পেছনে ফিরে তাকালে, মনে পড়ছে, আমি আসলে দুইবার বাংলা লিখতে শিখেছি।
প্রথমটা ছেলেবেলায়।
পরে আমি দুয়েকবার ভেবেছি এই আনন্দের উৎস কোথায়? হয়ত মুক্তিতে বা উন্মোচনে। ভীষণ অন্ধকার টানেল পেরিয়ে ট্রেন যখন আলোর মুখ দেখে তখন যাত্রীদের চেহারাতে এরকম আনন্দ ঝলমল করে। পরে স্বল্পদিন একটা নৈশ বিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত থাকায় দেখেছি নিশ্চিতভাবেই সবাই ছেলেবেলাতেই লিখতে শেখে না। এই তো কিছুদিন আগে পাসপোর্ট তৈরির কাজে পাসপোর্ট অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। বোরকা পরা এক মহিলা ও তার তরুণ ছেলে তাদের হাতের কাগজটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে আর অসহায়ভাবে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। তাদের কথায় বুঝলাম তাদের কেউই লিখতে বা পড়তে জানেন না, ফলে কাগজটা সঠিক কিনা, সঠিক হলে তাদের কী করণীয় কিছুই তারা ধরতে পারছে না। অদ্ভুত অসহায়ত্ব নিয়ে তারা কোনও ত্রাতার অপেক্ষা করছেন।
কোনও কারণ ছাড়াই চোখে পানি এসে গিয়েছিল। আহারে! লিখতে পড়তে জানে না বলে পৃথিবীর কত কিছু থেকেই না তারা বঞ্চিত হচ্ছে। মনে হয়েছিল এমন তো আমার ক্ষেত্রেও হতে পারত। হয়ত আমিও লিখতে পড়তে জানলাম না। জাপানি বা রাশান অক্ষরের মত বাংলা অক্ষরও আমার কাছে চিরদুর্বোধ্য হয়ে রইল—আমি বেশিক্ষণ এমনটা ভাবতে পারলাম না। আমার পৃথিবী শূন্য হয়ে আসতে শুরু করল! মনে হলো এরকম হাহাকারের ভেতর বসবাসের জন্য মানুষের জীবন নয়!
তাই নিশ্চিতভাবেই নয়, তবে সৌভাগ্যবশত আমি বাংলা লিখতে শিখেছি ছেলেবেলাতেই। শৈশবেই। একটা পুরনো স্লেটে, চক দিয়ে দিয়ে আঁক টেনে, বড় বোনের কাছে, প্রথম যা লিখেছি তা নিশ্চয় অ। এবং লেখার স্টাইলটা ছিল বড় বোন স্লেটে একটি অ লিখে দিতেন আর আমি তার ওপর ওই আঁক দেখে দেখে অ লিখতাম। অ, অ, অ... আর আমার ভেতর চাহিদা তৈরি হতো পরবর্তী অক্ষর ‘আ’ এর কাছে যাবার। মনে পড়ছে আমি অ লিখতে লিখতে আ, আর আ লিখতে লিখতে শুধু ই এর কথা ভেবেছি। খুব বেশি স্থির থাকতে পারি নি কিছুতেই, কেননা আমার জন্য তখনও অপেক্ষা করছে পুরো ব্যঞ্জনবর্ণ। আমি ক-এর দিকে তাকাই বইয়ে, আমি লি-এর দিকে তাকাই। অদ্ভুত ঙ’র দিকে তাকাই, ঞ’র দিকে তাকাই। আর সবচেয়ে বেশি আনন্দ নিয়ে চন্দ্রবিন্দুর দিকে তাকাই। ওটাকে আমার তখনও অক্ষর মনে হয় না। মনে হয় যেন এক চাঁদ আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। ওই চন্দ্রবিন্দুর কাছে যাবার ইচ্ছা আমাকে তাড়িত করে। কারণ ওখানে গেলেই আমার সমস্ত অক্ষর আয়ত্ত হয়। তাই উ লিখতে লিখতেই আমি লুকিয়ে লুকিয়ে চন্দ্রবিন্দু লিখি। লিখি আর হাতের তালু দিয়ে টিপে টিপে মুছে ফেলি। একদিন বড় বোন দেখে ফেললেন আমার চন্দ্রবিন্দু কেচ্ছা। ভ্রু কুঁচকে বললেন, চল, তোকে উল্টা দিক থেকে অক্ষর লেখা শেখাই!
