হাজী মুহম্মদ মুহসীনকে আমরা দানবীর বলে জানলেও তিনি যে একজন সঙ্গীতজ্ঞ ও গণিতশাস্ত্রবিদ ছিলেন তা হয়তো অনেকেই জানি না। একইভাবে হয়তো নিচের বিষয়গুলোরও অনেককিছুই আমরা জানি না।
হাজী মুহম্মদ মুহসীন ১৭৩০ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৮১২ সালে মৃত্যুবরণ করেন। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের (ইংরেজি ১৭৭০ সালে) সময় তাঁর দানের ওপর নির্ভর করে লক্ষ লক্ষ মানুষ অন্নাভাবজনিত মৃত্যু খেকে বেঁচে গিয়েছিল। ১৮০৬ সালে তিনি তাঁর প্রায় সমস্ত ভূ-সম্পত্তি একটি ওয়াকফ দলিলের মাধ্যমে দান করে যান। তাঁর মৃত্যুর পরে সেই সম্পত্তির পরিচালনা নিয়ে ব্যাপক অনিয়ম শুরু হয়।
১৮৩৫ সালে সকল আইনি ঝামেলা মিটিয়ে সরকার মহসিন ট্রাস্টের দায়িত্ব গ্রহণ করে। ১৮৩৫ সালেই এই ট্রাস্টের অর্থে প্রতিষ্ঠিত হয় হুগলী মহসিন কলেজ এবং এই কলেজের সাথে হাজী মুহসীনের অর্থে পূর্বে নির্মিত দুটি স্কুলকে মিলিয়ে দেয়া হয়। উল্লেখ্য এইটিই ভারতবর্ষের প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা র কলেজ যেখানে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে যে-কেউ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারতো। এর আগে ১৮১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হিন্দু কলেজ ছিল শুধু ‘the sons of respectable Hindoos’ এর জন্য এবং ১৮১৮ ও ১৮২০ সালে প্রতিষ্ঠিত শ্রীরামপুর কলেজ ও বিশপস কলেজ ছিল খৃস্টান ধর্মাবলম্বীদের জন্য। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অক্ষয়চন্দ্র সরকার, স্যার উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী, শরৎচন্দ্র টট্টোপাধ্যায় প্রমুখ ভুবনবিশ্রুত বাঙ্গালিরা সবাই এই হুগলী মহসিন কলেজের ছাত্র ছিলেন। অবশ্য ১৮৩৫ সালে ইংরেজ সরকার এর নাম হুগলী মহসিন কলেজ রাখলেও কোনো অব্যাখ্যেয় কারণে দিনে দিনে মানুষের বলায় ও লেখায় এর নামটি দাঁড়ায় শুধু হুগলী কলেজ। মুহসীন শব্দটি ঝরে পড়ে যায়। ১৮৬০ সালের পরে কোনো কাগজপত্রে কিংবা সাইনবোর্ডে আর মুহসীন নামটা দেখাই যায় না। ১৯৩৬ সালে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় কলেজটি মূল নামে ফিরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং সে দাবি অনুযায়ী সরকারিভাবে পুনরায় কলেজটির নাম হয় হুগলি মহসিন কলেজ।
মহসিন ট্রাস্ট তথা মহসিন এনডাওমেন্ট ফান্ড এর সৃষ্টি শুধু হুগলি মহসিন কলেজ নয়। হুগলিতে একটি হাসপাতাল নিয়মিতভাবে এই অর্থে চলছে। মহসিনের সৈয়দপুর ট্রাস্ট এস্টেটের অধিকাংশ জমি ছিল যশোর ও খুলনায়। এই ট্রাস্ট এস্টেটের জমিতে অনেকগুলো দাতব্য হাসপাতাল, সরকারি অফিস, খুলনা-কলকাতা রেললাইন ছাড়াও গড়ে ওঠে অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। খুলনার দৌলতপুরের সরকারি ব্রজলাল কলেজের ৪২ একর জমির ৪০ একরই মহসিনের সৈয়দপুর ট্রাস্ট এস্টেটের জমি। ব্রজলাল কলেজের অনেক আগে ১৮৬৭ সালে মহসিন এনডাওমেন্ট ফান্ড এর