‘রণজি ক্রিকেট প্রতিযোগিতার সেমি-ফাইন্যাল খেলায় বাঙালা ও আসাম সম্মিলিত দল, হায়দারাবাদ দলকে ১২৭ রানে পরাজিত করিয়া বিজয়ী হইয়াছে। এই রূপ ফলাফলের আশা আমরা পূর্ব হইতে করিয়াছিলাম, সুতরাং ইহাতে কোনরূপ আশ্চার্য্যান্বিত হই নাই।
রণজি ট্রফি শুরু হয়েছিল, ১৯৩৫ সালে। তবে এই উপমহাদেশে ক্রিকেট খেলার চল ছিল সেই আঠার শতকেই। প্রথম যে ম্যাচের কথা নথিবদ্ধ আছে; তা খেলা হয়েছিল ১৭২১ সালে। অবশ্য খেলেছিলেন ইউরোপিয়ান বণিকরা। যদিও কারও কারও মনে হতে পারে, এটা এমন আর কী। ডাচ, দিনেমার, পর্তুগিজ, ব্রিটিশরা জাহাজ থেকে নেমে ব্যাট-বল নিয়ে মাঠে নেমে পড়ল, আর তাতেই উপমহাদেশে ক্রিকেট জন্মের প্রথম শুভক্ষণ বলে মেনে নেয়া সঠিক হবে না। ক্রিকেট গবেষকরা অবশ্য বলছেন, ১৭৮০ সালে কলকাতায় ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব গড়ে উঠেছিল। হিকির বেঙ্গল গেজেট’-এও এর উল্লেখ আছে। তবে তা ইংরেজদেরই খেলা ছিল। সংগঠিতভাবে বাঙালিরা খেলতে শুরু করে ১৮৭০ ও ১৮৮০ সাল থেকে। ১৮৯০ সালে কোচবিহারের মহারাজা বিপুল অর্থ ব্যয়ে তিনটি ক্রিকেট দল গঠন করেন। সবই শ্বেতাঙ্গ এবং পেশাদার খেলোয়াড়। ক্রিকেটের জন্য কলকাতায় আলিপুরে মাঠ কিনে নাম দিলেন উডল্যান্ডস মাঠ। নাটোরের মহারাজাও বসে থাকেননি। তিনিও দল গঠন করলেন।
১৯০০ সালে নাটোর দলে বাঙালি খেলোয়াড় ছাড়াও ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যের সেরা ক্রিকেটারদের দলে জড় করা হয়। বালিগঞ্জে লাখ টাকা ব্যয়ে বানালেন ক্রিকেট মাঠ—নাটোর পার্ক। ১৯১১ সালে নাটোর দল বিলুপ্ত হয়ে যায়। এর পরপরই কলকাতায় গড়ে ওঠে বিভিন্ন ক্রিকেট ক্লাব। কোচবিহারের মহারাজা ইংল্যান্ড থেকে কোচও আনিয়েছিলেন প্রশিক্ষণের জন্য। অবশ্য ১৯৩০ সাল থেকে বাংলার ক্রিকেট আধুনিক হতে শুরু করে। উপমহাদেশে প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট শুরু হয় ১৮৯২ সালে। ধর্মীয় সম্প্রদায়ভিত্তিক এ খেলায় ১৯০৭ সালে ইংরেজ ও পার্সির পাশাপাশি হিন্দু সম্প্রদায় এবং ১৯১২ সালে মুসলিম সম্প্রদায় দল প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট খেলে। ১৯৩২ সালে প্রথম টেস্ট ম্যাচ হয়। অবশ্য তা ক্রিকেটের তীর্থস্থান ইংলান্ডের লর্ডসে। ধর্মীয় পরিচয়ভিত্তিক সাম্প্রদায়িক প্রতিযোগিতার বিপরীতে ১৯৩৫ সালে চালু হয় রণজি ট্রফি। অসাম্প্রদায়িক এবং রাজ্য ও প্রাদেশিক দলগুলোকে নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়।
