ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ডিশওয়াশার্স ড্রিম: আদনান সৈয়দের আমেরিকানামা

শিল্প-সাহিত্য ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৫
ডিশওয়াশার্স ড্রিম: আদনান সৈয়দের আমেরিকানামা

যদি বলা হয় বর্তমান সময়ে আমেরিকার মুলধারায় আলাউদ্দিন উল্লাহ একমাত্র বাঙালি জনপ্রিয় কমেডিয়ান তাহলে কথাটি কোন অংশেই বাড়িয়ে বলা হবে না। তবে হ্যা, জন্মগত ভাবে তিনি আমেরিকান তবে তার বাবা হাবিব উল্লাহ ছিলেন বাংলাদেশের নোয়াখালি অঞ্চলের লোক।

জাহাজের খালাসি হয়ে হাবিব উল্লাহ আমেরিকার বন্দরে নোঙর ফেলেছিলেন সেই ১৯৪০ সালের দিকে। সে এক অসাধারন গল্প। তবে সে গল্প শোনা আগে চলুন তার ছেলে  আলাউদ্দিন উল্লাহ সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেয়া যাক। তিনি বড় হয়েছেন স্পেনিশ হারলেমে। বাংলা কিছু শব্দ ভাংগা ভাংগা ভাবে উচ্চারণ করতে পারেন।   অস্থি মজ্জায় তিনি আমেরিকান হলে কি হবে তিনি তার পূর্বপুরুষদের ভুলে যান নি। আমেরিকায় বাংলাদেশি অভিবাসীদের গোড়াপত্তনের ইতিহাস, তাদের আচার এবং জীবনের নানান বাঁক নিয়ে নির্মান করছেন তথ্যচিত্র ’বেঙ্গলি হারলেম’। তার সাথে রয়েছেন লেখক ভিভেক বাল্ড। তবে আলাউদ্দিন উল্লাহর মুল পরিচয় তিনি আমেরিকার একজন সফল কমেডিয়ান। তার ’ডিশওয়াশার্স ড্রিম’ আমেরিকায় বেশ সাড়া জাগিয়েছে।   ’ডিশওয়াশার্স ড্রিম’ মূলত আলাউদ্দিন উল্লাহ এবং তার বাবার জীবন থেকে নেওয়া কিছু গল্প। হাস্য কৌতুকরস মিলিয়ে তিনি সেই গল্প উপস্থান করেন বটে কিন্তু সেই গল্পগুলোর পেছনে রয়েছে তার বাবা হাবিব উল্লাহর জীবন যুদ্ধের চিত্র। পাশাপাশি আলাউদ্দিন উল্লাহ তার নিজের গল্পটিও বলতে চান ’ডিশওয়াশার্স ড্রিম’ এর মাধ্যমে। আালাউদ্দিন উল্লাহর সাথে যখন আমার কথা হয় তখন তিনি প্রচন্ড ঠান্ডা এবং সায়নাসে ভুগছিলেন। জানা ছিল তিনি প্রচন্ড ব্যাস্ত একজন মানুষ। তারপরও তার শত ব্যাস্ততার মাঝেও কথা বলতে রাজি হলেন। মনে মনে ভাবালাম একেই বলে বাঙালি রক্তের দাবী। চলুন তার মুখ থেকেই শুনি তার কথাগুলো।

”দেখুন, ’ডিশওয়াশার্স ড্রিম’ কে যদি আপনি শুধুমাত্র একটি কমিক শো মনে করেন তাহলে বড্ড ভুল করবেন। বরং ’ডিশওয়াসার ড্রিম’ হাজারো ইমিগ্রান্টদের বুকে জমানো দীর্ঘশ্বাসের গল্প। একটা ঘটনা বলি। কিছুদিন আগে হলিউডের একটা সিনেমায় অভিনয় করার জন্যে আমার ডাক পরে। চরিত্রটি ছিল একজন মুসলমানের ভুমিকায় নেগেটিভ রোল করতে হবে যেখানে মুসলমানটি ছিলেন একজন টেররিষ্ট। তখন