অর্থে দৌলতপুরে তৈরি হয় একটি এ্যাংলো ভার্নাকুলার স্কুল। ১৯৩৯ সালে এর নামকরণ হয় দৌলতপুর মহসিন হাই ইংলিশ স্কুল। ১৮৮৬ সালে সরকারি অর্থে খুলনা জেলা স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু কিছুদিনেই স্কুলটি অর্থাভাবগ্রস্ত হয়ে পড়লে সরকারি সেই স্কুলটির জন্যও সরকার মহসিনের সৈয়দপুর ট্রাস্ট এস্টেট থেকে অর্থ মঞ্জুর করেন। এছাড়াও মহসিনের সৈয়দপুর ট্রাস্ট এস্টেটের অর্থে খুলনার দৌলতপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় মহসিন বালিকা বিদ্যালয়, ও মহসিন মহিলা কলেজ।
১৮৭৪ সালে মহসিন এনডাওমেন্ট ফান্ড এর অর্থে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে তিনটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। ঢাকার মাদ্রাসাটি এখন সরকারি কবি নজরুল কলেজ ও চট্টগ্রামের মাদ্রাসাটি এখন হাজি মহম্মদ মহসিন কলেজ। আর রাজশাহিরটি এখন রাজশাহি গভর্নমেন্ট মাদ্রাসা নামে রাজশাহি বোর্ডের অধীনে ইসলামি শিক্ষা শাখায় আই এ সার্টিফিকেট প্রদানের প্রতিষ্ঠান রূপে চলছে।
নবাব আব্দুল লতিফ, নবাব খাজা আব্দুল গণি প্রমুখের আবেদন নিবেদনের ভিত্তিতে ১৮৭৩ সালে সরকার মহসিন এনডাওমেন্ট ফান্ডের অর্থে স্কলারশিপ মঞ্জুরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সরকার আরো সিদ্ধান্ত নেয় যে, যশোর, রংপুর, পাবনা, ফরিদপুর, বাকরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নোয়াখালি ও সিলেট জেলার স্কুলগুলোতে মুসলিম ছাত্রদের দুই তৃতীয়াংশ বেতন ও একজন আরবি শিক্ষকের বেতন এই ফান্ড খেকে দেয়া হবে। ১৯৩১ সালে বেঙ্গল এডুকেশন কোড মহসিন ফান্ডের বৃত্তির পরিমাণ ও সংখ্যা সুনির্দিষ্ট করে দেয়।
বাংলার শিক্ষার জগতে এমন অবদান রাখা লোকটির জীবন ও দর্শন নিয়ে আজ আমাদের কোনোই চর্চা নেই, কোনেই আলোচনা নেই- অকৃতজ্ঞ জাতি হিসেবে এ ঘটনা আমাদের জন্য কতই না আনন্দের!! ২০১২ সালে তার মৃত্যুর দ্বিশতবার্ষিকী গেল। সারাদেশে কোথাও একটি পত্রিকায় ক্রোড়পত্র বের হলো না, একটি সেমিনার হলো না, একটি আলোচনা অনুষ্ঠান হলো না। এমনকি তাঁর দানে প্রতিষ্ঠিত উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনোটিতেও শুনলাম না বা দেখলাম না উল্লেখযোগ্য কোনো আয়োজন। কী চমৎকার আমাদের শিক্ষা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান!!! অবশ্য দুই বছর পরে, ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা একাডেমি একটি আলোচনা সভা করেছিল।
তবে তারপরও দুর্ঘটনা ঘটে। কোলকাতার বিশ্বকোষ পরিষদ (৬০ পটুয়াটোলা লেন, কোলকাতা) এমন একটি দুর্ঘটনা শেষ পর্যন্ত ঘটিয়ে ফেলেছে। এই পরিষদের লোকেরা দ্বিশত মৃত্যুবার্ষিকীকে কেন্দ্র করে এই অসামান্য লোকটির ওপর বাংলা ও ইংরেজিতে সারা দুনিয়ায় এ যাবৎ যাকিছু লিখিত হয়েছে তার প্রায় সবটুকুর একটি সংকলন প্রফেসর ড. আমজাদ হোসেনের সম্পাদনায় প্রকাশ করে ফেলেছেন। সংকলনটির নাম দেয়া হয়েছে ‘হে মহাজীবন’। এ সংকলনে অতীতে লিখিত হাজী মুহসীনের জীবনীভিত্তিক