শুরুতেই রণজি ট্রফিতে বাংলা ও আসাম সম্মিলিত দল খেলে আসছে। দলে ইউরোপিয়দের আধিক্য ছিল তখনও। ১৯৩৭ সালে বাংলা দল সেমিফাইনাল খেলে হায়দারাবাদ দলের সঙ্গে। ইংরেজ হোসি ছিলেন বাংলা দলের অধিনায়ক। হায়দারাবাদ দলের একজনও নামী খেলোয়াড় অর্থাৎ প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলায় সুনাম অর্জনকারী খেলোয়াড় ছিল না। তবু তারা বাংলা দলকে বেশ বেগ পাইয়ে দিয়েছে। ব্রজরঞ্জন রায় সাপ্তাহিক ‘দেশ’ ৪র্থ বর্ষ, দ্বাদশ সংখ্যা ফেব্রুয়ারি ১৯৩৭’-এ খেলার পর্যালোচনায় লিখেছিলেন, ‘ফিল্ডিং ও বোলিং বিষয়ে হায়দারাবাদের খেলোয়াড়গণের অনেকেরই নৈপুণ্য নামজাদা খেলোয়াড়গণের অপেক্ষা কোনও অংশে ন্যূন দেখা যায় নাই। বিশেষ করিয়া ঐ দলের হায়দার আলীর বোলিং খুবই যে উচ্চাঙ্গের তাহাতে কোনই সন্দেহ নাই। তাহার বোলিংয়ের বিরুদ্ধে খেলিতে বাঙালা ও আসাম দলের ব্যাটসম্যানগণকে রীতিমত ভয়ে ভয়ে ব্যাট চালাইতে হইয়াছে। বিশেষ করিয়া বাঙলা দলের ইউরোপিয় খেলোয়াড়গণের ব্যাটিং অস্বচ্ছন্দতা বেশ উপভোগের বিষয় হইয়াছিল। এই খেলোয়াড়টি যে শীঘ্রই ভারতীয় প্রথম শ্রেণীর খেলোয়াড়গণের মধ্যে স্থান পাইবেন, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই। তাহা ছাড়া, আইবরা, ভজুবা, মেটা প্রভৃতি তরুণ খেলোয়াড়গণের ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং বেশ দর্শনযোগ্য হইয়াছিল। ইহাদের খেলা বাঙালার নামজাদা খেলোয়াড়গণের অপেক্ষা যে কোনও অংশেই নিম্নস্তরের হয় নাই, ইহা নিঃসন্দেহে বলা চলে। হায়দারাবাদ দল পরাজিত হইয়াছে। কিন্তু তাহা হইলেও উক্ত দলের কয়েকজন খেলোয়াড়ের ক্রীড়ানৈপুণ্য বাঙলার ক্রীড়ামোদীগণের প্রাণে চিরজাগ্রত থাকিবে। ’ নামজাদা খেলোয়াড় না হয়েও সুযোগ বা সুবিধা পেলে সাধারণ খেলোয়াড়রাও যে অশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করতে পারে, হায়দারাবাদের খেলোয়াড়রা তার প্রমাণ দিয়েছে বলে ক্রীড়াভাষ্যকার উল্লেখ করেছেন।
ধর্ম সম্প্রদায়ভিত্তিক খেলার বিরুদ্ধে চালু হয়েছিল রণজি ট্রফি। এই প্রতিযোগিতার উদ্দেশ্য উৎসাহী সাধারণ প্রাদেশিক ক্রিকেট খেলোয়াড়দের আন্তর্জাতিক বা প্রতিনিধিত্বমূলক ক্রিকেট খেলার জন্য অনুশীলনের সুবিধা করে দেওয়া। বাঙলার ক্রিকেট দল নির্বাচন নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশও করা হয়েছে। ‘বাঙলা দলের এই বিজয়ের জন্য দায়ী কাহারা?’ উপশিরোনামে ব্রজরঞ্জন রায় লিখেছেন, “বাঙলা দলের এই বিজয়ের জন্য দায়ী কাহারা তাহা বিশেষভাবে চিন্তা করিয়া দেখিলে দেখা যায়, বাঙলার তরুণ উৎসাহী ক্রিকেট খেলোয়াড়গণই জয়লাভের পথ প্রশস্ত করিয়াছেন এবং অভিজ্ঞ ধুরন্ধর ইউরোপিয় ক্রিকেট খেলোয়াড়গণ যে পটভূমির পশ্চাতেই রহিয়াছেন, একথা দর্শকগণের লক্ষ্য করিতে বোধ হয় গোল বাধে নাই। ইউরোপিয় খেলোয়াড়গণ উক্ত খেলায় প্রকৃতপক্ষেই বিশেষ কিছু কৃতিত্ব প্রদর্শন করিতে পারেন নাই, কী ব্যাটিং, কী বোলিং, সকল বিষয়েই বাঙলার তরুণ খেলোয়াড়গণই সর্ব্বময় দর্শকগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছেন। ”
