১৯৮৪ (নাইনটিন এইটি ফোর)—বিখ্যাত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক, সাহিত্য সমালোচক ও সাংবাদিক জর্জ অরওয়েলের অমর গ্রন্থ। ১৯৪৯ সালে তার মৃত্যুর এক বছর আগে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়।
___________________________________
শুরু থেকে পড়তে ক্লিক করুন
৪৫তম কিস্তির লিংক
___________________________________
ফ্ল্যাটে যখন ফিরল ততক্ষণে রাত দশটা পার হয়ে গেছে। মূল ফটকে অবশ্য আলো বন্ধ করা হয় রাত সাড়ে এগারোটায়। ঘরে ঢুকেই দ্রুত রান্নাঘরে ছুটল, আর দেরি না করে এককাপ পরিমাণ ভিক্টরি জিন গলায় ঢালল। ধকল সামলাতে সামলাতে চোরকুঠুরির টেবিলে ফিরল, ড্রয়ার থেকে ডায়রিটা তুলে নিল, কিন্তু তখনই পাতা খুলল না। টেলিস্ক্রিন থেকে একটা কর্কশ নারীকণ্ঠ তারস্বরে গাইছে দেশপ্রেমের গান। ডায়রির মার্বেল মলাটের দিকে তাকিয়ে বসে থাকল সে, আর নারী কণ্ঠটিকে সজ্ঞানতার বাইরে ঠেলে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগল।
ওরা আপনার খোঁজে রাতেই আসে। সঠিক কাজটি হচ্ছে, ওরা ধরে ফেলার আগেই আত্মহত্যা করে ফেলা। নিঃসন্দেহে কিছু মানুষ সেটাই করে। এ কারণেই বলা যায়, অনেক গুমের ঘটনা মূলত আত্মহত্যা। তবে নিজেকে হত্যা করার জন্য প্রয়োজন চরম সাহস, বিশেষ করে আপনি যখন এমন বিশ্বে বাস করছেন যেখানে আগ্নেয়াস্ত্র কিংবা দ্রুত কাজ করে এমন বিষ কেনার সুযোগটিও রাখা হয়নি। ভয় ও বেদনার জৈবিক অকার্যকারিতা নিয়ে বিস্ময়চিত্তে সে ভাবল, মানবদেহের শাসনটাই এমন যে, ঠিক অতি প্রয়োজনে শরীরটা বেঁকে বসে। একটু দ্রুত উদ্যোগী হলে সে হয়ত কালোকেশী মেয়েটিকে ধরতে পারত; কিন্তু স্রেফ বিপদের আশঙ্কা তার শরীরকে অবশ করে দেয়। তার মনে হলো, সঙ্কটাপন্ন অবস্থায়ও মানুষকে বাইরের শত্রুর মোকাবেলা করা না লাগতে পারে, কিন্তু শরীরের ভেতরের শত্রুটির বিরুদ্ধে লড়াই চলে নিরন্তর।
ঠিক এখন, জিন পেটে যাওয়ার পরেও পেটের ব্যথাটি তার ধারাবাহিক চিন্তায় বিঘ্ন ঘটিয়ে চলেছে। বিষয়টি সবসময়ই একরকম, হোক সে বীরত্বের কিংবা বিয়োগান্তের। যুদ্ধের মাঠ, নিপীড়ন কক্ষ, ডুবন্ত জাহাজে আপনার অব্যাহত লড়াইয়ের বিষয়গুলো মনে আসবে না কারণ তখন শরীর আপনার দখলেই থাকে না। যতক্ষণে ভয়ে অচেতন হয়ে যান নি, অথবা ব্যথায় চিৎকার জুড়ে দেননি ততক্ষণ পর্যন্ত জীবনটা প্রতি মূহূর্তের এক সংগ্রাম। সে সংগ্রাম ক্ষুধার, ঠাণ্ডার অথবা নিদ্রাহীনতার বিরুদ্ধে। অথবা পাকস্থলীর অম্বল কিংবা দাঁতের ব্যথার বিরুদ্ধে।
