শীতকালের সকালবেলা।
ঘিঞ্জি গ্রাম, পাশ দিয়ে এঁকে বেঁকে বয়ে চলা ছোট নদী, লাগোয়া পাকা সড়ক; কুয়াশা ভেদ করে একটি বেকারি ভ্যানকে বেশ আয়েশ করে চালিয়ে নিয়ে আসতে দেখা যায় জীর্ণশীর্ণ গোছের একটি চ্যাংড়া ছেলেকে।
বেকারি ভ্যানটি বড়সড় একটি মনোহারী দোকানের কাছাকাছি চলে আসে, ছেলেটির প্যাডেল মারা বন্ধ হয়। দোকানদারের হাহাকার ভরা কণ্ঠ, মাথায় প্যাঁচানো মাফলার ভেদ করে, তার কানে এসে ঢোকে। কোন বিষয়ে কথা হচ্ছে তা সে স্পষ্ট শুনতে না পেলেও, কথা বলার আবেগাক্রান্ত ভাবে, এটুকু শুধু বুঝতে পারে যে, দোকানদার তার কোনও এক সুহৃদের সাথে বড় ধরনের কোনও দুঃখের ব্যাপার নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠেছে।
ভ্যানটি মন্থর গতিতে এগিয়ে এসে দোকানটির সামনে পৌঁছায়, কড়া ব্রেক কষে চ্যাংড়া ছেলেটি সিট থেকে নেমে পড়ে, দোকানের ভেতরে তাকায়—কী কী মাল দোকানে মজুদ আছে আর কী কী মাল দিতে হবে সেই হিসাব কষতে। শিশির ঝরার মত দোকানদারের মুখ থেকে বের হয়ে আসতে থাকা কথাগুলো এবার ক্রমেই তার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিভাবে সে পোল্ট্রি মুরগীর কারবারে গিয়ে বড় ধরনের মার খেয়েছে, দোকানদারের হতাশ কণ্ঠে তারই ম্লান বর্ণনা—সুহৃদের মুখোমুখি বসে। ছেলেটি, শুনতে শুনতেই, ভ্যানের পিছন দিকের পাল্লা খুলে বেকারি সামগ্রী বের করার কাজে হাত লাগায়; কাজের এক ফাঁকে, আড়চোখে মানুষ দুটির দিকে আবার এক নজর তাকিয়ে নেয়।
শীতকালে পেট্রোলিয়াম জেলি না মাখলে মুখের চামড়া যেমন চড়চড়ে হয়ে থাকে, দোকানদারের চোখেমুখে সহানুভূতি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তেমন ধরনে পরিস্ফুট। আর সুহৃদ ব্যাক্তিটির মুখে, লেগে থাকা আবেগের লঘুভাবকে থমথমে অবস্থায় রূপান্তরের, একটি কষ্টকর প্রচেষ্টা—নিজের আর্থিক ক্ষতির কথা উজাড় করতে থাকা লোকটি বাদে যে কেউ একবার তাকানোতেই ধরে ফেলবে। সুহৃদ ব্যাক্তিটি দোকানদারের বলতে থাকা কথার ফাঁকফোকরে ছোট ছোট আহহারে! ইশ! হায় হায়! নানা ধরনের সহানুভূতিসূচক শব্দ এমনভাবে উচ্চারণ করছে যেন মুখের চড়চড়ে চামড়ায় আলতো হাতে পেট্রোলিয়াম জেলি মেখে দিচ্ছে। লোকটির মুখে লেগে থাকা অসহায়ত্বের চড়চড়ে ভাব সহানুভূতির হালকা লেপনে কিছুটা মুছে যাওয়ার সাথে সাথে জোরালো হয়ে উঠছে আকুতির বড় বড় ছোপ, ইতোমধ্যে চোখে জল জমার উপক্রম। সমানুপাতে তার কণ্ঠে হতাশার মাত্রা এমনভাবে বেড়ে চলে যেন তাতে সমব্যাথী হয়ে সুহৃদের মুখ ফুটে বের হয়ে আসা—টেনশন কইরা আর কি কোন লাভ অবো, বারো মুস্কিল তের আসান, খোদায় যা করে মঙ্গলের নিগাই করে, আবার শুরু কইর্যা দ্যান দেহি, এই দোকানডাও তো মোটামুটি বালাই চলে, বেবাক ঠিক অইয়া যাব—হরেক রকমের আশার বাণী মূলক কথার ছিটার বিনিময়ে যাতে করে কারবারে লাখ দুই টাকা মার খাওয়ার ক্ষতি পুষিয়ে যায়।
ছেলেটির, ভ্যান হতে পণ্যসামগ্রী বের করতে থাকা, অস্তিত্ব এতক্ষণেও টের পায়নি দোকানদার—মনোবেদনা উজাড় করার কাজে এতই সে মশগুল। অবশেষে, সুহৃদ ব্যাক্তিটিই তাকে জানিয়ে দিল চ্যাংড়া ছেলেটির আগমনের খবর। স্বাভাবিকভাবে মনে হয়, দোকানদারের কাজে ব্যাঘাত হচ্ছে ভেবে সুহৃদ ব্যাক্তিটি এখনকার মত উঠে যেতে চাচ্ছে, ব্যস্ততা কাটলে আবার আসবে সমবেদনা জানাতে। বিদায় নেওয়ার জন্য, যাহোক, সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল; আরও কাছে এগিয়ে এসে দোকানদারের পুরু জ্যাকেটের উপর হাত বোলাতে বোলাতে গলার স্বরটাকে আগের চাইতেও বেশ খানিকটা নরম করে আরও কিছু সহানুভূতিসূচক কথাবার্তা বলল। চলে আসতে আসতে, বারবার মুখ ঘুরিয়ে, যুত করে বেশ কিছু আশার বাণী শোনাতেও ভুলল না সে।