আমি তাদের বললাম যে মুসলমান মানেই কি টেররিষ্ট? মুসলমানদের এভাবে চিহিৃত করার কারণ কি? পৃথিবীর সব মুসলমানদের এভাবে বিচার করা কতটুকু যুক্তিসংগত? আমার বাবাও তো মুসলমান। তাহলে তিনিও কি টেররিষ্ট ছিলেন? আমি সাথে সাথেই তাদের সাথে কাজ করবো না বলে চুক্তি বাতিল করে দিলাম। গল্পটা বলার একটা কারণ আছে। বর্তমান এই সভ্য দুনিয়ায় আমেরিকানদের মানসিকতা যদি এই হয় তাহলে  ভাবুন আমার বাবা যখন সেই ১৯৪০ সালের দিকে নিউইয়র্ক এসেছিলেন তখন তার অবস্থাটানটা কত করুণ ছিল? তখন জাতিগত বিদ্বেষ ছিল খুব সাধারণ একটি ঘটনা। জানেনতো,  পঞ্চাশ এর দশকে আমেরিকায় ’রেসিজম’ ছিল খুব সাধারন একটি বিষয়। এর করুন পরিনতির শিকার হতেন আমার বাবার মত সাধারণ মানুষজন। আমার বাবা সেই সময় ইংরোজিতো দূরের কথা বাংলাও ঠিকমত লিখতে পড়তে পারতেন না। খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাদের কে ’অড জব’ বেছে নিতে হত । তারা কেউ ডিশওয়াসার, কেউ হাট ডগ বিক্রেতা, কেউ ডোর মেন, কেউ কারখানার শ্রমিক ইত্যাদি পেশা বেছে নিতে হত। আমার বাবা কাজ করতেন রেস্তোরায় ডিশওয়াসার হিসেবে। তার  কাছে শুনেছি তিনি কত বিচিত্রভাবেই না এই আমেরিকার সমাজে ঘৃনার শিকার হয়েছিলেন। এখন সময় পরিবর্তন হয়েছে। আমেরিকার সমাজ ব্যাবস্থায় আধুনিকতার ছোওয়া লেগেছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে পুষে রাখা সেই মানসাকিতার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। বলতে পারেন ’ডিশওয়াশার্স ড্রিম’ কমিডিকে আশ্রয় করে আমার একটি প্রতিবাদের ভাষা। আমি সেই প্রতিবাদটুকু শৈল্পিকভাবেই বলে যেতে চাই।

সত্যি বলতে ছেলেবেলায় বাবার সাথে আমার একটা দুরত্ব ছিল। বাবার চিন্তা-মনন, বিশ্বাস আমার থেকে ছিল ভীন্ন। তিনি ছিলেন মনে প্রাণে বাংলাদেশি। বাবার চিন্তা বা প্রতিবাদের ভাষা আমি কখনো বুঝতে পারতাম না। আমি ছিলাম স্বাধীনচেতা। মুক্তমনে দেয়ালে প্রতিবাদী চিত্র আঁকতাম। বাবা তা পছন্দ করতেন না। পরবর্তীকালে বুঝতে পেরেছিলাম বাবার প্রতিবাদের ভাষা ছিল আরো স্পষ্ট, আরো দৃঢ়।    তাছাড়া তিনি জীবনের শেষের দিকে উচ্চ রক্তচাপজনিত রোগে ভুগতেন। তবে বাবার কথা মনে হলেই শুধু মনে হয় অভিবাসী হওয়ার শত যন্ত্রনায় ছটফট করা একটি মুখ। তিনি হয়ত প্রতিনিয়ত তার ছোট্ট বুকে সেই যন্ত্রনাগুলো  আজিবন লালন করেছেন যা আমরা কখনো বুঝতে পারিনি’’।

