ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর থেকে ট্রেনে ২৫ মিনিটের পথ আখাউড়া স্টেশন। সেখান থেকে নতুন পাকা সড়ক ধরে এগোলে ডজনখানেক গ্রাম পেরিয়ে কসবার নয়ানপুর।
গ্রামটির বিশেষত্ব হলো উত্তর-দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ভারতের আগরতলা। মাঝের পকেট আকৃতিতে পূর্ব দিকে বিস্তৃত হওয়া গ্রামটিই কুল্লাপাথর। মুক্তিযুদ্ধের সময় কুমিল্লা-আখাউড়া, ভৈরব এবং ঢাকা শহর, ফরিদপুর ও নোয়াখালী জেলার অংশবিশেষ ছিল ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে। মেজর একেএম খালেদ মোশারফ (এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর) ও মেজর এ এম এন নুরুজ্জামান (সেপ্টেম্বর -ডিসেম্বর) ছিলেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কমান্ডার।
২ নম্বর সেক্টরটি আবার ছয়টি সাব-সেক্টরে বিভক্ত ছিল। এর মধ্যে আবার তিনটি ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। এই তিনটির একটির অন্তর্গত ছিল কুল্লাপাথর। যুদ্ধের সময় মুক্তাঞ্চল হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের অন্যতম আশ্রয়স্থল ছিল এ গ্রামটি।
এত জায়গা থাকতে কুল্লাপাথর গ্রামের একটি টিলার উপর কেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সমাহিত করা হলো? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে ফিরে যেতে হবে একটু পিছনে।
এই টিলার জায়গাটি যিনি দান করেছিলেন সেই আব্দুল মান্নানের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল করিমের ভাষ্যমতে, ভারতের আগরতলা ও বাংলাদেশের কুমিল্লা ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্তের গ্রামগুলিতে অসংখ্য মানুষ শহীদ হয়েছেন। তাদের সবার মরদেহ চিহ্নিত বা সমাহিত করা সম্ভব হয়নি। সুবেদার গোলাম আম্বিয়া নেতৃত্বাধীন দলে যুদ্ধ করছিলেন হাবিলদার তৈয়ব আলী। পাকিস্তানি সেনাদের খবর নিতে গিয়ে আর্টিলারি শেলের আঘাতে মারা যান তিনি। সীমান্ত হওয়ায় মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় আগরতলায়। প্রস্তাব ওঠে সমাহিত করার। তখন তিনি প্রস্তাব করেন কসবার কুল্লাপাথরে দাফন করার। পরে একটি দল এসে জায়গাটি দেখে পছন্দ করে দাফনের সম্মতি দেন। তার বাবা আব্দুল মান্নান তখন নিজে জানাজা পড়িয়ে মরদেহ সমাহিত করার ব্যবস্থা করেন। পরে গ্রামবাসীর সহযোগিতায় একে একে ৫০জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধাকে সমাহিত করা হয় এখানে।
আব্দুল করিম আবেগাপ্লুত হয়ে আরও বলেন, যাদের কবর এখানে রয়েছে তাদের স্বজনরা মাঝে-মধ্যে এখানে আসেন। জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করেন। বেশিরভাগেরই আর্থিক অবস্থা ভালো নয়।
সমাধিগুলোর মধ্যে শরিয়তপুরের প্রকৌশলী নজরুল ইসলামের কবরের পাশে একটি কবর সমান খালি জায়গা কেন রাখা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নজরুল ইসলাম মারা গিয়েছিলেন একটি হাসপাতালে। মৃত্যুর আগে তিনি বলে গিয়েছিলেন তাকে যেখানেই সমাহিত করা হোক না কেন তার পাশে যেন স্ত্রীর জন্য জায়গা রাখা হয়। তার স্ত্রী এখনও বেঁচে রয়েছেন। ঢাকায় থাকেন। তাই জায়গাটি ফাঁকা।
৫০ শহীদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, হাবিলদার, সুবেদার থেকে প্রকৌশলীও। এর মধ্যে দুজন বীরবিক্রম, একজন বীরউত্তম ও দুজন বীরপ্রতীক রয়েছেন। নিজের ডায়রিতে লিখে রেখে সবার সমাধি চিহ্নিত করার কাজটিও করেন আব্দুল করিম। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নয় মাস ধরে আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে যাদের মরদেহ আনা সম্ভব হয়েছিল কেবল তাদেরই সমাহিত করা হয় কুল্লাপাথরের টিলায়। তবে সমাহিত তিনজনের পরিচয় আজও মেলেনি।
