১৯৮৪ (নাইনটিন এইটি ফোর)—বিখ্যাত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক, সাহিত্য সমালোচক ও সাংবাদিক জর্জ অরওয়েলের অমর গ্রন্থ। ১৯৪৯ সালে তার মৃত্যুর এক বছর আগে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়।
___________________________________
শুরু থেকে পড়তে ক্লিক করুন
দ্বিতীয় খণ্ডের পঞ্চম কিস্তি
___________________________________
কাঠমুখো প্রহরীরা সাবমেশিনগান হাতে কোণায় কোণায় দাঁড়িয়ে। ট্রাকের একটি দীর্ঘ লাইন ধীরে রাস্তা পার হয়ে যাচ্ছে। ট্রাকগুলোতে ছোট ছোট হলদেটে চেহারার মানুষগুলো সবুজাভ ইউনিফর্মে উবু হয়ে ঠাসাঠাসি করে বসা। তাদের বিষাদময় মঙ্গোলীয় চোখগুলো আশেপাশে পড়ে আছে তাতে কৌতূহলের চিহ্নও নেই।
মাঝে মাঝে ট্রাকগুলো যখন ঝাঁকি খাচ্ছে তখন কয়েদীদের ধাতব ডান্ডাবেরি থেকে ঝন-ঝন শব্দ হচ্ছে। দুঃখভরা চেহারার মানুষেভর্তি ট্রাকের পর ট্রাক পার হয়ে যাচ্ছে। উইনস্টন অবশ্য ওদিকে খুব একটা তাকালও না। মেয়েটির কাঁধ ও কনুই পর্যন্ত হাতটি তার কাঁধে ও হাতে এসে লাগছে। তার গাল এতটাই কাছে যে উষ্ণতা অনুভব করা যায়। খুব দ্রুতই মেয়েটিই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিল, ঠিক যেমনটি সে করেছিল ক্যান্টিনেও। একই অভিব্যক্তিহীন কণ্ঠে সে বলতে শুরু করল, ঠোঁটদুটি সামান্যই নড়ছে, বিরবির অনুচ্চ কণ্ঠ, শোরগোল আর ট্রাকের শব্দে যা সহজেই হারিয়ে যাচ্ছে।
‘তুমি কি আমায় শুনতে পাচ্ছো?’
‘হ্যাঁ। ’
‘রোববারের বিকেলটা ছুটি নিতে পারবে?’
‘পারব। ’
‘তাহলে মন দিয়ে শোন। মনে রেখ। আমরা প্যাডিংটন স্টেশনের দিকে যাচ্ছি...’
সামরিক এলানের মত বলে গেল মেয়েটি। এতে বিস্মিত উইনস্টন। মেয়েটিই পথ বাতলে দিল তাকে স্রেফ অনুসরণ করতে হবে। ‘রেলে আধাঘণ্টা, স্টেশনের বাইরে বাঁয়ে ঘুরলে উঠে যাওয়া একটি সুঁড়িখানার লাগোয়া দরজা, সেখানে ঢুকলেই মাঠের ভেতর দিয়ে একটি পথ বয়ে গেছে, ঘাস গজিয়ে উঠেছে সে পথে, এগুলেই জঙ্গলের মাঝ দিয়ে একটি আরেকটি হাঁটাপথ, সেখানে শ্যাওলা ধরা একটি মরা গাছ। ’ বলার ভঙ্গিতে মনে হচ্ছিল পুরো মানচিত্র তার মস্তিষ্কে আঁকা।
‘পুরোটা মনে থাকবে তো?’ জানতে চাইল মেয়েটি।
‘হ্যাঁ। ’
‘প্রথমে বাঁয়ে ঘুরবে, এরপর ডানে, এরপর ফের বাঁয়ে। আর মনে রাখবে এখানে উপরের সুঁড়িখানাটি এখন নেই। ’
‘ঠিক আছে। কখন?’
‘তিনটার দিকে। তোমাকে একটু অপেক্ষা করতে হতে পারে। আমি ভিন্ন পথে যাব। তুমি কি নিশ্চিত যে সবকিছু ঠিকঠাক মনে থাকবে?’
