ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

শতদলী মকবরা | কিঙ্কর আহ্‌সান

গল্প / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২২ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০১৫
শতদলী মকবরা | কিঙ্কর আহ্‌সান

বিকেলের শেষ দিকে মেয়েটাকে মারবে বলে ঠিক করে ময়নুল।

বাউফল থেকে আড়াই কিলোমিটার ভেতর গেলেই কালাইয়া লঞ্চঘাট।

এরপর ট্রলারে করে যেতে হবে চর ওয়াডেল খেয়াঘাট। খেয়াঘাট থেকে হাঁটা শুরু করলেই মিনিট ত্রিশেক পর পৌঁছে যাওয়া যাবে চর মিয়াজানে। তেঁতুলিয়ার বুকে জেগে ওঠা এ ছোট্ট চরে লোকসংখ্যা হাজার দুয়েক। চরের বেশিরভাগ লোকই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। একটা টিনের ঘরও নেই এখানে। নেই কোনও ধনী মানুষ।

বড্ড বেশি সবুজ এ গ্রাম। এত সবুজ যে চোখে ধাঁধা লাগে। চরের একপাশ কাশফুলে ঘেরা। কাশফুলের শেষ সীমানা মিলেছে গিয়ে নীল আকাশের সাথে। এখানকার আকাশটা ভয়ঙ্কর নীল। ময়ূরকণ্ঠী নীল আকাশ। সবুজ, সাদা আর নীলের মাখামাখি এই চরে। মানুষগুলোর গায়ের রং অবশ্য কালো। অনেক কষ্টেও গায়ের রং পরিষ্কার, ফর্সা—এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। পাওয়া যাবেই বা কেন?

ছোটলোক, গরীবদের গায়ের রং কালোই হয়। এমন নিয়মই হাজার বছর ধরে চলে আসছে। গ্রামের ময়নুলের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয় না। ময়নুল কালো। কয়লার মতন কালো। চেহারা দেখেই বলে দেওয়া যায়, সে ছোটলোক। গায়ে মাংস বলতে কিছুই নেই। শরীরভর্তি ধুলো। ছেঁড়া লুঙ্গি তার পরনে। কোনওরকমে লজ্জা ঢাকা পড়ে এতে। টাকা জমানোর মতন বিলাসিতা এই চরের মানুষদের নেই। ময়নুলের ছিল। টাকা জমিয়ে একটা গরুও কিনে ফেলেছিল। বাড়ির সামনে করেছিল সবজির বাগান। লাভ হয়নি। গরুটার রোগ লেগেই ছিল। প্রথমে খুরা রোগ। একবার রোগ ধরলে আর থামতেই চায় না। চামড়ায় কি জানি হলো এরপর। গরুটা কোনও কিছু হজম করতে পারত না। খুব বেশিদিন বাঁচেনি। ময়নুলকে পথে বসিয়ে, আরও গরীব করে মারা গেছে অল্প দিনের ভেতরেই। সবজিও নষ্ট হয়েছে। গরীবের স্বচ্ছল হওয়ার স্বপ্ন দেখতে নেই। দুটো পয়সা বেশি আয় করবার বাসনা থাকতে নেই। এসব পাপ।

ময়নুল বুঝে গিয়েছে। জীবনটা এতদূর টেনে এনে বুঝতে পেরেছে উপোস থেকেই তাকে জীবন পার করতে হবে। তাই-ই সে করছে। হাল ছেড়ে দিয়েছে। মাছ ধরা বন্ধ। হাতে কোনও কাজ নেই। বছরের একটা সময় দিনমজুরি করা হয়। এ বছর সে সুযোগটাও নেই। বাউফলে রাস্তার কাজ হচ্ছে। মাটির রাস্তা পাকা করছে সরকার। সেই সুবাদে কাজ পাওয়া যাচ্ছে। ময়নুল একবার ভেবেছিল যাবে। কিন্তু শরীরের যে অবস্থা তাতে যাওয়ার সাহস হয় না।

