্যাপক ইতিহাসবিদ সালাহউদ্দীন আহমদ, চিত্রশিল্পী, প্রচ্ছদশিল্পী ও কবি কাইয়ুম চৌধুরী, অনুবাদক আবু শাহরিয়ার, কবি ও সাহিত্য-সম্পাদক তিতাস চৌধুরী,  বেবী মওদুদ, লোকসাহিত্য সংগ্রাহক হারুন আকবর, ষাটের দশকের কবি—নগরের বাউল বলে খ্যাত অরুনাভ সরকার এবং কবি-গবেষক-শিক্ষাবিদ আবু তাহের মজুমদার, জাতীয় স্মৃতিসৌধের স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন, শিশুসাহিত্যিক এখ্‌লাসউদ্দিন আহ্‌মদ, বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম, কবি, প্রাবন্ধিক ফারুক সিদ্দিকী, ও ছড়াশিল্পী ওবায়দুল গনি চন্দন।  

প্রকৃতির নিয়মে একটি বছরের সবগুলো দিন পার করে আমরা পা দিয়েছি আরেকটি বছরে। পুরনো হিসেবের খাতা বন্ধ হয়ে খুলে গেছে হাল খাতা। নতুন বছরে শিল্প-সাহিত্যের ভুবন বয়ে আনবে নতুনতর আনন্দ-প্রণোদনা, তৈরি হবে নতুন নতুন লেখক ও শিল্প-কারিগর—এই প্রত্যাশা।

নোবেলজয়ী ব্রিটিশ লেখক ডোরিস লেসিং-এর একটি উপহারের খবর দিয়ে ২০১৪ সালের সাহিত্যভুবনের আলোচনার সমাপ্তি টানতে চাই। লেসিং মারা গেছেন মাত্র এক বছর আগে। তিনি বিশ্বাস করতেন বই-ই পারে একটি জাতিকে জ্ঞানের আলো দান করতে, সমৃদ্ধ করতে, মুক্তি দিতে। এই বোধ থেকেই আপাদমস্তক বইপ্রেমী এই মানুষটি তাঁর শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি জড়িত জিম্বাবুয়েতে ৮০-র দশকে শুরু করেছিলেন লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে লোকজনকে উদ্বুদ্ধ করার কার্যক্রমে।

জিম্বাবুয়ের প্রতি অফুরান ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে তিনি হারারের পাবলিক লাইব্রেরির জন্য ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে বাছাই করা ৩ হাজার বই দান করে যান। ‘বুক এইড ইন্টারন্যাশনাল’ নামের একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বইগুলো ওই লাইব্রেরিতে পৌঁছে দেয়ার জন্য। এই উপহার প্রসঙ্গে হারারের মেয়র বারনার্ড মানিয়েনিয়েনি মন্তব্য করেছেন, ‘এটি একজন মানুষের কাছ থেকে পাওয়া চমৎকার উপহার, যার মধ্য দিয়ে মৃত্যুর পরও এ দেশের প্রতি তাঁর ভালোবাসার প্রমাণ মিলল। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৮৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।