অ্ালাউদ্দিন উল্লাহ যখন কথা বলছিলেন তখন আমার চোখে ভেসে আসছিল তার বাবা হাবিব উল্লাহর মুখচ্ছবিটি। হাবিব উল্লাহর মত আরো কত নাম না জানা এই মানুষগুলো সবরকমন কষ্ট সহ্য করে আর ধৈর্যকে পুজি করে এই আমেরিকায় তাদের নোঙরটি ফেলেছিলেন। সেই কঠিন সময়ের গল্পটি আমরা কজন জানি বা জানতে পারি?  সেই উনিশ শতকের গোড়ার দিকে যখন বাঙালিরা প্রথম আমেরিকায় পা রাখেন তখন তারা কেউ ছিলেন জাহাজের ইঞ্জিন রুমের হেলপার, কেউ ছিলেন ’বয়লার বয়’ আবার কেউ ছিলেন ¯্রফে জাহাজের খালাসি। মূলত জাহাজকে আঁকড়ে ধরেই শুরু হয়েছিল বাঙালির আমেরিকায় বসবাসের প্রাথমিক অভিবাসন প্রক্রিয়া। আমেরিকার কোন বন্দরে জাহাজ যখন ভীরতে যাবে সেই মোক্ষম সময়ে তারা রাতের অন্ধকারে  লুকিয়ে জাহাজ থেকে টুক করে সমুদ্রে ঝাপ দিতেন। তারপর সাঁতার কেটে আমেরিকার মাটি স্পর্শ করে শুরু করতেন তাদের নতুন জীবনের গল্প। তাদেরকে বলা হত ’শিপ জাম্পার’। অবশ্য অনেক শিপ জাম্পারদের আবার আক্ষরিক অর্থে জাহাজ থেকে ’জাম্প’ দিতে হত না। জাহাজ বন্দরে ভীরলে কেপটেন সাহেব জাহাজের সব খালাসী এবং কর্মচারীদের নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে ’বিনোদন টোকেন’ দিতেন। সেই টোকেন দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল জাহাজে নিয়োজিত কর্মচারীদের মানসিকভাবে প্রনোদিত করা। সে লক্ষ্যে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে তাদের কে জল থেকে ডাঙায় সময় কাটানোর সময় দেওয়া হত এবং তারপর আবার জাহাজমুখি হওয়া। কিন্তু সবাই কি তা করতেন? অনেকেই নতুন জীবনের আশায় ’শিপ জাম্পার’ হয়ে যেতেন।

কেমন ছিল সেই শিপ জাম্পারদে জীবন? তাদের জীবনের নানান বাঁক নিয়ে জানতে পারি  আমেরিকান লেখক ভিভেক বাল্ড লিখিত ’বেঙ্গলি হারলেম’ এর মাধ্যমে। চলুন তার চোখ দিয়েই দেখা যাক সেই উনিশ শতকের গোড়ার দিকে নিউইয়র্ক শহরে বাঙালি অভিবাসীদের অবস্থাটা কেমন ছিল? ১৯৩০ সালের নিউইয়র্কে তৈরি করা একটি সমীক্ষায় দেখা যায় যে এরা মূলত বিভিন্ন পেশায় নিজেদের নিয়োজিত ছিলেন। তাদের বেশিরভাগই কাজ করতেন ডিশওয়াসার, ফেরিওয়ালা, ডেলিভারিম্যান, রানার, লন্ড্রি ওয়ার্কার, মেকানিক, স্ট্রিট ভেন্ডর, হাট ডগ বিক্রেতা হিশেবে। এদের কেউ কেউ নিউইয়র্কের ব্যাস্ত জনপদের অলিতে গলিতে চোখ ধাঁধানো সৌখিন ’সিল্কের কাপড়’ ফেরী করে বেড়াতেন । ১৯৪০ সালের দিকের ঘটনা। হেলেন উল্লাহ নামে ই্স্ট হারলেমের একজন স্পেনিশ অভিবাসী যিনি সেখানে এক বাঙালিকে বিয়ে করে ঘর সংসার করছেন। তিনি জানাচ্ছেন তার স্বামী সাদ ’ভিক্টর’ উল্লাহ একজন হাট ডগ বিক্রেতা