কাশিটা বেড়েছে। গলায় কফ জমে থাকে। রাতে ঘুম হয় না। সারারাত কাশতে কাশতে যায়। প্রায়ই জ্বর আসে। শরীর কাঁপে। প্রসাবের বেগ হয় খুব। আজকাল আর আটকে রাখা যায় না। কয়েকদিন আগে বিছানা ভিজিয়ে বউয়ের গালি খেয়েছে সে।

সে আর মরদ নেই। ত্যানানো মুড়ির মতন হয়ে গিয়েছে। আয়-রোজগার যেই পুরুষের নেই সে আর পুরুষ থাকে না। হিজড়া হয়ে যায়। ময়নুলের সাথে রাগ করে তার বউ আর শরীর দেয় না। তাছাড়া পেটের ক্ষুধা এত তীব্র থাকে যে শরীরের ক্ষুধার কথা ভাবার সময়ই হয় না আজকাল। বউটা চলে যাবে। ময়নুলের সন্দেহ। ভাত জোগাতে না পারলে বউ অন্য পুরুষের কাছে যাবেই যাবে। বউ চলে গেলে ময়নুল মুখ দেখাতে পারবে না। গলায় দড়ি দিতে হবে।

ময়নুলের জীবনের সবকিছু হলো পারুল। তার মেয়ে। পারুল তার কলিজার টুকরো। মাগো, মাগো বলে পারুলকে বুকে জড়িয়ে ধরলে সে খিদের কথা ভুলে যায়। কেন জানি তার চোখে জল আসে। মন নরম হয়। মনে হয় এই পৃথিবী বেঁচে থাকার জন্য খারাপ না। খুব বাঁচতে ইচ্ছে করে। তখন খুব বাঁচতে ইচ্ছে করে।

ময়নুলের মেয়েটা তার মতনই। খিদের বদ অভ্যাস আছে। খালি খিদে পায়। খাওয়ার জন্য চিৎকার করে। উপোস থাকলে কাঁদে। মায়ের ঝাটার বাড়ি খেয়েও থামে না। কান্না বাড়ে তাতে। কাঁদতে কাঁদতে বমি হয় একসময়। এই মেয়েরও শরীরে রোগের শেষ নাই। পাকস্থলীতে সমস্যা আছে। পেটে ভাত না থাকলে সমস্যা হওয়াটা অস্বাভাবিক না।

পেটে ভাত কিন্তু আছে পারুলের। খাওয়া হলে ওই ভাতই খাওয়া হয় যা একটু। আর কিছু পাওয়ার জো নেই। তরকারি খাওয়া হয় না অনেকদিন। মাছ-মাংস স্বপ্নেও আসে না আজকাল। পারুল তাই ভাত দিয়ে ভাত খায়। ভাত খেয়ে বেঁচে থাকে।

মেয়ের বয়স কম। মেয়ে তাই এখনও ভালো-মন্দ খাওয়ার স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখে এটা ওটার আবদার করে। তার মা গালি দেয়। মারে। ময়নুল মারতে পারে না। মেয়ের জন্য মায়া হয়। শরীরে নাই কিছু। এই শরীরে মার সহ্য হয় না। মার খেলেই জ্বর আসে। আকাশ-পাতাল জ্বর।

পারুল শিরনি খাওয়ার বায়না ধরে। আজকের বায়না না। অনেকদিন আগের বায়না। তার শিরনি খেতে ইচ্ছে করে। গরম গরম খাঁটি দুধের শিরনি। মুখের ভেতর দিলেই যা গলে গিয়ে সেধিয়ে যায় পেটের ভেতর। গলা দিয়ে নামবার সময় দারুণ সুখে জাগিয়ে দিয়ে যায় ঘুম ঘুম ভাব। কতদিন মিষ্টি খাওয়া হয় না। মিষ্টি জিনিসের স্বাদ কেমন সেটাই তো ভুলে গেছে পারুল!