কুল্লাপাথরে সমাহিত শহীদরা হলেন—সিলেটের হাবিলদার তৈয়ব আলী, ঠাকুরগাঁওয়ের সৈনিক দর্শন আলী, আর কে মিশন রোড ঢাকার মো. জাকির হোসেন, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার মো. আবদুল জব্বার (মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এখনো স্বীকৃতি পাননি), বগুড়ার ল্যান্স নায়েক আবদুস সাত্তার (বীর বিক্রম), কুমিল্লার সিপাহী আক্কাছ আলী, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার মো. ফকরুল আলম, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার মো. ফারুক আহম্মদ, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার মোজাহিদ নুরু মিয়া, ময়মনসিংহের নায়েক মোজাম্মেল হক, নোয়াখালীর নায়েক সুবেদার মো. আবদুল সালাম (বীর বিক্রম), ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. নোয়াব আলী, ফরিদপুরের সিপাহী মুসলীম মৃধা, শরিয়তপুরের প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. আবদুল অদুদ, কুমিল্লার সিপাহী জসিম উদ্দীন, কুমিল্লার মো. আবদুল কাসেম (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী), কুমিল্লার মো. মোশারফ হোসেন, কুমিল্লার নায়েক সুবেদার মইনুল হোসেন (বীর উত্তম), চাঁদপুরের সিপাহী মো. নুরুল হক, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার মো. আবদুল কাইয়ুম, কুমিল্লার সিপাহী হুমায়ুন কবির, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার ল্যান্স নায়েক মো. আ. খালেক, কুমিল্লার ল্যান্স নায়েক আজিজুর রহমান, কুমিল্লার মো. তারু মিয়া, চট্টগ্রামের নায়েক সুবেদার বেলায়েত হোসেন (বীর উত্তম), ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার মো. রফিকুল ইসলাম, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার মো. মোরসেদ মিয়া, কিশোরগঞ্জের শ্রী আশু রঞ্জন দে, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার মো. তাজুল ইসলাম, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার মো. শওকত, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার মো. আবদুস সালাম সরকার, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার মো. আমির হোসেন, চাঁদপুরের মো. জাহাঙ্গীর আলম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শ্রী পরেশ চন্দ্র মল্লিক, কুমিল্লার মো. জামাল উদ্দিন, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার মো. আবদুল আউয়াল, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. জাবেদ আহাম্মদ, কুমিল্লার মো. সিরাজুল ইসলাম, কুমিল্লার মো. ফরিদ মিয়া, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার মো. মতিউর রহমান, কুমিল্লার মো. সাকিল মিয়া, চাঁদপুরের আনসার ইলাহী বক্স পাটোয়ারী (বীর প্রতীক), ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার মো. আবদুর রশিদ, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার সিপাহী শহিদুল হক, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার সিপাহী আনোয়ার হোসেন, কুমিল্লার সিপাহী মো. আবদুল বারী খন্দকার এবং অজ্ঞাত তিনজন।
ওই সমাধিস্থলে থাকা নায়েক সুবেদার মইনুল ইসলামের নামেই ঢাকা সেনানিবাস এলাকার অতি পরিচিত মইনুল সড়কটির নামকরণ।
১৯৭২ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা প্রশাসক ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় এ স্থানটি সংরক্ষণ করা হয়। এছাড়াও রেস্ট হাউস, তোরণ এবং পুকুরের পাকা ঘাট নির্মাণ করা হয়। দেশ স্বাধীনের পর আব্দুল মান্নান ও তার স্ত্রী সমাধিস্থল ও এর আশপাশের ৬৫ শতাংশ জায়গা সরকারকে দিয়ে দেন। দানপত্রে সমাধিস্থলটি রক্ষাণাক্ষণের দায়িত্ব ও উন্নয়নের দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে মর্মে লেখা রয়েছে।
২০১০ সালে জেলা পরিষদ রেস্টহাউজ ও সমাধিসৌধের উদ্বোধন করা হয়। আশপাশের জমি অধিগ্রহণ করে এসব এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আরও সাড়ে ১১শ’ মুক্তিযোদ্ধার কবর, চার জাতীয় নেতা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি ও একটি হেলিপ্যাডের সমন্বয়ে বর্তমান সমাধিসৌধসহ একটি কমপ্লেক্স গড়ে তোলা এখন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল করিমের শেষ জীবনের স্বপ্ন।
বাংলাদেশ সময় ১৮০৭ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৫