১৯৮৪ (নাইনটিন এইটি ফোর)—বিখ্যাত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক, সাহিত্য সমালোচক ও সাংবাদিক জর্জ অরওয়েলের অমর গ্রন্থ। ১৯৪৯ সালে তার মৃত্যুর এক বছর আগে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়।
___________________________________
শুরু থেকে পড়তে ক্লিক করুন
৪০তম কিস্তির লিংক
___________________________________
জানালার শার্সিতে ঠেস দিয়ে বসলো উইনস্টন। আর কথা চালিয়ে যাওয়ার কোনো মানেই হয় না। তবে বিয়ারতো খাওয়াই যায়। এই ভাবনা থেকে ঠিক যখন ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখনই দ্রুত গতিতে বুড়ো ছুটলো কামরার পাশের প্রশ্রাবখানার দিকে। অতিরিক্ত আধা লিটার এরই মধ্যে তার ওপর ক্রিয়া করতে শুরু করেছে। নিজের খালি গ্লাসের দিকে স্থির দৃষ্টিতে এক কিংবা দুই মিনিট তাকিয়ে থাকলো, এরপর যখন সম্বিত ফিরলো তখন নিজেকে যে আবিস্কার করলো রাস্তায়। উইনস্টনের মনে হলো, বড়জোর বিশ বছর, এই সময়ে এই যে ‘এখনকার জীবন অতীতের চেয়ে ভালো কি মন্দ ছিলো?’ সে প্রশ্নটিও উবে যাবে। এর আর উত্তরও যেমন থাকবে না, প্রশ্নও অস্তিত্ব হারাবে। কিন্তু এখনই কি এর উত্তর মিলছে? যেখানে অতীতের টিকে থাকা গুটিকয় মানুষ বুঝতেই পারছে না তাদের নিজেদেরই অতীত ভালো ছিলো, নাকি বর্তমানটি ভালো। তারা লাখো অপ্রয়োজনীয় ফালতু বিষয় মনে রাখে, সহকর্মীর সঙ্গে একবার যে বচসা বেঁধেছিলো সে কথা, একবার বাইসাইকেলের হাওয়া চলে গেলে কি কষ্টই না হয়েছিলো, বহু আগে মরে যাওয়া বোনটির চেহারার অভিব্যক্তি, সত্তুর বছর আগে কোনও এক সকালে ঘূর্ণিবাতাসে ধুলোদের উড়োউড়ি পর্যন্ত তাদের মনে ধরে আছে- কিন্তু প্রয়োজনীয় সব সত্যই তাদের দৃষ্টির বাইরে। এরা স্রেফ পিঁপড়ার মতো, কেবল ছোট ছোট বস্তুই দেখতে পায়, বড় বস্তু চোখেই পড়ে না। স্মৃতি যখন ব্যর্থ, আর নথিগুলো মিথ্যায়নে সিদ্ধ- তখন পার্টির তরফ থেকে জীবন মান উন্নয়নের সকল দাবিই ধোপে টিকে যায়, কারণ এমন কোনও মান অতীতে ছিলো বলেই জানা নেই যার সঙ্গে এর তুলনা করার সুযোগ থাকবে।
ঠিক এই সময়টিতেই উইনস্টনের ভাবনার ট্রেন হঠাৎ থমকালো। সে থামলো, আর চোখ তুলে তাকালো। তখন সে এক সরু রাস্তায়, অন্ধকারে গোটা কয় দোকান বাসাবাড়ির গুলোর মাঝে স্থান করে নিয়েছে। ঠিক তার মাথার উপর ঝুলছিলো তিনটি রংচটা ধাতব বল, দেখে মনে হচ্ছে একসময় এগুলো চকচকেই ছিলো। স্থানটি তার চেনার কথা। অবশ্যই চেনে! সে এখন ঠিক সেই ভাঙারির দোকানের সামনেই দাঁড়িয়ে যেখান থেকে একদা ডায়রিটি কিনেছিলো।
