ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

প্রথম দশকের কবিতার সমালোচনা

পুরানা বলদ নতুন বউ | সাখাওয়াত টিপু

সমালোচনা / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ৩, ২০১৫
পুরানা বলদ নতুন বউ | সাখাওয়াত টিপু

তথাকথিত বাংলা আধুনিক কবিতার ইতিহাস ঘৃণার ইতিহাস। হিংসার ইতিহাস।

কে কেমন করিয়া কষে হিংসা আর ঘৃণা প্রকাশ করিতে পারে তাহাই আধুনিক কবিতার মাহিসওয়ার। চুলাচুলি দলাদলি আর গলাগলি মিলিয়া বাংলা কবিতা আদমসন্তান হইয়া খাড়াইল নাকি শুইয়া পড়িল? তাতে কি বাংলা কবিতার দুই-চারআনা আনাজপাতি সাহিত্যের গোলায় উঠিল? কে জানে? যাঁহারা তমসায় লিপ্ত (চুলাচুলি দলাদলি আর গলাগলি) তাঁহারা হয়ত জানেন বাংলা কবিতা কেমন মাদাম তুসোর জাদুঘর বানাইল! আমরা জানি, জাদুঘরের এইসব জড়বস্তু আগুন বাদে টুপটুপ করিয়া গলিতে থাকে? গলিয়া শেষ নাগাদ অসারেই পরিণতি ঘটে।

কোনও সংকলন কাউকে কবি বানায় না। বানানোর সাধ্য তাহার নাই। যদি থাকে তো হরেদরে কুটিকুটি ‘বাছাই’, ‘শ্রেষ্ঠ’, ‘সেরা’ নানা তকমা মারিয়াও ওইসব সংকলন নিজেদের পতন ঠেকাইতে পারে না। মানিতে হইবে, তকমা আটা পুঁজিবাদের নয়া এস্তেমাল। জিজ্ঞাসা জাগে, কেন তাহা ঠেকাইতে পারে না? বেশিরভাগ সংকলকদের প্রধান উদ্দেশ্য থাকে ‘আমি’ নামক মালটাকে অপরের কাছে জাহির করা। জাহিরের বাসনার নামই বাতিক রোগ! ফলে এইসব তকমা সমাজে নতুন কিছু হাজির করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়। অন্যদেশের কথা বিশেষ বলিতে পারিব না। তবে বাংলাদেশে দশকে দশকে এইসব ব্যর্থতার ইতিহাস আমরা দেখিয়াছি। ভবিষ্যতও দেখিবে। হয়ত এইসব গনিমতের মালে নক্তাবাদী আঁচড় থাকিতে পারে! আঁচড় কাটিবার মামলাই ইহার সফলতা! তবে কোনও সংকলনের সংকলক হয়ত আমিত্বের কানাগলির কারণে সেই ব্যর্থতার ইতিহাস নাও দেখিতে পারেন! আমরা চোখে আঙ্গুল দিব না, চোখের বাহিরে আঙ্গুল রাখিয়া দেখাইতে পারিব তাহা। শুদ্ধ আমিত্বের ব্যর্থতার সহিত বাতিক রোগের সম্পর্ক—ইহা মনোবিজ্ঞানের কথা।

ইতিহাস কয়—শহীদের সহিত মহত্বের সম্পর্ক। অনেকেই ‘আমি’ ‘আমি’ করিয়া নিজে নিজে ‘শহিদ’ (প্রাণ সংহারী) হয়েন। ইহা তো নিজের ফ্যাসিবাদী চরিত্রেরই বহিঃস্খলন। নিজেই নিজেকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করিয়া সাবাড় হয়েন। সমাজ ইহাকে বিশেষ মহত্ব দান করিতে চাহে না। না করিবার বড় কারণ, সমাজের অপর পদ আর পদার্থের সহিত তাঁহার কোনও হিত সম্পর্ক নাই। অপরের হিত করিবার বাসনায় যিনি শহিদ হয়েন সমাজ তাঁহাকে মহৎ বলিয়া গণ্য করিয়া থাকে। ইহাই সমাজ ইতিহাসের চলরীতি। আর সাহিত্য ইতিহাসেরও অন্তর অর্থ ‘হিত সহ যা’। সকলের হিত ধর্ম যাহাতে বিরাজ করে। হিতের অপর কোঠা হত। হইতো—হয় তো মন্দ নহে। মানে হিতের লাগিয়া নিহত হওয়া। মহত্বের এহেন ভাবগত অর্থ কি কথিত মহৎ কবিতার আত্মীয় নহে? পাঠক আরও সদুত্তর থাকিলে জানাইলে প্রীত হইব?