ডায়রি খুলল উইনস্টন। কিছু বিষয় লিখে ফেলা জরুরি। টেলিস্ক্রিনের নারী নতুন গান ধরেছে। সে গান তার মস্তিষ্কে কাচের ধারালো স্প্লিন্টারের মত বিঁধছে। ও’ব্রায়েনকে নিয়ে ভাবতে চেষ্টা করল সে, যার জন্য, কিংবা যাকে উদ্দেশ্য করে এই ডায়রিটা লেখা। কিন্তু ও’ব্রায়েন নয়, তার ভাবনা জুড়ে স্থান করে নিল, থটপুলিশ তাকে ধরে ফেললে কী হবে সেসব বিষয়। ওরা যদি সাথে সাথে মেরে ফেলে তো কোনও কথাই নেই। সে হত্যা হবে আপনার প্রত্যাশা পূরণ হবার মত কিছু। কিন্তু মৃত্যুর আগে (প্রত্যেকেই জানে কিন্তু কেউ কথা বলে না) দোষ স্বীকার সম্পর্কিত কিছু রুটিন কাজের মধ্য দিয়ে আপনাকে যেতেই হবে—মেঝেতে গড়াগড়ি খেয়ে চিৎকার করতে করতে ক্ষমাভিক্ষা, প্রহারে হাড়গুলো ভাঙার কড়কড় শব্দ, দাঁত গুঁড়িয়ে দেওয়ার যন্ত্রণা আর মাথায় জমাট বেঁধে থাকা রক্তের উপলব্ধি।
শেষ যখন ওই একই প্রাণহানিতে—তাহলে তার আগে কেন এত কিছু? ওই কটি দিন বা সপ্তাহ জীবন থেকে কেন বাদ দেওয়া যায় না? সন্দেহে পড়ে কেউ ধরা পড়েনি এমন হয়নি, আর কেউ অপরাধ স্বীকার করে নেয়নি এমনটাও হয়নি। একবার যদি আপনি চিন্তাঅপরাধের জালে পড়ে যান, কোনও একদিন সেকারণেই আপনার মৃত্যু অবধারিত। তাহলে যে ভয় কোনও কিছু পাল্টে দেয় না—সে ভয় করাই কেন, কেনই বা ভবিতব্যের কাছে মাথাঠোকা?
চিন্তা জগতে ও’ব্রায়েনের ছবি টেনে আনতে এবার কিছুটা সফল সে। ‘এমন কোথাও আমাদের দেখা হবে যেখানে কোনও আঁধার থাকবে না’—ও’ব্রায়েন বলেছিল তাকে। সে জানে এর মানে কী, অথবা অন্তত তার মন বলে—সে জানে। যেখানে কোনও আঁধার নেই সে স্থানটি এক কাল্পনিক ভবিষ্যত, যা কেউ কখনওই দেখবে না, তবে দূরদৃষ্টি দিয়ে কেউ কেউ তার রহস্যময়তা উপলব্ধি করতে পারবে। টেলিস্ক্রিনের কর্কশ শব্দে চিন্তার ধারাবাহিকতা বারবার কেটে যাচ্ছে। চিন্তার ট্রেন গতি হারাচ্ছে।
মুখে একটি সিগারেট চেপে ধরল সে। অর্ধেক পরিমাণ তামাক পড়ল জিভের ওপর। ভীষণ তেতো কিন্তু তখনই থুতু ফেলে ওগুলো ফেলে দেওয়াও কঠিন। এমনই মুহূর্তে তার চিন্তার সমুদ্র থেকে ও’ব্রায়েনকে সরিয়ে দিয়ে সাঁতরে ঢুকে পড়ল বিগ ব্রাদার। দিন কয়েক আগে যা করেছিল, ঠিক তেমনিভাবে পকেট থেকে একটি মুদ্রা বের আনলো সে, আর তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল। মুদ্রার পিঠের মানুষটি যেন তাকেই দেখছে, গভীর, শান্ত ও সুরক্ষার দৃষ্টিতে; কিন্তু কালো ঘন গোঁফের নিচে কিসের এক চাপা হাসি লুকিয়ে আছে? স্তিমিত হয়ে আসা ঘণ্টাধ্বনির মত তার কানে বারবার বাজতে থাকল:
যুদ্ধই শান্তি
স্বাধীনতা দাসত্ব
অবহেলাই শক্তি
[প্রিয় পাঠক, জর্জ অরওয়েলের ‘১৯৮৪’ তিনখণ্ডে রচিত। এর প্রথম খণ্ডের অনুবাদ ৪৬টি কিস্তিতে প্রকাশিত হলো। আগামীকাল থেকে পড়ুন দ্বিতীয় খণ্ড। - অনুবাদক ]
দ্বিতীয়খণ্ডের প্রথম কিস্তি পড়তে ক্লিক করুন
বাংলাদেশ সময় ১৬৪৩ ঘণ্টা, মার্চ ৪, ২০১৫
শিল্প-সাহিত্য
প্রতিদিনের ধারাবাহিক
১৯৮৪ | জর্জ অরওয়েল (৪৬) || অনুবাদ: মাহমুদ মেনন
অনুবাদ উপন্যাস / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।