মিলাদে আমৃতি বিলানো হলে বাবা এখন আর যেতে দেয় না তাকে। মেয়ে মানুষ মসজিদে গেলে পাপ! তাছাড়া লোভ করলে মা খুব পেটায়। হাতের কাছে যা পায় তাই দিয়ে পেটায়। চ্যালা কাঠ কিংবা ভাতের চামচ দিয়ে পেটায়।

পেটাবেই না কেন? ঘরে ভাতই নেই তার ওপর এইসব আবদার শুনলে কার না মেজাজ খারাপ হয়। বিগড়ানো মেজাজ নিয়ে চেঁচায় মেজাজ খারাপ করা মা।

ময়নুল এসময় পশুর মতন প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাতড়ায় অসুস্থ শরীরটা নিয়ে। কন্যার শখ পূরণ করতে না পারার হাহাকার তাকে পাগল করে দেয়।

ময়নুল তাই টাকা জমায়। না খেয়ে থেকে টাকা জমায়। ঘরে বিক্রির মতন তেমন কিছু নেই। মাথার ওপর ছাদটা আছে। এই জিনিস বিক্রি করা যায় না। ময়নুল লাকড়ি জমায়। ঘুটে বানায়। কালাইয়ার বাজারে বিক্রি করে একটু একটু করে টাকা জমে।

টাকা জমলে ভালো একটা দিন দেখে মেয়েকে শিরনি খাওয়ানোর জন্যে নিয়ে যাওয়া হয় বাজারে। সেদিন ময়নুল কিছু খায় না। ময়নুল আসলে অনেকদিন ধরেই কিছু খায় না। না খেতে খেতে তার পেটে ঘা হয়েছে মনে হয়। মুখ থেকে রক্ত আসে কয়েকদিন ধরে। কাউকে এ ঘটনা বলেনি সে। কাকে বলবে? বউ তাকে সহ্য করতে পারে না। সারাদিনে গালি ছাড়া আর বাক্যবিনিময় হয় না বউয়ের সাথে। বউয়ের চেয়েও বেশি যন্ত্রণা দেয় কলিজার টুকরা মেয়ে। শিরনি ছাড়া তার জীবনে আর কিছুই নেই। গরীবের মেয়ে বোঝেও না তার আবদার করতেই নেই। ভাত দিয়ে ভাত খেতে পেলেই খুশি থাকা উচিত।

শখের দাম লাখ টাকা। আবদারের দাম তার চেয়েও বেশি। যতই যন্ত্রণা হোক, পশুর মতন রাগ হোক মেয়ের আবদার না মিটিয়ে উপায় নেই। অসহ্য হয়ে ওঠা প্রিয় মেয়ের আবদারের অবসান হওয়া দরকার। একটা ব্যবস্থা করে গরীব ময়নুল। অনেক তো হলো। এক জীবন টেনে নিতে আজকাল কষ্ট হয়। ঘেন্না ধরে গেছে জীবনের ওপর। নিজের জীবন নষ্ট হোক তাতে আফসোস নেই। মেয়েকে নিয়েই চিন্তা। মেয়ের জীবনের আবদারগুলো অপূর্ণ থেকে যাবে এটা সে মানতেই পারবে না।

কালাইয়া গিয়ে পারুল পেট ভরে খায়। চেটেপুটে খায় বেহেশতি স্বাদের শিরনি। কী দারুণ রঙ! কী দারুণ স্বাদ! ফেরার পথে আঙ্গুলের ডগায় মাখিয়ে নেয় শিরনির গন্ধ। এ গন্ধ শুকেই তো পার করে দেওয়া যাবে কয়েকটা দিন। বড় ভালো লাগে। চারপাশে ভালোলাগার প্রজাপতি ওড়ে। অনেক অনেক অনেক দিন পর আগুন ধরা পেটটা শান্ত হয়। গলার জ্বলুনি কমে। পারুল আবার শিরনি খাওয়ার স্বপ্ন দেখে। যাওয়ার পথে স্বপ্ন দেখতে দেখতে যায়। আবার শিরনি খাওয়ার আশা করে।