একটি ভয়মাখা ব্যাথা তার শরীরের ভেতর দিয়ে বয়ে গেলো। নোটবুকটি কেনাই ছিলো এক মস্ত অপরাধ, তখনই শপথ করেছিলো এই পথ আর মাড়াবে না। তবে ভাবনাকে মুক্ত কর দিয়ে সে বুঝলো, সেতো নয়, এ যে তার পদযুগল, যা তাকে টেনে এনে দাঁড় করিয়েছে এই দোকানের সামনে। ডায়রি লেখা শুরু করেও নিজেকে রক্ষার যে আশাটুকু ছিলো, এই কাজ সেই আশা বাঁচিয়ে রাখার জন্যও সর্বনেশে। সে দেখলো তখন রাত নয়টা বাজে কিন্তু এই রাতেও দোকানটি খোলা। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে ভেতরে ঢুকে পড়াই হবে কম সন্দেহের এমন একটা ভাবনা থেকে দরজাপথে পা বাড়ালো সে। কেউ যদি জেরা করে, বলতে পারবে রেজর ব্লেড কেনার জন্যই আসা।
দোকান মালিক একটি ঝুলন্ত তেলের কুপি জ্বালিয়েছে মাত্র। কুপি থেকে অল্প আলো আর মোহময় একটা ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছে। ষাটের কোটায় বয়স, দুর্বল, ঝুঁকে পড়া শরীর, লম্বা টিকালো নাক, মৃদু চাহুনি যা চশমার মোটা কাচে বিঘিœত। মাথার চুল অনেকটাই পেকে সাদা, তবে ঘন ভ্রু-যুগল এখনো কালো। চশমায়, ভদ্র-সøথ নড়াচড়ায়, আর পরনের কালো ভেলভেটের জ্যাকেটে এক ধরনের বুদ্ধিদীপ্তীর ছাপ। মনে হবে লোকটি শিক্ষিত, অথবা শিল্পীও ভেবে বসতে পারেন। কণ্ঠ অনুচ্চ মোলায়েম, আর উচ্চারণ অধিকাংশ প্রোলদের চেয়ে আলাদা।
ফুটপাতে তোমাকে দেখেই চিনে ফেলেছি, বললো দোকানি। ‘তুমি তো সেই, সেবার তরুণীর শ্যুভেনির অ্যালবামটি কিনলে। কাগজগুলো খুবই সুন্দর। বলা হতো ক্রিম-লেপা কাগজ! অমন কাগজ আর তৈরিই হয় না- আমি বলবো গত পঞ্চাশ বছরে দেখিনি। ’ চশমার কাচের উপর দিয়ে চোখ তুলে উইনস্টনের দিকে তাকালো সে। ‘তোমার বিশেষ কিছু চাই? নাকি স্রেফ দেখার জন্য এলে?’
‘এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম, অনিশ্চয়তার সুরে উচ্চারণ উইনস্টনের। ‘মনে হলো একটু ভেতরে ঢুকি। বিশেষ কিছু চাই না। ’
‘সে ভালো বটে’ বললো লোকটি। ‘আমারও মনে হয় না, তোমার ভালো লাগবে এমন কিছু আছে,’ নরম করতল ঘষে ঠিক ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গি তার। ‘দেখতে পাচ্ছো দোকানের দশা। একেবারে খালি বলতে পারো। তোমাকে একটা কথা বলি, আমার মনে হয় প্রাচীন পণ্যের বাজার শেষ হতে বসেছে। ওগুলোর আর কোনও কদর নেই, চাহিদা নেই আর মজুদও নেই। আসবাব, চিনামাটির তৈজষ এসব ভাঙতে ভাঙতে শেষ, ধাতব পাত্র-পদার্থতো দিনে দিনে গলে গেছে। পিতল-দস্তা আর তামার মিশেলে যে মোমদানি হতো তা কত বছর দেখি না!’
৪২তম কিস্তির লিংক
বাংলাদেশ সময় ১৯২৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৫
শিল্প-সাহিত্য
প্রতিদিনের ধারাবাহিক
১৯৮৪ | জর্জ অরওয়েল (৪১) || অনুবাদ: মাহমুদ মেনন
অনুবাদ উপন্যাস / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।