বাঙলা দলে মুসলিম খেলোয়াড় ছিলেন একজন, কামাল। প্রথম ইনিংসের খেলায় তরুণ খেলোয়াড় কামাল নবম উইকেটে শতাধিক রান তোলেন। তার এই খেলা দলের ইউরোপিয় খেলোয়াড়দের সকল প্রয়াসকেই ম্লান করে দিয়েছে বলে ভাষ্যকার উল্লেখ করে বলেছেন, “এই তরুণ খেলোয়াড়টি প্রকৃতপক্ষেই ঐ দিন দলের ভাগ্য পরিবর্তন করিয়া দিয়াছিলেন। ইহা সত্য যে, সেই সময় বিপক্ষ দলের বোলারগণের বলের তীব্রতাও পূর্বের ন্যায় ছিল না। তথাপি ১০০ মিনিটের মধ্যে ১০০ রান তুলিয়া তিনি যে অশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করিয়াছে, ইহা অস্বীকার করিরার কোনও উপায় নাই। ” কামালের পর খেলায় বাংলা দলের কার্ত্তিক বসু ও সুঁটে ব্যানার্জি খেলেন। তাদের ব্যাটিং ‘প্রশংসার যোগ্য’ ছিল। কার্ত্তিক বসু প্রথম ইনিংসের খেলায় হায়দারাবাদ দলের আক্রমণের চরম প্রকোপ সহ্য করেছিলেন এবং পরবর্তী ব্যাটসম্যানরা যাতে রান তুলতে পারে, তার পথ সহজ করে দিয়েছিলেন। সুঁটে ব্যানার্জি শেষ মুহূর্তে পিচে গিয়ে ৪৭ রান করে নট আউট ছিলেন। তিনি কামালকে শতাধিক রান করবার পক্ষে সাহায্য করেছিলেন।
“এই খেলায় বোলিং বিষয়ে বাঙলার তরুণ খেলোয়াড়দের কৃতিত্ব বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে। কারণ হায়দারাবাদ দলের উভয় ইনিংসে সুঁটে ব্যানার্জি ও কমল ভট্টাচার্য্য অধিক সংখ্যক উইকেট। হায়দারাবাদের দ্বিতীয় ইনিংসে কমল ভট্টাচার্যের বোলিং খুবই ভালো হইয়াছিল। তিনি ১৪ দশমিক ৫ ওভার বল দিয়া ৬টি মেডেন ও ২৯ রানে ৩টি উইকেট পাইয়াছিলেন। ” অপর বাঙালি খেলোয়াড় খোকন সেন দ্বিতীয় ইনিংসের খেলায় শেষ সময় ১৮ রান করে দলভুক্ত হবার যে তিনি সম্পূর্ণ উপযুক্ত, তা প্রমাণ করেছেন। “কারণ বেরেন্ড, স্কিনার, হোসি প্রভৃতি ধুরন্ধর খেলোয়াড়গণ ইহা অপেক্ষা অনেক কম রানে আউট হইয়াছেন। সুতরাং এই খেলায় উৎসাহী তরুণ ভারতীয় খেলোয়াড়গণই সর্ব্ব বিষয়ে ইউরোপিয়ান খেলোয়াড়গণ অপেক্ষা সাফল্য লাভ করিয়াছেন। অতএব দলে অধিক সংখ্যক ইউরোপিয়ান খেলোয়াড় না লইলেও যে বাঙলা ও আসাম দলের খেলার ফল হতাশাব্যঞ্জক হইত না, তাহা উক্ত খেলার ফলাফল হইতেই প্রমাণিত হইয়াছে। ”
