কালো রঙের মানুষ নেপাল। মুখমণ্ডলেও যে শ্রী আছে তা বলা যায় না।
নেপালের দোচালা টিনের ঘর। তাও এনজিও থেকে ঋণের টাকায় করা। সপ্তায় কিস্তি নিয়ে নেপাল যতটা চিন্তিত, তার চেয়ে বেশি শ্রাবন্তি। কারণ এনজিওতে যে শ্রাবন্তির নামটাই দেয়া। সপ্তাহ ঘুরলে ফিল্ড অফিসার বাড়ি এসে শ্রাবন্তিকেই খোঁজ করেন। যদিও নেপাল তখন খরতাপ আর পানির মাঝখানে। সাংসারিক ঝক্কিঝামেলা তাই শ্রাবন্তিকেই সামাল দিতে হয়।
প্রথম মেয়ের বয়স আট বছর। আর কোলের মেয়ের বয়স ছয় মাস না হতেই, পেট ফুলে উঁচু হয়ে গেছে। অবশ্য এনিয়ে প্রতিবেশিদের টিপ্পনী নেই। জেলে পল্লীর প্রায় প্রতিটি পরিবারে একই চিত্র। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাঠকর্মীরা যেন ওখানেই নিষ্ক্রিয়। প্রকৃতপক্ষে তা নয়। শহর আর ভদ্র পল্লীতে আদম তৈরির মেশিন এখন খুব হিসেবি। তাই জেলে পল্লীতেই ঈশ্বর আদম তৈরির ফেক্টরি করেছে।
নেপাল তার সন্তানদের চেহারাটা কবে দেখেছে মনে নেই। সন্তানের মুখের দিকে এক নজরে তাকিয়ে থাকা ভালো নয়। অমঙ্গল হয়। গাঁয়ের মানুষদের ধারণা সন্তানের মুখের দিকে তাকানো ভালো না। যদিও নজর পড়ে, তবে মুহূর্তেই ফেরাতে হবে। দৃষ্টি যদি কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হয় তবে পায়ের দিকে তাকাতে হয়। না হয় অজান শঙ্কা মনে এসে ভিড়ে।
সূর্যটা মাথার ওপর, হঠাৎ প্রসব বেদনা। পুত্র সন্তান জন্ম দিল শ্রাবন্তি। কিছুক্ষণের মধ্যে নদীর পাড় থেকে আওয়াজ আসে নেপালের কানে। ও... নেপাইল্লা... তোর পুলা অইছেরে। মুহূর্তেই নেপালের কানে খবর পৌঁছে যায়। মাঝনদী থেকে মাছ ধরার নৌকা নিয়ে ছুটে আসে নেপাল। পথটা যেন ফুরায় না। পুত্র সন্তান বলে কথা। বছর আট হলেই আপদমস্তক জেলে হয়ে উঠবে। ঘন ঘন টানে বৈঠা। মনে মনে স্বপ্ন দেখে নেপাল।
দ্রুত বাড়ি ছুটে আসে নেপাল। বাড়ির মুরব্বি মা-কাকিরা ঘরে ঢুকতে দেয় না। চিৎকার দিয়ে আরতি কাকি বলে, বাইরে থাক। আগুনে শরীর ছ্যাঁক দিয়া ঘরে আইছ। না হয়, ভূত পেতনি লগে আইব। কথা শুনে নেপাল বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকে। লুঙ্গির গিট্টা থেকে ম্যাচ বের করে আগুনের তাপ দেয় নেপাল। পাঁচ ছয়টা কাঠি আগুনে পুড়িয়েও যেন তার শরীর ছেকানো হয় না।
ঘর থেকে কুপি এনে দেয় বড় মেয়ে পুষ্প। গায়ে আগুনের ছ্যাঁকা দেয় আর পুস্পর মুখের দিকে তাকায় নেপাল। মেয়েটা এতো সুন্দর হইছে? আগে তো অনেক কালো দেখছিলাম, ভগবানের কৃপা। অথচ মেয়ে দুইটা আমবশ্যার রাতের চেয়েও কালো। আজ নেপালের কাছে সব সুন্দর মনে হয়। ঘরে ঢোকে নেপাল। আরতি কাকি চান্দের মত ফুটফুটে বাচ্চা এনে নেপালের কোলে দিলে মুখের দিকে তাকায় সে। এক পলকে তাকিয়ে থাকে।
আরতি কাকি বলে, পোলা এক্কান দিছে ভগবান বেডা। এই ভাবে ছাইয়া থাহিস না। নেপাল নজর ফেরায়। সাথে সাথে থুথু মারে। আর ভাবে...। একদিন ঘর থেকে বের হতেই মা চিৎকার দিয়ে বলেছিল বাজান হুইনা যা। ঘরে ফিরে যাওয়া মাত্রই শয্যাশায়ী মা থুথু মারলেন মুখে। আর কী যেন মন্ত্রটন্ত্র পড়লেন। মিনিট দুই পর মা বললেন, যা বাবা এবার যা। দেইখা শুইনা চলিস। সব সময়ই মা এমনটা করতেন। কখনও কখনও রাগ হতো নেপালের। থুথু মারার কী দরকার, আর্শিবাদ করলেই তো হয়!
বাংলাদেশ সময়: ১৩২৭ ঘণ্টা, মার্চ ১৭, ২০১৫