২.
একদিন স্নেহভাজন মাদল হাসান দূরালাপে বলিলেন, ‘আপনারে একটা কাজ করিতে হইবে। ’ জিজ্ঞাসিলাম, ‘কী কাজ?’ কহিলেন, ‘নতুন সংকলনের ভূমিকা লিখিতে হইবে। ’ মুখে মুখে মাদলের কড়া সমালোচনা করিয়াছি নানাসময়ে। আলোচনার সম দুই অর্থে। লিখিত করি নাই। শুধু মাদল নয়, এখন দেখি তাঁহার অপর বন্ধুদেরও সমালোচনা করিতে হইবে! মনে মনে ভাবিলাম, কী কেন কার কারণে না জানিয়া না বুঝিয়া আরেক ‘ব্যর্থতার লাশ’ কাধে লইব? অথবা হইতে পারে ইহা একখানা কবিতা ‘জাতীয়’ কর্তব্য বটেন। এহেন কর্তব্য খানিকটা জন্মসূত্রের সন্ধান, খানিক সাহিত্য উৎপাদন সম্পর্কের ব্যাপার। নাকি?

কহিলাম, কিসের সংকলন?
উত্তরে মাদল, শূন্যের।
কাঁহার?
—তালাশ তালুকদার ইহার সংকলক।
তালুকদারের সহিত জানাশোনার কোনও তালাশ নাই।
—সেঁ আপনার সহিত কথা বলিতে চায়।
কথা কহিতে কোনও বাধা-নিষেধ নাই।
[ ... ]

তো তালাশ আর মাদল একদিন ‘নতুনধারা’র কারখানায় আসিলেন। মাদল ও তালাশকে কবি বলিয়া সম্বোধন করিলাম না। কারণ কবিকে কবি সম্বোধন না করিলে ইজ্জতের বরখেলাপ হয় না। তো তালাশকে আমি নানা সওয়ালে জর্জরিত করি। তালাশ কোনও কোনও সওয়ালের মনপুত জবাব দিয়াছিলেন। কোনওটা দেন নাই। বলিয়াছিলাম, কোনও সংকলন হইতে আপনার বাদ পড়িবার দায় যদি এই সংকলন হয় তো তাহাতে ভূমিকা করিবার সাধ্য আমার কুলাইবে না। আর মধ্যবিত্ত কবিদের চুল ছিঁড়াছিঁড়িতে আমাদের কোনও মতি (Mind) নাই। আমাদের মতি যুক্তি-তর্কের মতিউরে।

তো কোন পাটাতনে খাঁড়াইয়া আপনি কবিতা গ্রহণ করিয়াছেন? জবাবে তালাশ বলিয়াছেন, সংবেদনশীলতা। বলিলাম, ‘কবি মাত্র সংবেদনশীল ইহা বিশেষ কী?’ জবাবে ওঁ বলিয়াছিলেন, কবিতা বিশেষ—পাঠে ক্রিয়া করে কিনা? বলিলাম, সংবেদনশীল প্রাণী মাত্রই ক্রিয়া করিতে অভ্যস্ত। পামর-ইতরের সংবেদন থাকিলেও সমাজ উহাকে অগ্রাহ্য করে। মানব প্রজাতি বুদ্ধির ঢেকি। ধান দিলে বাড়া বাধিতে পারে। ইহা আবার নতুন কী? মানব প্রজাতি ইচ্ছা করিলে ধান সৃষ্টি করিতে পারে না। পারে অভি-ধানে অর্থ খুঁজিতে। পারে এক পর্ব হইতে অন্য পর্বে রূপান্তর ঘটাইতে। ইহার মর্মার্থ যখন আমরা বুঝিব তখন বুঝিতে পারিব কবিমনের কথা। ইহাই তাহার ভেতরের ইতিহাস। ইহাতে কোনও স্বার্থসিদ্ধি নাই। মধ্যবিত্তসুলভ রাজনীতি নাই। নাই হুজুগের হুজুরিপনা। তাহা হইলে কী আছে?