ধর্মভিত্তিক ব্রিটিশদের গড়া পাঁচ দলের বোম্বাই পেন্টাঙ্গুলার নামে খ্যাত প্রেসিডেন্সি ম্যাচ অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ১৮৯২ সালে শুরু হওয়া প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের বিকাশে এই ম্যাচ যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছিল। তবে এই খেলার জনপ্রিয়তার কারণে রণজি ট্রফি প্রতিযোগিতা সর্বার্থেই মার খাচ্ছিল। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড সাম্প্রদায়িক খেলা বন্ধের জোড় দাবি জানায়। গান্ধীও এই খেলা বন্ধে বিবৃতি দেন। কিন্তু জনপ্রিয়তার কারণে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত ধর্মভিত্তিক দলগুলোর প্রতিযোগিতা ম্যাচ অব্যাহত ছিল। রণজি ট্রফি চালুর পর প্রাদেশিক ক্রিকেট দলগুলো প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলার সুযোগ পেয়েছিল।
১৯৩৭ সালে হায়দারাবাদ দলকে সেমিফাইন্যালে পরাজিত করে বাঙলা দল ফাইনালে নবনগর দলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। দল নির্বাচনে ফাইনালে বাঙলা ও আসাম দলে ইউরোপিয়দের প্রাধান্য দেয়া হয়। দলের অধিনায়ক হিসেবে হোসিকে নির্বাচিত করায় বাঙলা দল ক্ষুব্ধ হয়। কারণ হোসি কখনও উপমহাদেশের বিশিষ্ট কোনও ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় অধিনায়কত্ব করেননি। তদুপরি স্থানীয় খেলোয়াড়দের সম্পর্কে তার বিশেষ কিছু জানা ছিল না। বাঙালিরা আশা করেছিল কার্ত্তিক বসুকে অধিনায়ক করা হবে। কারণ কার্ত্তিক বসু ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে বিশিষ্ট খেলায় অধিনায়কত্ব করেছেন। অধিকাংশ ভারতীয় শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়দের সঙ্গে বা বিপক্ষে খেলার সুযোগ পেয়েছেন। সুতরাং দলে এমন খেলোয়াড় বর্তমান থাকার পরও ইউরোপিয়ানকে অধিনায়ক করা হয়েছে। এমনকি দুর্বল ইউরোপিয় খেলোয়াড়কে টিমে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। অবশ্য শ্বেতাঙ্গ খেলোয়াড় বরাবর অধিনায়ক হয়েছেন। ব্রজরঞ্জণ রায় মন্তব্য করেছেন, “একজন ইউরোপিয়ানই অধিনায়ক হইবেন, ইহা যদি তাহাদের বিধি থাকে, তবে আমাদের বলিবার আর কিছু নাই। ” অবশ্যই বলার আর কিছু ছিল না। ১৯৩৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ফাইন্যালে বাংলা দল মুম্বাইয়ের নবনগর দলের কাছে ৫ উইকেটে হেরেছিল। ইউরোপিয়ান খেলোয়াড়রা কোনও সুবিধে করতে পারেন নি। ৮৮ বছর আগে বাঙালি ক্রিকেট খেলা কণ্টকমুক্ত ছিল না। ইউরোপিয়ানদের নির্দেশ মেনে চলতে হতো। ফলে বাঙালির ক্রিকেট বিকাশ সহজসাধ্য হয়নি। উপমহাদেশের ক্রিকেটে বাঙালির অবস্থান এখন অবশ্য অনেক উর্ধ্বে। টেস্ট ক্রিকেট থেকে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে এখন বাঙালি চূড়ান্ত জয়ের আশায় পথ পাড়ি দিচ্ছে। বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০১৫ চলাকালে এই প্রতিজ্ঞা হোক সকল বাঙালির।
মুহম্মদ সবুর : কবি ও কথাসাহিত্যিক
বাংলাদেশ সময়: ১৬২৯ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০১৫