বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের বীরত্বগাথা বর্ণনা করতে একাই বেঁচে আছেন লতিফ মিয়া। বয়স কত? জানতে চাইলে যে হাসি ছড়ালেন তাতে মুখের ভেতরে এক-দুটো দাঁতের অস্তিত্ব মিলল।
বয়স সঠিক না জানা থাকলেও সেই দিনটির কথা ঠিক ঠিক মনে আছে। স্মৃতি এখনও তরতাজা। একজন বীরশ্রেষ্ঠের বীরত্বের বর্ণনায় যে অভিব্যক্তি থাকা প্রয়োজন তার সবটাই ফুটে উঠল লতিফ মিয়ার চোখে মুখে।
‘ছয়দিন’ একলা যুদ্ধ করছে, একলাই ফাইট দিছে মিলিটারিগো লগে, বলেন লতিফ মিয়া।
তুমুল বৃষ্টি, লগের যারা আছিলো সবাই চইলা গেল, শেষের একজন সিপাই, তারও হাতে গুলি লাগল, আর চইলা গেল।
লতিফ মিয়ার সঙ্গে কথা হচ্ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার দরুইন গ্রামে বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের সমাধিস্থলের সামনে।
সমাধি সৌধের পাশেই পুকুরে হাঁটু পানিতে ঘাষ ধুয়ে সাফ করছিলেন। ডাকতেই উঠে এসে বাংলানিউজের কাছে বর্ণনা করছিলেন সেই স্মৃতি।
লতিফ মিয়া নিজ হাতে দাফন করেছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালকে। তার সঙ্গে ছিলেন আরও সাত গ্রামবাসী। তারা অবশ্য কেউ বেঁচে নেই। বীরশ্রেষ্ঠের বীরত্বগাথা বর্ণনা করতে তিনি একাই এখনও বেঁচে আছেন।
পুকুরের অন্যপাড়ে দুটি তালগাছ দেখিয়ে বললেন, ওইখানে বাংকার খুইড়া তার মইধ্যে থাইকা যুদ্ধ করছে। মোগরা বাজার আর গঙ্গাসাগর দুই দিক দিয়া মিলিটারির গোলা পড়তে ছিল। সাহস ছিল, একটুও ডরায় নাই।
দিনটা কত তারিখ ছিল? সে প্রশ্নের উত্তরে আবারও হাসি লতিফ মিয়ার। বলেন, ‘মনে নাই বাবা। ’
লতিফ মিয়ার দিন জানা না থাকলেও ইতিহাস বলে সেটি ছিল ১৭ এপ্রিল।
বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল ছিলেন চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুই নম্বর প্লাটুনের সৈনিক। কর্মতৎপরতার জন্য যুদ্ধের সময় মৌখিকভাবেই সিপাহী মোস্তফা কামালকে ল্যান্স নায়েকের দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিকেই আখাউড়ার দক্ষিণ দিক থেকে নিরাপত্তার জন্য দরুইন গ্রামে ঘাঁটি গাড়ে দুই নম্বর প্লাটুন। ১৬ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী কুমিল্লা-আখাউড়া রেললাইন ধরে উত্তর দিকে এগুতে থাকে। দরুইন গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের কথা জেনে অবস্থান নেয় মগরাবাজার আর গঙ্গা সাগরে। ১৭ এপ্রিল ভোর থেকেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী দরুইন গ্রামে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর মর্টার ও আর্টিলারি শেলবর্ষণ শুরু করে। সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল এলএমজি আর গুলি নিয়ে বাংকারে অবস্থান নেন। বেলা ১১ টার দিকে শুরু হয় শত্রুর টানা গোলাবর্ষণ। একই সঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি।
মোগরা বাজার ও গঙ্গা সাগরের শত্রু অবস্থান থেকে একের পর এক শেল আসতে থাকে। সঙ্গীদের কয়েক জন শহীদ হন, আহত হন অনেকেই। মোস্তফা কামাল মরিয়া হয়ে পাল্টা গুলি চালাতে থাকেন। সঙ্গের সৈন্যরা পেছন থেকে নতুন অবস্থানে সরে যেতে থাকলেও মোস্তফা কামাল একাই প্রতিরোধ করতে থাকেন যাতে অন্যরা নিরাপদে সরে যেতে পারেন। শেষ সঙ্গীটিও আহত হয়ে সরে গেলে মোস্তফা কামালেরও এক পর্যায়ে গুলি শেষ হয়ে যায়। আর শত্রুর আঘাতে তিনিও লুটিয়ে পড়েন।
লতিফ মিয়া বলেন, গোটা গ্রামে কেউ ছিল না, আমরা আটজন ছিলাম। বৃষ্টির পানিতে দেহ ফুলে গেছে আমরা তারে তুইলা আনলাম। কাফনের কাপড় যোগাড় করতে পারি নাই। বাংকারের বেলচা দিয়া কবর খুইরা এইখানে সৈনিকের পোশাকেই মাটি দিলাম।
পুরো ঘটনার বর্ণণায় নিজের সাহসিকতার প্রকাশ ঘটিয়ে চলছিলেন লতিফ মিয়া। বলেন, যখন আমরা মাটি দেই তখনও গোলা পড়তেছিল। আমরা ভয় পাই নাই।
আপনি কি মুক্তিযুদ্ধ করছিলেন? তারও সরল উত্তর এই সাহসী বৃদ্ধের—না বাবা, আমরা যুদ্ধ কেমনে করি। গ্রামের সবাই পালাইয়া গেছে। আমরা ছিলাম বইলাই মোস্তফা কামালকে মাটি দিতে পারছিলাম।
এখন কেমন করে চলে? সে প্রশ্নে হতাশাই ছড়ালেন বৃদ্ধ। তবে প্রতি ছয় মাসে ২৪০০ টাকা করে বয়ষ্কভাতা পান, সেটাই সম্বল। আগে আরও কম ছিল, সম্প্রতি এই ভাতা বেড়েছে, তাতেই খুশি লতিফ মিয়া।
জানালেন, তার খুব ভালো লাগে যখন কেউ বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের বীরত্বের সেই কাহিনী তার কাছে জানতে চায়। বললেন, সেই কাহিনী বলতে এখনও তার গর্বে বুক ফুলে ওঠে।
বাংলাদেশ সময় ২০২০ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৫