পহিলা সংকলনের সীমানা লইয়া খানিক আঁচড় কাটিব। এই কেতাব সাহিত্যের কোনও সীমা নির্ধারণ করিতেছে না। ইহার বড় ত্রুটি তলে তলে অনেক কবি বাদ পড়িবার শংকা। নিশ্চিত বাদও পড়িয়াছেন কেহ কেহ। কেহ বাদ পড়িলে ভাবিবার অবকাশ নাই তিনি কবি নহেন। কে কবি আর কে অকবি এই চিন্তা মাথায় লইয়া সংকলনখানি নাজেল হইতেছে না। জীবনানন্দ দাশের অনেক অতিক্রিয়াশীল বক্তব্যের একদানা—‘কবিতা অনেক রকম’। তাহা হইলে তো কেল্লা ফতে! ফলে মাদল বা তালাশের গুষ্ঠি উদ্ধার করিবার উপায় নাই। যদিও নানা সংকলন লইয়া অতীতে অনেকের চোদ্দগুষ্ঠি উদ্ধারের কাহিনী কমবেশি আমাদের জানা। ওইসব লঙ্কাকাণ্ডে সাহিত্যের কী ফল ফলিয়াছে চোদ্দগুষ্ঠি উদ্ধারকারীরা জানেন। তাঁহারা এহেন পামরের কথা শুনিয়া নাখোশ হইবেন না—এই আশা করিতে তো পারি? তবে যুক্ত-সিদ্ধ তর্ক করিলে আখেরে বাংলা কবিতার—এমন কি বাংলা ভাষারই ফজিলত। তাঁহাদের সেলাম জানাইয়া আমরা এখন দৃষ্টান্ত টানিব।

মহাজন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁহার জীবদ্দশায় ‘বাংলা কাব্যপরিচয়’ নামে একখানা কবিতার সংকলন করিয়াছিলেন। সাহিত্যের রসিক পাঠক মাত্র সেই কাহিনী জানিয়াছেন। তবুও বলিতে হইতেছে, সংকলন জুড়িয়া থাকা কবিদের অনেকেই কালের গহ্বরে শূন্যের ফটিক হইয়া আছেন। যাঁহারা ফটিক হইয়াছেন অন্তত তাঁহাদের লিখা পড়িতে এখন দূরবীনের দরকার। খোদ ঠাকুর রবীন্দ্রনাথের মত প্রতিভা ইহা টের পান নাই! আর শেষ নাগাদ ঠাকুরও সেই সংকলনের ভার বহন করিতে পারেন নাই। দিন কয়েকের মাথায় তিনি বাজার হইতে প্রত্যাহার করিয়াছিলেন কেতাবখানি। সেও এক ঠাকুর জমানার দুস্তর ইতিহাস। বঙ্গীয় পাঠিকা এ-সংকলনখানি তাহা হইতে কত দূরে?

৩.
তো সংকলনখানির নাম ‘শূন্যের করতালি’। কেন ইহা ‘শূন্যের করতালি?’ তাহার সদুত্তর ইহাতে নাই। কেননা সাহিত্যের ইতিহাসে শূন্য বলিয়া কোনও দশক নাই। যে কেহ মানিবেন—মিথ্যার উপর সাহিত্য চলিতে পারে না। সাহিত্যের ঠ্যাঙে সত্যের খুঁটি লাগে। না লাগাইলে যাহা হইবে তাহাকে যে খোঁড়া বলিবে সেই বিবাদে কোনও সংশয় নাই। তবে এহেন সংকলক এমন এক সময়ের মামলা লইয়া হাজির হইয়াছেন—যাহা নব্বই দশকের পরকাল আর একবিংশ দশকের ইহকাল। কারণ তাহা হয় তো বলিতে হইবে—না ইহ না পর। খোদকরি পুলসিরাতের কাল। যাঁহাদের বেহেস্ত নাই আবার দোজখ নাই। এহেন ভাবতত্ত্ব শুনিয়া পাঠিকা ভাবিয়া লইবেন না—শূন্য মাত্র অন্ধকারময়। একবার ভাবেন তো শূন্য মালখানা—না আলো না অন্ধকার। হেরপরও জিজ্ঞাসা থাকিতেছে, কোনও সময়কে চিহ্নিত করিবার উপাদান কি শূন্য? তো সংখ্যাতত্ত্ব মানিলেও শূন্যের একক কোনও অর্থ নাই। অপর সংখ্যার আগে বা পরে বসিলে ইহার অর্থে গর্ভপাত ঘটে।

