মেয়েটার বয়স ষোলো। লাল রং ভালো লাগে।
মা বলল, বিয়ার পরে জামাইর লগে যাইস।
বিয়ের পরে! তা তো যাবেই! নিশ্চয়ই ওর সাথে খুব সুন্দর একটা ছেলের বিয়ে হবে! আর যাই হোক কালো ছেলে ও বিয়ে করবে না। জামাই যদি ফর্সা আর শাকিব খানের মত যদি লম্বা হয় তাহলে তো ভালোই হয়। ছেলেটাকে খুব ভালোবাসবে ও। খুব ভালো রাখবে। প্রতিদিন পা টিপে দেবে ছেলেটা ঘুমানোর আগে। ওরা তো সবসময় একই রঙের কাপড় পরবে। পহেলা বৈশাখে, ফাল্গুনে এমনকি বইমেলায়ও। ওরা হাত ধরে মেলায় যাবে। ফেরার পথে কাচের চুড়ি কিনবে। কত কী ভাবে মেয়েটা!
তবু বিয়ের আগেই যাক না একবার মেলায়! বড়বোনকে বলে ও। ওর বোন রাজি হয়।
সেদিন শুক্রবার। সেদিন একুশে ফেব্রুয়ারি। বোনের গার্মেন্টস ছুটি। সেদিন ওরা মেলায় যাবে। ও একটা লাল টকটকে জামা পরে। মাথায় জপজপ করে সুগন্ধি তেল লাগায়। লাল ফিতায় বাঁধে চুল। ঠোঁটে চকচকে লিপস্টিক। পাশের বাসার খালার গলার মালাটা ধার করে নিয়ে আসে। গলায় পরে সেটা। কানে ঈদের সময় কেনা পাথরের দুল। ওহ! কি চমৎকারটাই না দেখাচ্ছে! আয়নায় বারবার মুখ দেখে মেয়েটা।
হাতে দশ টাকা গুঁজে দেয় মেয়েটার মা। আর মুখ টিপে হাসে।
আর বলে, খুব সুন্দর! কারও নজর যেন না লাগে!
বইমেলার গেইটে অনেক ভিড়। পুরো ঢাকার মানুষ যেন এইখানে এই ঘিঞ্জি দুই গেইট দিয়ে চলাচল করছে। ওখানে কেউ যাচ্ছে না, আসছেও না। ধাক্কাধাক্কিতে যতদূর দূরত্ব অতিক্রম করা যায় ততদূরই। যতদূর দেখা যায় মানুষ আর মানুষ। কালো কালো মাথা। বড়বোনের চোখ কপালে!
নারে ওখানে ঢুকমু না।
মেয়েটা বায়না ধরে, আরে আইলাম যখন। চলনা আপু, চলনা, চলনা।
গেইটের সেই লম্বা লাইনে একসময় ওরাও লাইনে দাঁড়ায়। তারপর সামনের পেছনের ধাক্কাধাক্কিতে কখন যেন গেইটের মুখে। হঠাৎ মেয়েটা টের পায় তার নিতম্বের ওপর একটা হাত। খামচে ধরে আছে তার নিতম্ব। ঝটকা লাগে মেয়েটার। দুম করে পেছনে ফেরে মেয়েটা। ঘাড় ঘুরিয়ে খুঁজতে থাকে এই হাত কার। হাজার হাজার চোখ। হাজার হাজার চুল। হাজার হাজার মাথা। হাজার হাজার কোঁচকানো ভ্রু। হাতের মালিক কোনজন বোঝা যায় না। মেয়েটা আবার সামনে তাকায়। হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে যায় মেয়েটার।
একটু সামনে আগাতেই ঠাসাঠাসি যেন আরও বেড়ে গেল। এবার আরেকটা হাত। এবার বুকে। সেই আগের মতই সজোরে খামচে ধরা। আবারও তড়াস করে ঘাড় ঘুরায় মেয়েটা। নাহ, এই হাজার হাজার লোকের মধ্যে কে যে কী ভাবছে বোঝা যায় না। ভিড়ের মধ্যে সব চেহারাই একরকম। মেলায় ঢুকে গেল মেয়েটা। কিন্তু মনটা যে খারাপ হয়ে গেল। আর কিছুই তো ভালো লাগছে না। এদিকে বড়বোন ডাকছে। ওখানে একটা বই দেখবে—রূপচর্চার হাজার হাজার টিপস।
বই দেখতে স্টলের ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল বড়বোন। ছোটবোন দাঁড়িয়ে থাকল। চোখের কোণে একটু একটু জল। ভিড়ে টিপ লেপ্টে গেছে। জামায় ভাঁজ পড়েছে। কমদামি জুতার প্লাস্টিকে পায়ের নানা জায়গায় ফোসকা পড়েছে। পাশের বাসা থেকে ধার করে আনা মালাটা সরে গেছে গলার মূল অংশ থেকে।