আমি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে চন্দ্রবিন্দু থেকে ব্যঞ্জনবর্ণ লেখা শিখতে শুরু করলাম!
আর একদিন আমার কী আনন্দ, আমি ঠাশ ঠাশ করে সবগুলো অক্ষর লিখতে শিখে গেলাম। এমনকি না দেখে। তারপর বর্গ না মেনে। যে কোনও জায়গা থেকে। তখন সবাই বলল, এর তো হয়ে গেছে একে এবার স্কুলে ভর্তি করে দাও...
স্কুলে গিয়ে তখন নতুন জীবন শুরু হলো।
কিন্তু ভাবি, আমি যদি অক্ষরগুলো লিখতে না শিখতাম! তাহলে এই যে রাশি রাশি মনের কথা, এই যে আপনাদের সাথে তোমাদের সাথে তোদের সাথে বলে চলেছি তার প্রকাশ করতাম কিভাবে?
তখনই ভাবি যে, শুধু শৈশবের সেই শেখাতেই এই যোগাযোগ তো সম্ভব ছিল না। আমাকে তাই দ্বিতীয়বারের মত বাংলা লিখতে শিখতে হয়েছে। খাতা-কলমে নয়, কম্পিউটারে।
আমার জন্য কম্পিউটার ছিল এক ভয়ানক দূরের জিনিস। দূরের এবং সংশয়ের জিনিস। মূল্যবান এবং খুব ঠুনকো জিনিস। ঠুনকো এই অর্থে যে আমার মনে হতো আমার স্পর্শে এলেই যে কোনও দুর্দান্ত দামি কম্পিউটার নষ্ট হয়ে যাবে। ফলে যন্ত্রটা থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলতাম। তাছাড়া হাতের কাছে তখন কম্পিউটারই বা কই? যা দুয়েকবার দেখি সবই ব্যবহৃত হয় গান শোনা আর হিন্দি সিনেমা দেখার উদ্দেশ্যে।
অনেক দিন পর একটু সুযোগ এল কম্পিউটারের ব্যাপারে। ঢাকায় যে বন্ধুর বাড়িতে থাকছি তার ঘরে একটা কম্পিউটার আছে বটে। প্রতিরাতে সিনেমা দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে শেষে একদিন একটু কাছাকাছি বসলাম। মাউসের ওপর কম্পমান হাতটা রাখলাম। বললাম, বাংলা কী করে লেখে রে?
বন্ধু নিরুত্তর।
আমি বললাম, বাংলা লেখা যায় না?
বন্ধু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে যা বলল তাতে জানা গেল বাংলা লেখা হয়ত যায়, কিন্তু কিভাবে কী করতে হয় এ সম্পর্কে তার কোনও ধারণা নেই। কী সফটওয়ার লাগে, কই কই হাতড়াতে হয় ইত্যাদি। বলে সে একটা সাদা পাতা বের করে দিল পর্দায়। তারপর ঘুমাতে চলে গেল। আমি দীর্ঘক্ষণ সেই সাদার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। যতবারই কি-বোর্ডে চাপ দিই ততবারই ইংরেজি অক্ষর ওঠে। এরকম বারবার চাপ দিতে গিয়ে একটা দুর্ঘটনার মতো ঘটল। আর তখনই আমি আবিষ্কার করলাম সাদা পর্দায় একটা বাংলা অক্ষর উঠেছে। যতদূর মনে পড়ছে অক্ষরটা ব। আমার হৃদপিণ্ড ছলকে উঠল। ভীষণ অবাক চোখ নিয়ে আমি পর্দাটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমার লেখা বাংলা অক্ষর। কম্পিউটারের পর্দায়। যেন অবিশ্বাস্য। যেন এক দুর্ঘটনা! দুর্ঘটনাই তো! পৃথিবীর সব বড় বড় আবিষ্কার আর উদ্ভাবন কি দুর্ঘটনা নয়। পর্দায় তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হলো আমি যেন গুপ্তধনের নকশা পেয়ে গেছি!