ইতোপূর্বে ‘শূন্য’ নামে যে দু-চার কলিকথার (Modern) সংকলন চরিত্র বিলাইয়াছে তাহাতেও ইহার যুৎসই উত্তর বাদ রহিয়াছে। বিলাপ কেবল লাপ হিসাবে থাকিয়াছে। যাহা হইয়াছে তাহা আলাপ মাত্র বটে। কারণ ইহার সদুত্তর অনুপস্থিত। তো স্নেহভাজন সোহেল হাসান গালিব সম্পাদিত কবিতা সংকলনে দশকের কালকে কাটিতে একখানা প্রস্তাব ছিল ‘প্রথম দশক’। অপর ভাষায় যাহা ‘পহেলা দশক’। তাঁহার প্রস্তাব মন্দ নহে। বর্তমান সংকলকও পরের সংস্করণে ইহা বিবেচনা করিতে পারেন। যদিও দশকওয়ারি বিচারে সাহিত্য বা কবিতা বিশেষ কর কাটিবে না। খালি এককালে নহে, কবিতা কাটে তাহার অপর আর পরের কালে কালে। তবুও কি মনুষ্যসমাজ আঁতুড় ঘরের দিন-ক্ষণ মুছিয়া ফেলে? হয়ত ইহাই দশকের ফল।

জগত সংসারে নামের নানান ধাম আছে। ধরাধামে শুদ্ধ নাম লইলে নাম হয় না। নাম লইতে হইলে কর্ম আর ধর্ম দুই থাকিতে হয়। কেননা কর্ম আর ধর্ম বলিতেছে আপনি কেমন মাল রূপে জগতে হাজির থাকিতেছেন। কর্ম আর ধর্ম ফলের মিলনের নামই ‘নাম। ’ বাকি হালনাগাদ জগতের বিরহ ব্যারাম। মিলন আর বিরহের ফাঁকের ফাঁককে বলা হয় সময়। সময়ের ফাকাফাকিতে যাহা লিখা হয় তাহাই ইতিহাস। মানবসাগরের বিদ্যাবুদ্ধিতেও বেলার ইতিহাস কি কম এস্তেমাল হইয়াছে?

‘শূন্যের করতালি’ হইতে শূন্য বাদ দিলে যাহা থাকে তাহা করতালি। অর্থবিদা কহে—করতালি মানে দুই। একদিকে হস্তধ্বনি, অপরদিকে কর তালিকা। ইহার বাহিরে রাজনীতির সংস্কৃতিতে করতালি শব্দের গুঞ্জন আমরা কম শুনি নাই। তো বুর্জোয়া রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ‘করতালি’ শব্দখানি অতি হাতের ব্যবহারে জীর্ণ হইয়া উঠিয়াছে। তবে সংকলনের নামায়নে করতালি শব্দখানি অর্থবিদ্যার দুই অর্থ বহন করিতে সক্ষম। কেননা ভাষার জগতে ইহা কী মরদ কী মাদী—দুই লিঙ্গেরই ধ্বনি বিশেষ। আমরা আরও একপদ বাড়াইয়া করিব—করের অপর মানে অর্থ। এই অর্থ টাকা নহে। ভাষার ভাব-স্বভাবের লক্ষণে ইহা চরিত্র বা মুদ্রাবিশেষ। তো এখন দৃষ্টান্ত টানিব। গানখানি কে লিখিয়াছে জানা নাই। তবে ইহার ধ্বনি মন্ত্রের মত কানে বিধিয়া আছে। কেহ জানাইলে ভবিষ্যতে লিখায় যোগব্যায়াম করিব। গানের দুই কলি এমনই—

এসেছে কি হেথা যশের কাঙালী
কথা গেঁথে গেঁথে নিতে করতালি॥

৪.
আমরা কাজী নজরুল ইসলামের লেখার শিরোনাম লইয়া খানিক কর্জ করিলাম। কর্জ আদায় না করিলে কবিতার দায় শোধ হইবে না। তাঁহার আদ্যশিরোনাম ‘পুরানা বলদ নতুন বউ’। কাজীর লেখার সার হইতেছে পুরানা বলদ নতুন বউ লইয়া সওয়ার হওয়ার কাব্যিককাহিনী। কেহ কেহ কহিতে পারেন তাঁহার কথিকাকল্পে গাঁ-গেরামের আবহাওয়া বহিতেছে। নগর তাহাতে পরাভূত! হয়ত বৈ কি? বলদ গাঁ-গেরাম বহিতেছে বুঝিলাম! শহরে কি পাঠা চরে? আর শহরে যে বউ ফুটিতেছে না কে জানে? নয়া জমানায় শুদ্ধ শহর ওর্ফে কথিতনগরে বউ ফোটে না, গাঁ-গেরামেও ফোটে। ফোটা মানে জন্ম লভিবার রূপে জানান দেয়া। সম্পর্কের সেতু বাহিয়া যাওয়া। আসাও আশাহীন নহে। এহেন মাতৃ জরায়ুর কোয়ায় কোয়ায় কবিতার ‘আব’ ওরফে ‘জল’ ধরিবে। আর ‘হাওয়া’ ওরফে ‘বাতাস’ বহিবে। পাঠিকারাও কি আবহাওয়ার দিকে তাকাইয়া থাকিবেন?