দোকানদার করুণভাবে, বিরক্তি সহকারে ছেলেটির দিকে চোখ বেঁকিয়ে তাকাল। সুহৃদের উঠে যাওয়ার জন্য, এককভাবে তাকেই দায়ী করে বসল সে। তবে এই উঠে যাওয়ার পেছনে আরেকটা গোপন কারণ আছে যা সহানুভূতি পেতে থাকা লোকটির পক্ষে এই মুহূর্তে হয়ত কল্পনার সুবিস্তৃত আওতার মধ্যেও আনা সম্ভব নয়। এবার বেকারি সামগ্রীগুলো একে একে বুঝে নেওয়ার পালা লোকটির। এরপর ছেলেটি অল্প একটু দূরে রাস্তার অপর পাশে মনোহারী কাম চায়ের দোকানের দিকে ভ্যানটিকে চালিয়ে দিল।
অপর দোকানটির কাছাকাছি আসতেই ছেলেটি শুনতে পেল ঘর থেকে বের হয়ে আসা চাপা হাসির আওয়াজ। এই দোকানের একটি ঝাপ খোলা, অপরটি বন্ধ। ছেলেটি যখন ভ্যান নিয়ে দোকানের ঝাপ খোলা অংশের সামনে এসে দাঁড়াল তখন দেখতে পেল ঐ দোকানদারের সুহৃদ এবং এই দোকানদার বেশ আমেজ করে সিগারেটের ধোঁয়া ঘরময় ছড়িয়ে দিচ্ছে এবং তাদের সম্মিলিত হাসির শব্দ খানিকটা উচ্চ হতে শুরু করলেই হাসিটাকে মাঝপথে চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে বলছে, “আস্তে, আস্তে-শ্যুইনা ফালাবো, শ্যুইনা ফালাবো। ” সুহৃদ ব্যাক্তিটি মাঝে মাঝেই হাসির বেগ কিছুটা কমিয়ে এনে ঐ দোকানদারের দুঃখভারাক্রান্তভাবে কথা বলার ঢং নকল করে, খানিকপূর্বে শুনে আসা কথাগুলো, একটু একটু করে বলে যাচ্ছে—ভাবটি এমন—ব্যাপারটি যেন একঝলকেই ফুরিয়ে না যায়; চাড়িয়ে চাড়িয়ে আরও বেশ কিছুক্ষণ উপভোগ করতে পারে। এই কুয়াশাচ্ছন্ন বিষণ্ন শীতের সকালে তা যেন খেজুরের মিষ্টি রসের মত! সুহৃদ ব্যক্তিটির একটি কথা বলা শেষ হতে না হতেই কথাটিকে ছাপিয়ে উপচে পড়া উচ্চ হাসির রোল সাথে সাথেই সংক্রমিত হয়ে যাচ্ছে এই দোকানদারের মাঝে। উচ্চকিত হয়ে ওঠা হাসির বেগ কমিয়ে আনা, দোকানদারের বলা কথার কিছু অংশ বলা, আবার উচ্চ হাসির রোল, আবার হাসিটাকে চেপে ধরা, আবার ফিসফিসিয়ে সাবধান বাণীর উচ্চারণ, মাঝে মাঝে সিগারেটে তীব্র টান এবং উচ্চ হাসির আওয়াজের সাথে জড়িয়ে বিশালাকারে ফাঁক হয়ে থাকা দুই ঠোঁটের মাঝখান দিয়ে ধোঁয়ার ব্যাপকাকারের নির্গমন।
চ্যাংড়া ছেলেটি, বেশ হতভম্ব হয়ে গেছে, দোকানের ঝাপ খোলা অংশের সামনে দাঁড়িয়ে রইল। এর মধ্যেই আমোদে আচ্ছন্ন সুহৃদ ব্যাক্তিটি পাশেই কারও একজনের অস্তিত্বের চুম্বকাকর্ষণ অবচেতনে টের পেয়ে চোখ ঘুরিয়ে তাকাতেই দৃষ্টি পতিত হলো ছেলেটির মেছতা পড়া বিব্রত মুখের ওপর। মুহূর্তের মধ্যে সুহৃদ ব্যাক্তিটির মুখ ও ঠোঁট গ্রীষ্মের প্রখর রোদ্রে নেতিয়ে পড়া চারা গাছের মত ঝুলে পড়ল। জরুরি কাজের অজুহাতে, মাথাটা নুয়ে রাখা অবস্থাতেই, বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়াল সে। হাসি-তামাশা, জমজমাট আড্ডার এমন উষ্ণ পরিবেশ ছেড়ে সুহৃদ ব্যক্তিটির এই হঠাৎ গোমাড়া মুখ হয়ে উঠে পড়াতে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার খানিকক্ষণ পর ছেলেটির দিকে চোখ পড়ায় দোকানদার ব্যাপারটা যেন আঁচ করতে পারল। তবে দুজনের একজনও ঠিকমত বুঝে উঠতে পারল না—সুহৃদ ব্যাক্তিটি মুহূর্তের মধ্যে কোন দিক দিয়ে বের হয়ে কোথায় উধাও হয়ে গেল। বাষ্পে পরিণত হয়ে যেন পাতলা কুয়াশার মাঝে বিলীন হয়ে গেল সে!
বাংলাদেশ সময়: ১৩১৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৮, ২০১৫