পুস্তিকা ও প্রবন্ধ রয়েছে ২২টি, তাঁকে আশ্রয় করে বিভিন্ন যুগে লিখিত গল্প-উপন্যাস-নাটক-কবিতা রয়েছে ৮টি, স্মারক বক্তৃতা রয়েছে ৪টি এবং তাঁর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও কর্মকা- বিষয়ে প্রাসঙ্গিক প্রবন্ধ ও প্রতিবেদন রয়েছে ১০টি। এছাড়াও বিশ্বকোষ বা চরিতাভিধান জাতীয় অন্তত ১০টি আকরগ্রন্থ থেকে তাঁর বিষয়ক এন্ট্রি বা প্রবন্ধ চয়িত হয়েছে। সবশেষে বর্তমানের বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তি কর্তৃক মুহসীনের জীবন ও কর্ম মূল্যায়নে লিখিত ১০টি প্রবন্ধ রয়েছে। অবশ্য এই সংখ্যা যতো বিশাল মনে হচ্ছে লেখার পরিমাণ ততটা বিশাল নয়। মূলত পুস্তিকা বা প্রবন্ধগুলো কলেবরে বেশ ছোটই, আর তাই এইসব নিয়ে সংকলনটির কলেবর হলো রয়্যাল সাইজের মাত্র ৪৫৬ পৃষ্ঠা।
জীবনীভিত্তিক পুস্তিকা ও প্রবন্ধগুলোর মধ্যে ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে লিখিত মহেন্দ্র চন্দ্র মিত্রের পুস্তিকা ‘লাইফ অব হাজী মহম্মদ মহসীন’ বিশেষভাবে
উল্লেখযোগ্য। ১৮৮০ সালে এই পুস্তিকা বা দীর্ঘ প্রবন্ধটি হুগলী মুহসীন ইনস্টিটিউটে (?) কোনো সেমিনারে পাঠ হয়েছিল। পরবর্তী বেশিরভাগ জীবনীভিত্তিক গ্রন্থ মূলত তথ্যসূত্রে এই গ্রন্থ বা প্রবন্ধটির নিকট ঋণী। এর প্রায় সমসাময়িক সময়ে বা একটু আগে মৌলভি আশরাফউদ্দিন আহমদ ফার্সিতে লিখেছিলেন আরেকটি মৌলিক গ্রন্থ ‘তাবাকাত-এ-মুহসিনিয়া’। এই বইটির অনুবাদও অত্র সংকলনে প্রত্যাশিত ছিল। তবে পুরো অনুবাদ না থাকলেও উক্ত বইটির ভূমিকাসহ প্রাথমিক কিছু অংশ এ সংকলনে রয়েছে। সংকলনভুক্ত উল্লেখযোগ্য জীবনীগ্রন্থ ও প্রবন্ধের মধ্যে আরো রয়েছে ১৯১০ সালে প্রকাশিত এফ. বি. ব্রাডলি-বার্ট এর Haji Mahomed Mohsin, ১৯১৮ সালে প্রকাশিত ইবনে ইমামের ‘এ লাইফ অফ হাজী মহম্মদ মহসিন’ ও ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর ‘মহামানুষ মুহসিন’। সংকলনটির বিশেষ প্রশংসাযোগ্য অন্তর্ভুক্তির মধ্যে আরো রয়েছে মুহসিনের প্রথম মৃত্যুশতবর্ষে ১৯১৩ সালে প্রদত্ত স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বক্তৃতা, নবাব আব্দুল লতিফের A Minute on the Hooghly Mudrussah (1861), রেভারেন্ড লালবিহারী দে’র ‘হিস্ট্রি অব হুগলী কলেজ’, এবং The Deed of Appropriation of Hajee Mohummud Mohsin|
দেখা যাচ্ছে কলেবরটি আশানুরূপ ব্যাপ্ত নয়। কারণ মুহসীন চর্চাই ইতিহাস জুড়ে কিংবা দেশ জুড়ে আশানুরূপ ব্যাপ্ত কখনো ছিল না। একটি প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণাও এ যাবৎ কেউ মুহসীনকে নিয়ে করেননি। তাঁকে নিয়ে চর্চার প্রায় সাকুল্য সংকলনের কলেবর তাই আজ মাত্র ৪৫৬ পৃষ্ঠা। চরমতম অবহেলিত চর্চার এই মহামানুষটির স্মরণে নিবেদিত এই ৪৫৬ পৃষ্ঠার সংকলনটি সংগ্রহে আপনার কি একটুও আকাঙ্খা হয় না?
মুহম্মদ মুহসিন, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক
বাংলাদেশ সময় ১০০৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৫