দুনিয়ার তাবৎ ভাষায় কবিতা নতুন পদার্থ নহে। আজ যাহা কবিতা বলিয়া পরিচিত বৈষ্ণবযুগে তাহাকে বলা হইত পদ। আর পদগুচ্ছকে বলা হইত পদাবলী। পদ-পদ্য-কবিতা-কাব্য যেই নামে ইহাকে তকমা আঁটা হোক না কেন তাহাকে পদার্থ বিশেষ হইয়া উঠিতে হয়। না হইলে তাহা হইবে নিষ্ফলা মাঠের কৃষক। অন্তত এই গোলকায়নের যুগে বাজাবীজের (Hybrid Culture) মত! তো প্রশ্ন জাগিতেছে, পহেলা দশকের করতালিতে কী আছে? আছে আঁতুড় ঘরের খবর। আছে জগত সংসারে মানব পদ জন্মিবার পরের আর্তনাদ। কেননা সেই পদাবলী বাঁচিয়া থাকিতে ধ্বনি করিতেছে। পাঠিকারা সেই ধ্বনি কি টের পাইতেছেন?

ভাবতত্ত্বের নিশানার কথা তুলিলে বলিতে হইবে কিছু কাণ্ড সামনে ডালপালা গজাইতে থাকে। ভাষা রূপ রস ছন্দ উপমা চিত্রকল্প ইতি আদি। আদিকাণ্ডের এইসব বীজের ফল ফলাইবার নিয়মের নাম কবিতা—ইহাই সহজ সংজ্ঞা। আর এইসব নিয়মের অনিয়মও কবিতার ব্যতিক্রম নহে। নিয়মের অ-নিয়ম যখন নতুন নিয়ম রূপে আবির্ভূত হয় তখন তাহাকে কহে অতিক্রম। আর অনিয়ম যখন অনিয়মই থাকে তখন হয় নতিক্রম। অতি আর নতি ব্যবধান ঠিক করিয়া দেয় ইতিহাস মানে অতীত নহে বর্তমানই বটে। আর মধ্যখানের অব্যয়খানা হইতেছে ভবিষ্যতের সম্পর্ক কোঠা।

পহেলা দশকের বেশির ভাগ কবির প্রবণতা—নতিক্রমের দিকে ঝোক। ইহা খানিক বিপজ্জনক বটে। এই সংকলনে উপস্থিত কেহ কেহ নতিক্রম করিবার ভাষাও রপ্ত করিতে পারেন নাই। তাঁহারা বুঝিতে পারেন না কবিতা করিতে হইলে ভাষার ভাববিশেষের কোশেশ করা দরকার। কেহ কেহ তো পশ্চিমবঙ্গের গৌণ কবিদের প্র-মৃত ভাষার কবিতার চোরাবালিতে শহীদ হইয়া যাইতেছেন। এই সংকলনের উপস্থিত যাঁহারা তাহা করিতেছেন তাঁহারা টের পাইতেছেন কি? এইদোষ শুদ্ধ বর্তমান সংকলনের কোনও কোনও কবির নহে, বাহিত হইয়াছে পূর্বতনদের কাছ হইতে। দৃষ্টান্ত টানিয়া তাঁহাদের খাটো করিতে চাহিতেছি না।

তাই বলিয়া এই নয় যে তাঁহাদের অতিক্রমের সম্ভাবনা ফুরাইয়া গিয়াছে। অনেকের কবিতায় আবার অতিক্রমের সম্ভাবনা রহিয়া গিয়াছে। পহেলা দশকের কোনও কোনও কবির বড় গুণ মারাত্মক কল্পনা শক্তি। এত কল্পনা শক্তি থাকিবার পরও ভাষা রপ্ত না হওয়া ইঁহাদের লিখা উপাদেয় হইয়া উঠে নাই। কেহ কেহ বলিতে পারেন, ছন্দের তলানি থাকা নতুনের স্বভাব নহে। ইহাও নতুন নহে। অনেকে বঙ্গভাষার কবিতায় আগে তাহা করিয়াছেন। তাঁহারা তলের কোশেশ করিয়া উপরিতলের ভাব ধরিয়াছেন। সেই ইতিহাস সকলের কমবেশি জানা। কিন্তু প্রশ্ন হইতেছে যাঁহার তল বা তলানি নাই, তিনি কি রূপে উপরিতলে উঠিবেন?