ছিলেন। সাদ ’ভিক্টর’ উল্লাহ ছিলেন পূর্ব বাংলা থেকে আসা বাঙালি মুসলমান। তিনি প্রতিদিন তার হাট ডগ ইস্ট হরলেমের মেডিসন এভিনিউ, লেক্সিনটন এবং থার্ড এভিনিউর বিভিন্ন রাস্তায় বিক্রি করতেন। শুধু আমেরিকান নয় সাদ উল্লাহর খদ্দের ছিল অনেক ভারতীয় থেকে শুরু করে কালো মুসলমান পর্যন্ত। কারন সব খদ্দেরদের বিশ্বাস ছিল যে আর যাইহোক সাদ উল্লাহ তার হাট ডগে শুয়োরের মাংস মেশাবেন না। তবে সেই উনিশ শতকের প্রথম দিকে বাঙালি হাট ডগ বিক্রেতার সংখ্যা তেমন ছিল না। পরবর্তীতে সাদ উল্লাহ হাট ডগ বিক্রির পাশাপাশি ভারতীয় মশলাপাতিও বিক্রি করা শুরু করেন যা ইস্ট হারলেমে যথেষ্ঠ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তবে বেশির ভাগ বাঙালি শিপ জাম্পারদের প্রিয় কাজটি ছিল ডিশওয়াসার বা রেস্তোঁরা নির্ভর কাজকর্ম।   দেখা গেছে অনেকেই ডিশওয়াসারের কাজ করে হাত পাকিয়ে  নিজেরাই  রেস্তোরা ব্যাবাসা খুলে বসেছিলেন। ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত বেশ কয়েকটি রেস্তোরা বাঙালি মালিকানায় ইস্ট হারলেম সহ মানহাটনের বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয় । সেগুলোর মধ্যে ১৯৪৯ সালের দিকে হাবিব উল্লাহ এবং ইব্রাহীম চৌধরীর যৌথ মালিকানায় মানহাটনের নাটক পাড়া বলে ক্ষ্যাত টাইমস স্কোয়ারে প্রতিষ্ঠিত ’বেঙ্গল গার্ডেন’ রেস্তোরার নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য।

বলার অপেক্ষা রাখে না সেই উনিশ শতকের গোড়ার দিকে সব বাঙালি অভিবাসি শিপ জাম্পারদের চোখ ছিল নিউইয়র্কের দিকে। কোন রকম নিউইয়র্ক ঢুকতে পারলেই বুঝি জীবনের গতি হয়ে যাবে। এরা অনেকেই নিউইয়র্ক শহরের হারলেম উপকন্ঠে নিজেদের বসতি গড়তেন। কেউ কেউ কোন কৃষ্ণাঙ্গ বা স্পেনিশ মহিলাকে বিয়ে করে সেখানে স্থায়ী হয়ে যেতেন। নিউইয়র্কে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সমযে বাঙালিদের মাঝে পুরতেরিকান মেয়ে বিয়ে করার যেন ধুম পরে যায়। হারলেম তখন পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে আসা শ্রমজীবি মানুষের শহর। বিশেষ করে আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজন হারলেমের বিভিন্ন জায়গায় তাদের বাসা বাধে। হারলেমকে তখন বলা হত, ’ নিউইয়র্কের স্বপ্নপুরনের শহর’। