১৯৮৪ (নাইনটিন এইটি ফোর)—বিখ্যাত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক, সাহিত্য সমালোচক ও সাংবাদিক জর্জ অরওয়েলের অমর গ্রন্থ। ১৯৪৯ সালে তার মৃত্যুর এক বছর আগে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়।
___________________________________
শুরু থেকে পড়তে ক্লিক করুন
৩৭তম কিস্তির লিংক
___________________________________
তারপরেও আশা যদি কিছু থেকে থাকে তা ওই প্রোলদেরই আছে। আপনাকে ঠিক লেগে থাকতে হবে। ওদের কথায়ই মনে হবে ওরা আশাবাদী। আর ফুটপাতে উল্টো দিক থেকে হেঁটে আসা মানব সন্তানগুলোর চেহারাই আপনার মধ্যে এই বিশ্বাস বদ্ধমূল করে দেবে।
এবার যে সড়কটিতে সে পা ফেললো সেটি নিচের দিকে নেমে গেছে। তার মনে হচ্ছিলো এদিকটাতে একসময় থাকতো সে। মূল সড়কটিও এখান থেকে কাছেই। সামনে কোথাও থেকে কথাবার্তার শব্দ আসছে। রাস্তাটি একটি কড়া বাঁক নিয়েই একটি পায়েচলা পথে মিশলো আর সেখান থেকে আরেকটি গলিতে ঢুকলো যেখানে নেতিয়ে যাওয়া সব্জির ডালা বিছিয়ে বসে আছে দোকানিরা। জায়গাটি চিনে ফেললো উইনস্টন। এই পথ ধরে মূল সড়কে যাওয়া যায়, আর পাঁচ মিনিটেরও পথ হবে না, নিচের দিকে পরের বাঁকেই সেই ভাঙারির দোকানটি যেখান থেকে সে একটি নোটবুক কিনেছিলো, যেটি এখন তার দিনপঞ্জি। অদূরেই ছোট একটি রকমারি দোকান আছে যেখান থেকে সে কলমদানি আর কালির দোয়াত কিনেছিলো।
পা ফেলতে গিয়েও একটু থমকালো সে। রাস্তার উল্টোদিকে একটি নোংরা ছোট পাব। ধুলোর আস্তরে জানালাগুলো মনে হচ্ছে বরফে ঢাকা পড়েছে। দেখলো বয়সের ভারে কুঁজো তবে বেশ শক্ত-সামর্থ, সাদা গোঁফে মুখ ঢাকা এক বৃদ্ধ নড়বড়ে কপাট ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন। উইনস্টন দাঁড়িয়ে দেখছিলো, তার মনে হচ্ছিলো এই লোকের বয়স এখন আশি, আর বিপ্লবের সময় অবধারিতভাবেই তার মধ্যবয়স। এই বুড়োর মতোই কিছু মানুষ পূঁজিবাদের বিনাশের তথ্য নিয়ে এখনো বেঁচে আছে। পার্টিতেই এমন লোক পাওয়া যাবে না, যারা বিপ্লবের আগের সম্পর্কে ধারণা রাখে। অপেক্ষাকৃত জ্যেষ্ঠ প্রজন্মের অধিকাংশকেই পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের মহাশুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়ায় হাপিস করে দেওয়া হয়েছে। আর গুটিকয় যারা টিকে গেছে তারা অনেক আগেই বুদ্ধিবৃত্তিক আত্মসমর্পন করে বেঁচে আছে। আর কেউ যদি এখনো শতাব্দীর গোড়ার অংশে যা কিছু ঘটেছে তা সত্য করে বলার যোগ্যতা নিয়ে বেঁচে থাকে, সে হবে প্লোলদেরই কেউ। হঠাৎ করে ইতিহাস বই থেকে ডায়রিতে টুকে রাখা সেই অনুচ্ছেদটি মনে পড়লো উইনস্টনের। আর একটা পাগলামো তাকে পেয়ে বসলো। সে এই পাবে যাবে, বুড়োর সাথে খাতির জমাবে, আর তার কাছে নানা কথা জানতে চাইবে। সে তাকে বলবে:‘আপনার ছেলেবেলার কথা বলুন। সেই দিনগুলো কেমন ছিলো? এখনকার চেয়ে ভালো ছিলো নাকি খারাপ?’