পারুলের আশায় গুড়ে বালি! কালাইয়া থেকে বাড়ি ফেরার পথে পুকুরটার কাছে এসে ময়নুল মেয়ের শরীরে দশ কেজি ওজনের বাটখারা বেঁধে দেয় দুটো। মেয়েটা এটাকে খেলা ভাবে। বাবার সাথে অনেকদিন খেলা হয় না পারুলের। বাবার সে সময় কই? বাটখারা বাঁধার পর পারুলকে ডুবিয়ে দেয় পুকুরের শান্ত নিথর জলে। কি সুন্দর ধীরে ধীরে জল খেয়ে নেয় অপুষ্টিতে ভোগা ছোট্ট শরীরটা তার। পুকুরে একদম পুরোপুরি ডুবে যাওয়ার আগ পর্যন্ত পারুলের মুখে হাসি লেগে থাকে। মনে আনন্দ থাকে। এই আনন্দ শিরনি খাওয়ার আনন্দ। এই আনন্দ বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর আনন্দ। পারুল ডুবে যায়। একটু একটু করে একসময় পুরোটাই ডুবে যায়। পুকুর পাড়ে বসে গালে হাত দিয়ে মেয়ের ডুবে যাওয়ার দৃশ্য যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণ দেখতে থাকে ময়নুল। যন্ত্রণা গেল। বায়না ধরে বিরক্ত করবে না আর কেউ তাকে। শান্তি! ভয়ঙ্কর কঠিন শান্তি।

এত শান্তিতেও কন্যার জন্যে চোখে জল ভিড় করে। কেন কে জানে! নাকি গরীবের চোখে জল নিয়ম না মেনেই আসে। এমনি এমনি আসে। ধুর।

২.
এমন হরহামেশাই হয়। চর এলাকায় এসব অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবুও পারুলের ঘটনাটা দাগ কেটে গেল খুব। গ্রামটায় গেলে এখনও পারুলের মায়ের বিলাপ শুনতে পাওয়া যায়। বিলাপ করে ময়নুলও। জেলে বসে মেয়ের জন্য আফসোস করে। জেলে গিয়ে ভালোই হয়েছে। তিন বেলা খাবারের চিন্তা ঘুঁচেছে। বউয়ের জন্য মন পোড়ে না। মেয়ের জন্য পোড়ে। তা শরীরের যে অবস্থা তাতে মেয়ের কাছে যেতে খুব একটা দেরি হবে না তার। রোগে ভরা শরীরটা নিয়ে খুব বেশিদিন বাঁচবে বলে বিশ্বাস করে না ময়নুল।

চরে গিয়ে পুকুর পাড়ে দাঁড়ালে পারুলের ডুবে যাওয়া জায়গাটায় দেখতে পাওয়া যায় ফুটে থাকা অনেক অনেক পদ্ম ফুল। পদ্ম ফুলের আড়াল থেকে উঁকি মারে জল। মাঝ দুপুরে হলুদ রোদ যখন ফুলগুলোর শরীরজুড়ে খেলা করে তখন ভাগ্য ভালো থাকলে হয়ত কোনও কোনও দিন শুনতে পাওয়া যায় পারুলের কণ্ঠ।

কিন্তু সে কণ্ঠ কেউ শুনতে চায় না। মানুষের অনেক কাজ। অনেক ব্যস্ত সবাই। তাছাড়া গরীব কন্যার কোমল কণ্ঠে লোভ মাখানো সুন্দর, মিষ্টি বায়না শুনতে মানুষের বয়েই গেছে!



বাংলাদেশ সময়: ১৫২০ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।