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নির্যাতিত আর দুখি মানুষের শহরে পরিনত হয় হারলেম। হারলেম যেন ইংল্যান্ড, কারাবিয়ান, আফ্রিকান, জামাইকান, বাহামাস, লেটিনোস, দক্ষিন এশিয়া সহ বিভিন্ন দেশের মানুষের তীর্থস্থান। হারলেমের এই শ্রমজীবি মানুষের গোড়াপত্তন শুরু হয় ১৯১০ সাল থেকে ১৯৩০ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত। বলা প্রয়োজন যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি বা ভারতীয় বাঙালিরা সাধারণত পূর্ব হারলেম অর্থাৎ স্পেনিশ হারলেমেই থাকার জন্যে বেছে নিতেন। পূর্ব হারলেম হল ম্যানহাটনের দক্ষিনে ৯৬ রাস্তা পূর্বদিক থেকে শুরু আর পাঁচ এভিনিউর ১১০ রাস্তার উত্তরে ১৪২ রাস্তা পর্যন্ত বিস্তৃত।

চলুন এবার হাবিব উল্লাহর জীবনের গল্পটি জেনে নেই।   হাবিব উল্লাহকে জানতে হলে ১৯৪৯ সালের নিউইয়র্ক শহরের ব্যাস্ততম নাটক পাড়া বলে ক্ষ্যাত টাইম স্কোয়ারের  ৪৬ রাস্তায় এক ছত্র ঘুরে আসাটা জরুরী। সেই সময়েও টাইম স্কোয়ার ছিল নিউইয়র্ক শহরের প্রাণ। রাস্তার চারপাশে বিভিন্ন রকম মানুষের আনাগোনা, নাটকের বিজ্ঞাপণ নিয়ে হকারদের আর্ত চিৎকার আর চেঁচামেচি। এই ব্যাস্ততম জায়গাতেই ’বেঙ্গল গার্ডেন’ নামে একটি রেঁস্তোরা। রেঁস্তোরাটিতে ঢুকতেই দেখা পাবেন একজন হাসিখুশি মাখা পুরতেরিকান মহিলা যিনি আপনাকে স্বাদর সম্ভাশন জানিয়ে রেস্তোরায় আমন্ত্রন জানাবেন। তার নাম ভিকতোরিয়া ইচেভারিয়া উল্লাহ। রেঁস্তোরার পেছনে দেখতে পাবেন একজন ভদ্র জামা-কাপড় পরিহিত দক্ষিন এশিয়া থেকে আসা বাদামি বর্ণের মানুষের সাথে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে তিনি বুঝি তার অফিস কক্ষে বসে খদ্দের বা বন্ধু-বান্ধবদের সাথে বাংলা, হিন্দি এবং ইংরেজি মিলিয়ে আড্ডায় মশগুল হয়ে আছেন। তার নাম ইব্রাহিম চৌধুরী। ইব্রাহিম চৌধুরী ’বেঙ্গল গার্ডেন’ রেস্তোঁরার অন্যতম একজন অংশীদার। ইব্রাহিম চৌধুরী বাংলাদেশ থেকে আগত। প্রাক্তন শিপ জামপার। এবার চলুন ’বেঙ্গল গারডেনে’র একেবারে পেছনের দিকে রসুইঘরটায় একটু উকি দিয়ে আসি। সেখানে দেখা যাচ্ছে একজন বাঙালি ভদ্রলোক রান্না বান্নার কাজ নিয়ে মহা ব্যাস্ত। কখনো তিনি এঁটো বাসন, হাড়ি-পাতিল ধূয়েমুছে পরিস্কার করছেন, কখনো গরম গরম রান্না  খদ্দেরদের জন্যে প্লেটে তুলে দিচ্ছেন আবার একই সাথে রান্নাঘর পয় পরিস্কারটিও নিজের হাত দিয়ে করছেন। খুব ব্যাস্ত আর পটু হাতে সব কাজ তিনি নিজেই একসাথে করে যাচ্ছেন। ভদ্রলোকের নাম হাবিব উল্লাহ। তিনি এসেছেন বাংলাদেশের নোয়াখালি অঞ্চল থেকে। একসময় জাহাজের খালাসি ছিলেন। তিনিও ’বেঙ্গল গার্ডেন’ রেস্তোরার অন্যতম মালিক এবং অংশিদার। হাসিখুশি পুরতেরিকান মহিলা ভিকতোরিয়া ইচেভারিয়া হলেন তার স্ত্রী।