নিজেকে ভীত হয়ে পড়ার সময় না দিয়েই সরু রাস্তাটি চট করে পার হয়ে গেলো। কাজটি পাগলামো বৈ কিছু নয়। প্রোলদের সঙ্গে কথা বলা, সুঁড়িখানায় যাওয়া এগুলো নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়ম নেই। তবে নজরদারি এড়িয়ে পার পেয়ে যাবেন এমনটা ভাবা ভুল। টহলদাররা এসে পড়লে তাকে মাতাল হয়ে যেতে হবে, তবে তাতে ওরা বিশ্বাস করবে বলে মনে হয় না। দরজা ঠেলে ঢুকতেই টক বিয়ারের তীব্র গন্ধটা যেনো মুখের ওপর ঝাপটা মারলো। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার চেচামেচির শব্দ অর্ধেকে নেমে এলো। না তাকিয়েও বুঝতে পারে সবার আগ্রহী চোখ আটকে আছে তার নীল আলখেল্লায়। উল্টোদিকে যে গোল চাকতিতে বাণ নিক্ষেপের খেলা চলছিলো তাও অন্তত ত্রিশ সেকেন্ডের জন্য থমকে গেলো। বৃদ্ধ লোকটি ততক্ষণে বারের সামনে দাঁড়িয়ে বারম্যানের সঙ্গে ঝগড়ায় জড়িয়েছে। যুবক বারম্যানটির লম্বা, মোটা, আংটাকৃতির নাক, পেশিবহুল হাত। আশেপাশে অন্যরা গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে ঝগড়া দেখছে।
‘তোমাকেতো ভদ্রভাবেই বলেছিলাম, বলো বলিনি? ঝগড়াটে ভঙ্গিমায় কাঁধ ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো বুড়ো। তুমি বললে, এক পাইঁট মাপের মগ নেই। সুরিখানায় এসে এও শুনতে হলো!’
‘পাইঁট মগ আবার কী জিনিষ?‘ আঙুলের মাথাগুলো কাউন্টারে ঠেসে একটু ঝুঁকে পড়ে বললো বারম্যান।
‘সুঁড়িখানায় কাজ করো অথচ জানো না পাইঁট কি! এক পাইঁট হচ্ছে কোয়ার্টারের আধা, আর চার কোয়ার্টারে এক গ্যালন। তোমাকে বোধ হয় বর্ণমালা শেখানো শুরু করতে হবে। ’
‘জন্মেও শুনিনি ওসব হিসাব,’ একটু গলা নামিয়ে বললো বারম্যান। ‘লিটার আর আধা লিটারের হিসাব। এর বাইরে আমাদের কাছে আর কোনও মাপ নেই। সামনের তাকে গ্লাস রাখা আছে। ’
‘আমি চাই এক পাইঁট,’ জোর গলায় বললো বুড়ো। ‘তুমি সহজেই আমাকে দমাতে পারবে না। বয়সকালে আমরা এইসব ফালতু লিটারের মাপে মদ খাইনি। ’
‘তুমি যখন যুবক ছিলো আমরা তখন গাছের চুড়ায় বাস করতাম’ আশেপাশে অন্য খদ্দেরদের দিকে চোখ ঘুরিয়ে এনে তবেই বললো বারম্যানটি।
চারিদিকে হা-হা হাসির তোড় ছুটলো। এতে উইনস্টন ঢোকার পর যে অস্বস্তি দেখা দিয়েছিলো সেটা উবে গেলো। সাদা খ্যাংড়ামুড়া দাড়ির বৃদ্ধচেহারাটি গোলাপি হয়ে উঠলো। গজগজ করতে করতে উল্টো ঘুরে উইনস্টনের সঙ্গে ধাক্কা খেলো সে। উইনস্টন আলতো করে হাত দিয়ে ধরে ফেললো।
‘আমি কি তোমাকে মদ খাওয়াতে পারি?’ বললো সে।
‘তুমি ভদ্রলোক,’ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো বুড়ো। মনে হলো উইনস্টনের নীল আলখেল্লার দিকে তখনো তার চোখ পড়ে নি। ‘পাইঁট!’ কড়া চোখে বারম্যানের দিকে তাকিয়ে উচ্চারণ করলো বুড়ো। ‘তোমাকে এক পাইঁট ধোলাই লাগানো দরকার। ’
বাংলাদেশ সময় ১১২৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৫
৩৯তম কিস্তির লিংক
শিল্প-সাহিত্য
প্রতিদিনের ধারাবাহিক
১৯৮৪ | জর্জ অরওয়েল (৩৮) || অনুবাদ: মাহমুদ মেনন
অনুবাদ উপন্যাস / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।