‘হ্যাঁ। ’
‘তাহলে যত দ্রুত পারো আমার কাছ থেকে সটকে পড়ো। ’
তাকে বলতে হতো না। কিন্তু তখনই ভিড়ের মধ্যে আলাদা হয়ে যাওয়াও সম্ভব ছিল না। ট্রাকগুলো তখনও পার হচ্ছে, মানুষগুলো তখনও হা করে তা দেখছে। গোড়ার দিকে কিছুটা হিস-হাস শব্দ ছিল, কিন্তু সেগুলো ভিড়ের মধ্যে যারা পার্টির সদস্য তাদের মুখ থেকেই বের হচ্ছিল, সেটাও দ্রুতই বন্ধ হয়ে গেছে। এখন যা টিকে আছে তা স্রেফ কৌতূহল। ইউরেশিয়া থেকে হোক কিংবা পূর্ব এশিয়া থেকে, বিদেশি মানেই যেন অদ্ভুত জন্তু। এই কয়েদীর সাজ ছাড়া এদের কেউ কখনওই দেখেনি। এমনকি কয়েদীদের দিকে একবারের বেশি দুইবার তাকায়নি। আর, যুদ্ধাপরাধী হিসেবে যাদের ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে তাদের বাইরে অন্যদের কপালে কী ঘটছে তা তারা জানেও না। অন্যরা শুধুই উবে যাচ্ছে, হয়ত স্থান হচ্ছে জবরদস্তিমূলক শ্রম-ক্যাম্পে। গোল মোগল চেহারাগুলো ময়লা, শশ্রুমণ্ডিত আর বিপর্যস্ত ইউরোপীয় রূপ নিয়েছে। ভাঙা গালের ওপর গোলগোল বিস্ফোরিত চোখগুলো মাঝে মধ্যে অদ্ভুত গভীরতায় উইনস্টনের চোখের দিকে তাকাচ্ছে, আর নিমিষেই সরে যাচ্ছে। বহরটি শেষ হলো। শেষ ট্রাকটিতে তার চোখে পড়ল এক বৃদ্ধের ওপর। ধূসর চুলে তার মুখ ঢাকা, দুই কব্জি সামনের দিকে বাঁধা, সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে। মনে হলো লোকটি যেন এমন হাতবাঁধা অবস্থাতেই অভ্যস্ত। মেয়েটির থেকে উইনস্টনকে এখনই সরে যেতে হবে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে, ভিড় তখনও তাদের ভেতরেই ঠেলছিল আর তার হাতের ভেতর তখন মেয়েটির হাত, আস্তে আস্তে চাপ দিচ্ছে।
দশ সেকেন্ডের বেশি হবে না, কিন্তু তার মনে হলো দীর্ঘ সময় ধরেই যেন তারা দুজন হাত ধরাধরি করে আছে। এরই মধ্যে তার হাতের প্রতিটি বিষয়ই যেন সে জেনে নিয়েছে। লম্বা আঙুল, লম্বাটে নখ, কাজের চাপে কিছুটা শক্ত তালু, কিণাঙ্ক, কব্জির নিচে পেলব মাংস।
অনুভূতি থেকে যতটা জেনে নিল তা যেন চোখে দেখে জানারই সমান। ঠিক তখনই তার মধ্যে এই ভাবনা এলো, মেয়েটির চোখের রঙটি তার জানা নেই। সম্ভবত ওগুলো বাদামি; তবে কালো চুলওয়ালাদের চোখ সাধারণত নীল হয়। মাথা ঘুরিয়ে মেয়েটির চোখ দুটি দেখে নেওয়া হবে ভীষণ বোকামি। এত মানুষের চাপাচাপিতে হাতে হাত ধরার দৃশ্য চোখে পড়বে না, কিন্তু তাকাতে গেলে ধরা পড়বে। তখনও তারা দুজনই স্থিরভাবে সামনে তাকিয়ে। তবে ঠিক তখন আর মেয়েটির চোখ নয়, উইনস্টনের মনের গভীরে সেই কয়েদীর ঢেকে থাকা চুলের ফাঁকগলিয়ে চোখে পড়া বিষাদময় চোখদুটো।
দ্বিতীয় খণ্ডের ৭ম কিস্তি
বাংলাদেশ সময়: ১৫১৭ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০১৫
শিল্প-সাহিত্য
প্রতিদিনের ধারাবাহিক
১৯৮৪ | জর্জ অরওয়েল (খণ্ড ২ কিস্তি ৬) || অনুবাদ: মাহমুদ মেনন
অনুবাদ উপন্যাস / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।