 রেস্তোঁরায় এই তিনজন কর্মকর্তা তারা সবাই আমেরিকায় এসেছিলেন ১৯২০ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যেই। এদের মধ্যে ইব্রাহিম চৌধুরী এসেছিলেন সবার আগে। জানা যায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানে থাকাকালিন সময়ে ছাত্র রাজনীতির সাথেও জড়িত ছিলেন। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের কারনে তিনি গা ঢাকা দিয়েছিলেন এবং ভারতে পালিয়ে যান। সেখানে জাহাজের খালাসির কাজ নিয়ে আমেরিকায় চলে আসেন। হাবিব উল্লাহ আমেরিকায় অভিবাসি হোন ১৯৪০ সালের দিকে।   মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে তিনি  বাড়ি ছেড়ে কলকাতা চলে যান এবং সেখানে একটি জাহাজে খালাসির কাজ নেন। জাহাজটি যখন বোস্টনের বন্দরে ভীড়তে যাবে ঠিক সেই মোক্ষম সময়ে হাবিব উল্লাহ জাহাজ থেকে লাফিয়ে পরেন। হাবিব উল্লাহ তার ভাগ্য উন্নয়নের জন্যে নিউইয়র্ক আসেন। নিউইয়র্কে এসেই তিনি ডিশওয়াশার এর কাজে নেমে পরেন। হাবিব উল্লাহ পরবর্তীতে পূর্ব হারলেমের লেক্সিনটন এভিনিউর সাবওয়ের দিকে আরো কিছু বাঙালির সাথে থাকতে শুরু করেন। পূর্ব হারলেমেই ভিকতোরিয়ার সাথে হাবিব উল্লাহর পরিচয়, প্রেম এবং বিয়ে। ভিকতোরিয়া ইচেভেরিয়া তখন সবেমাত্র  পুরতেরিকো থেকে আমেরিকায় এসেছেন। তিনি তার সাত বোনের মাঝে সবেচেয় বড় এবং যখন তার বয়স উনিশ ঠিক তখনই তার বাবা হ্ার্ট এটাক করে মারা যান। পূর্ব হারলেমে আগে থেকেই ভিকতোরিয়ার খালা এবং তার খালাতো ভাইবোনরা থাকত। তিনি তাদের সাথেই থাকতে শুরু করলেন। ভিকতোরিয়া একটি ফেক্টরিতে কাজ করতেন এবং তখনই হাবিব উল্লাহর সাথে পরিচয় হয়। হাবিব উল্লাহকে বিয়ে করে ভিকতোরিয়া সুখী হয়েছিলেন। ভিকতোরিয়ার মাকে লেখা একটি চিঠিতে সেই আভাস পাওয়া যায়। তিনি লিখছেন,” হাবিব উল্লাহকে বিয়ে করে আমি অনেক সুখি। সে সত্যিকার অর্থেই একজন ভালো মানুষ। আরো আশ্চর্য্য হবে সে একজন ভারতীয়’। বিয়ে করে হাবিব উল্লাহ এবং ভিকতোরিয়া স্পেনিশ হারলেমের পূর্ব ১০২ রাস্তায় একটি পাঁচতলার বাড়ির দ্বিতীয় তলায় উঠেন এবং সেখানেই তাদের সুখের সংসার পাতেন।