অনেক ভিড়। অনেক মানুষ। কেউ হাসছে। কেউ হাঁটছে। কেউ ছবি তুলছে। সবার মনে আনন্দ। আর এর মাঝখানে একজনের মনেই অনেক কান্না। নীল আকাশটা তার অন্ধকার মনে হচ্ছে। যেন হাজার হাজার মানুষ তার মনে একরাশ অন্ধকার এনে দিয়েছে। গুমড়ে গুমড়ে কাঁদছে সে। এমন সময় খেয়াল করল তার পেছনে, নিতম্বের ঠিক মাঝখানে কিসের যেন খোঁচা লাগছে অনেকক্ষণ থেকেই। মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখতে পেল একটি খোলা চেইন। চেইনের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা শিশ্ন। সেই শিশ্ন দিয়ে এতক্ষণ ধরে তাকে আস্তে আস্তে চাপ দিচ্ছিল কেউ। কে? তাকাতেই চোখ পড়ল লোকটার ওপর। ওর দিকে তাকিয়ে পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে হাসল লোকটা।
বমি পেয়ে গেল মেয়েটার। হতভম্ব হয়ে গেল মেয়েটা। সে যতই এদিক ওদিক যায় লোকটা তার পেছনে পেছনে আসতে থাকে। তার প্যান্টের চেইন খোলাই থাকে। মেয়েটা আতঙ্কে অস্থির যায়। মেয়েটা ভয়ে দিশাহারা হয়ে যায়। সে জানে, পুরুষের শিশ্ন থাকে। সে জানে ওটার কাজ কী। সে জানে একদিন যখন তার বিয়ে হবে কোনও ফর্সা আর ভালো ছেলের সাথে তখন আরও অনেক কিছুই হয়ত জানবে সে। কিন্তু শিশ্নের এমন রূপ সে ভাবতে পারে না। এমন অসভ্যতা সে জানে না। ভাবতে পারে না কুঁতকুঁতে চোখ নিয়ে লোকটা এখনও তার দিকে তাকিয়ে অশ্লীলভাবে হাসছে। আকাশ ভেঙে পড়ে মেয়েটার ওপর। পৃথিবী সম্পর্কে সব ধারণা এক মুহূর্তে ভেঙেচুরে যায় তার। কান্নায় ভেঙে পড়ে সে।
এদিকে হাজারও লোকের ভিড়ে প্রচণ্ড ধুলা। একটু পরেই আমার প্রোগ্রাম শুরু হয়ে যাবে। কানে টকব্যাক গুঁজে দিয়ে মাইক্রোফোন চেক করছি ঠিক আছে কিনা সব। হঠাৎ চোখে পড়ল মেয়েটাকে। এত মানুষের মাঝখানে একটা কালো শুকনা মতন মেয়ে অঝোরে কাঁদছে। চোখের পানির সাথে সাথে ওর কালো কাজল চোখ থেকে গাল বেয়ে নামতে শুরু করেছে।
আমি এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইলাম, কী হয়েছে, কী হয়েছে? কাউকে কি হারিয়ে ফেলেছে সে?
আমাকে দেখে আশেপাশের লোকেরা সরে গেল। মেয়েটি আমাকে জড়িয়ে ধরল। হু হু করে কাঁদতে থাকল। বলল, আপা কেন গরীব মাইনষের মাইয়া হয়। আপা দুনিয়াটা এত বিতলা কেন?
আমার হাতে সময় কম। ওদিকে প্রোডিউসার আমাকে খুঁজছে। ফ্রেমে দাঁড়ানোর তাড়া দিচ্ছে।
আমি বারবার জিজ্ঞাসা করি কী হয়েছে। ও আমাকে বলে। সবই বলে। আর কাঁদে। বড়বোন এসে ওকে নিয়ে যায়।
বারবার জিজ্ঞাসা করে, কী হইছে, কান্দোস কেন, ওই, কী হইছে।
মেয়েটা কিছুই বলে না। বলতে পারে না। ওর শূন্য চোখে আতঙ্ক, অবিশ্বাস, এক অব্যক্ত বেদনা। আমার চোখ সে চাহনি চিনতে ভুল করে না। আমি ফোন তুলে নেই। আমার ছোটবোনকে ফোন করি। ফোনের ওপাশে শুনতে পাই বব মার্লে গেয়ে চলেছে—‘নো, উইম্যান, নো ক্রাই। ’
বলি, তিথি, তুমি আজকে মেলায় আসবা না।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৬ ঘণ্টা, মার্চ ৫, ২০১৫