নানানসময়ে গণ্ডা-গণ্ডা পাণ্ডুলিপি ও ছিন্নছিন্ন পাটের আলোকে বলা যায়, পহেলা দশকের কবিতার আরেকগুণ রহস্যময়তা। এই রহস্যময় পরিস্থিতির পিছনের বড় কারণ কল্পনাময় প্রতিভা। গৌণ কারণ অনেকে বুঝিতে পারেন না পদ ব্যবহারে তাহার কী অর্থ ফলে। ফলে দুইজাতের রহস্যভাবাপন্ন অবস্থা ইঁহাদের কবিতায় বিদ্যমান। যাঁহারা রহস্যকে আকড়াইয়া থাকিতে চাহেন—তাঁহাদের বড় গুণ হওয়ার কথা কবিতায় নৈঃশব্দ সৃষ্টি করা। তো নৈঃশব্দ সৃষ্টি করিতে ব্যর্থ হইলে তাহা হইবে রহস্যময় প্রপঞ্চ।   কাঁহারো কাঁহারো লেখায় চল চিন্তাকে উল্টাইয়া দিবার সম্ভাবনাও আছে। বলা চলে সম্ভাবনার অর্থ ভবিষ্যত নয়, খোদ চিন্তাকে সম্ভবে আনা। সহজ ভাষায়—সমভাবে চিন্তাকে বাগে আনা। এই বাগে আনার ভাব বাংলা কবিতার সম্ভাবনাকে জাগাইয়া রাখিবে নিশ্চয়।

৫.
বলিতে হইবে তালাশ তালুকদার বর্তমান সংকলনে এতকিছুর সন্ধান করিয়াছেন তাঁহার চেষ্টার ত্রুটি নাই। তিনি শুদ্ধ কবি-সংগঠক নহেন, বিজ্ঞানী বটেন। কেননা সংকলন সংগঠনের কর্মের কাজখানা নতুন বউ বহিয়া নেওয়ার মত। তালাশ সেই গুরু-দায়িত্ব আপন স্কন্ধে তুলিয়া নিয়াছেন—ইহা কম কথা নহে। তাঁহাকে অভিনন্দন জানাইয়া খাটো করিতে চাহি না। আশাকরি তিনি অভিনন্দনের অধিক কিছু পাইবার যোগ্য। একলগে এতকবি আর এতকবিতা পড়িবার স্বাদ মন আর মন্তাজের কথা আরেকবার ভাবিতে হয়।

সকলেই মানিবেন নতুন কবিতা সৃষ্টি হইলে নতুনকে নতুন বলিতে কোন শ্লাঘা থাকিবার কথা নাই। আমরাও অপেক্ষায় থাকিলাম সেই খবর বাজারের সম্বাদ হইবে একদিন না একদিন। কেবল ধ্বনি করিলে ভাবের পুণ্য প্রকাশ হয় না। পুণ্য পাইতে হইলে ইহাকে অর্থ লইতে হয়। অর্থ ফুটাইতে হয়। আর ভাব তখনই পুষ্প হইয়া সৌন্দর্য মেলিয়া ধরে। এই সংকলনে গরহাজির কবিগণ এই সত্য ধাবনে আনিবেন—এই প্রার্থনা আজিকার আখেরি প্রার্থনা। ভবিষ্যতও আরও করিবে ভাবে অভাবে স্বভাবে—এই আশা এই ভরসা। কবিগণের মঙ্গল হৌক। আর এই সংকলনে যাঁহাদের উপস্থিতি নাই তাঁহাদেরও তাহা হোক।
জয়তু বাংলা কবিতা।
জয়তু বাংলা ভাষা।

** (লেখকের নিজস্ব ভাষারীতি অনুসরণ করা হয়েছে)



বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৬ ঘণ্টা, মার্চ ৩, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।