জানা যায় হাবিব উল্লাহ এবং ইব্রাহিম চৌধুরীর প্রতিষ্ঠিত ’ বেঙ্গল গার্ডেন’ রেস্তোঁরাটি মাত্র বছর দুয়েক চলেছিল। হাবিব উল্লাহ জুনিয়রের ভাষায়, ” সে সময়ে রেস্তোরাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার মূল কারণ ছিল আমেরিকানদের জিহ্বায় সেই ভারতীয় খাবার তখনো এত জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারে নি। তাদের ভাষায় ’’কারি?, এটা আবার কি জিনিষ’’?। তাদের দৃষ্টিতে আমাদের খাবার মানেই প্রচন্ড ঝাল বা ’স্পাইসি’। সে কারণে রেঁস্তোরা খুব বেশিদিন টিকিয়ে রাখা গেল না। ’’ হাবিব উল্লাহ রেস্তোরাটি বন্ধ করে দিয়ে আবার তার পুরনো পেশায় ফিরে যান।   এরই মধ্যেই একদিন ভিকতোরিয়া মারা গেলেন। ভিকতোরিয়ার কোলে তখন হাবিব উল্লাহর দুই সন্তান। প্রথম প্রথম সন্তান হাবিব জুনিয়র এবং দ্বিতীয়টি হুমায়রা। হাবিব উল্লাহ বয়স তখন ৫২। তিনি দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর আবার তার নিজ জেলা নোয়াখালিতে গেলেন এবং সেখানে খুব অল্প বয়স দেখে একটি মেয়েকে বিয়ে করে নিউইয়র্কে নিয়ে আসেন। কিছুদিন পর তাদের ঘর আলোকিত করে একটি সন্তানের জন্ম নেয় । হাবিব উল্লাহ সন্তানের নাম রাখেন আলাউদ্দিন উল্লাহ। এই সেই আলাউদ্দিন উল্লাহ যিনি আমেরিকায় ’ডিশওয়াশার্স ড্রিম’ কমিক করে বর্তমানে  ক্ষ্যাত।

সন্দেহ নেই শিপ জাম্পার হাবিব উল্লাহ আমেরিকার কঠিক পাথুরে মাটিতে যে পায়ের ছাপটি অনেক পরিশ্রম আর ভালোবাসায় রেখে গেয়েছিলেন তারই সন্তান আলাউদ্দিন উল্লাহ সেই পদছাপটিকে যেন সযতেœ আগলে ধরে বেঁচে থাকতে চান। ”ডিশওয়াশার্স ড্রিম’’ কমিডিটি যেন তারই স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। হাবিব উল্লাহ নামটি তখন কোন আর ব্যাক্তি মানুষে মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকে না। হাবিব উল্লাহ মানেই যেন অজ¯্র নামহীন গোত্রহীন বাঙালি অভিাবাসীদের কন্ঠস্বর। তখন নিউইয়র্কের হাবিব উল্লাহ, বোস্টনের ইব্রাহিম চৌধুরী, নিউ ওরলিয়েন্সের জয়নাল আবেদিন, সফুর আলি, নিউ জার্সির ফারুক আলি তাদের মাঝে কোন ফারাক থাকে না। তারা কেউ ছিলেন জাহাজের খালাসি, কেউ মেশিন হেলপার কেউ বয়লার বয় কিন্তু তারা সবাই ছিলেন স্বপ্নচারী। নতুন জীবনের সন্ধানে তারা তাদের বীজটি রোপন করেছিলেন আমেরিকার শক্ত মাটিতে। জীবনের মায়া তুচ্ছ করে নিজ প্রিয় মাতৃভুমি ত্যাগ করে আমেরিকায় সুখের খোজে তারা সবাই পাড়ি জমিয়েছিলেন। খুব জানতে ইচ্ছে করে জীবনকে ভালোবেসে যে যুদ্ধটি এই হাবিব উল্লাহারা শুরু করেছিলেন সেই জীবন যুদ্ধের কুল কিনারা সত্যি কি কিছু হয়েছে? নাকি অভিবাসীর গল্প মানেই ত্যাগ আর দুখে ভরা কিছু গল্পমালা? বুকের পাজরের নীচে জমে থাকা চাপা আর্তনাদ ? 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।