কিন্তু পরক্ষণেই আর বাংলা লেখা ওঠে না পর্দায়। ইংরেজি ইংরেজি। বুক শুকিয়ে গেল। তাহলে কি বর্ণগুলো হারিয়ে গেল? আর পাব না তাদের? প্রিয় বর্ণমালাগুলো কি আর লিখতে পারব না? বন্ধু অঘোরে ঘুমাচ্ছে। আমি তার কম্পিউটার নিয়ে চেষ্টা করেই যাচ্ছি।
ভোরের আজান যখন হচ্ছে তখনও আমি কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে। ততক্ষণে আমি জেনে গেছি কোথায় চাপ দিলে ইংরেজির বদলে বাংলা অক্ষর ওঠে। অ কিভাবে লেখা যায়, আ কিভাবে লেখা যায়। আমি যে কি-বোর্ডটা ব্যবহার করছিলাম তাতে শুধু ইংরেজি অক্ষরেরই চিহ্ন দেয়া। ফলে কোথায় কোন অক্ষর, কীভাবে যুক্তাক্ষর তৈরি করতে হয় সবই ওই এক রাতের মধ্যে, কিছু ভুল আর কিছু শুদ্ধভাবে লিখতে শিখেছিলাম।
কাক যখন ডাকতে শুরু করে তখন কম্পিউটারের পর্দায় লেখা আমারই একটা কবিতা—
আমার সকল তোমাকে দিয়েছি তোমার কিছুই দাও নি
তবুও তোমার সকল নিয়েছি আমার কিছুই নাও নি
আমি আমার সমস্ত বিস্ময় আর আবেগ নিয়ে লেখাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। যেন এইমাত্র পিতা হয়েছি, যেন এইমাত্র আমি স্রষ্টা হয়ে উঠেছি। যেন এইমাত্র আমি আবার বাংলা ভাষার হয়ে উঠতে পেরেছি।
কী করে সেভ করে রাখতে হয় না জানায় ওই প্রথম লেখাটা কোথাও জমিয়ে রাখতে পারি নি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমার হৃদয়ে আসলে ওই সকাল থেকেই লেখাগুলো জমে আছে একটা অবিশ্বাস্য প্রেম হয়ে!
বন্ধুর ঘরের সেই রাত না পেলে হয়ত আমার দ্বিতীয়বারের মত বাংলা লেখা শেখা হতো না। আর না হলে, আমি ভাবি এই সহজ যোগাযোগ কী করে সম্ভব হতো? কী করে আমি আমার মনের কথা প্রকাশ করতাম এতটা সুলভে?
পরক্ষণেই ভাবি যে ভাষাটা দুইবার লিখতে শিখে আমি এত তীব্র আনন্দিত, যে ভাষাটা আমাকে এনে দিয়েছে যোগাযোগের এমন সরল পন্থা, একটা সময় এসেছিল যখন এই ভাষাটাই বাতিল করে দেয়া হচ্ছিল!
বুকটা ধ্বক করে ওঠে। তাহলে আমি আমার মনের ভাব প্রকাশ করতাম কী করে? এই যে ফেসবুকে ব্লগে পত্রিকায় লিখছি তা লিখতাম কিভাবে? আমার ভেতর ঝর্ণাধারার মত উৎসারিত যে আবেগগুচ্ছ তার প্রবাহ কী করে হতো?
ফলে পূর্বপুরুষদের জন্য শ্রদ্ধাটা গাঢ় হয়। ভাগ্যিস আপনারা আমাদের এই প্রিয় ভাষাটা বাঁচিয়ে দিয়েছেন, না হলে আমরাই কি বাঁচতাম! আর তারপরেই মনে হয় বাংলা লিখতে শেখার যে প্রক্রিয়া তা বোধহয় এখনও ফুরিয়ে যায় নি। আমি, এখনও, প্রতিনিয়ত, লিখতে শিখেই চলেছি, শিখেই চলেছি!
আমি চাই বাংলা লিখতে শেখার এই আকুতি কখনও যেন ফুরিয়ে না যায়!
বাংলাদেশ সময়: ০১৫৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৫