এগারো কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সড়ক। এই সড়কেই দেখা মিলল তিন যোদ্ধা, আর দুই খুনির।
সড়কটি দেশের পূবাঞ্চলীয় সীমান্তে সবশেষ পাকা সড়ক। সীমান্ত জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সবচেয়ে সীমান্তঘেঁষা দুই উপজেলা আখাউড়া ও কসবাকে সংযুক্ত করেছে এই সড়ক। সড়কটি বয়ে গেছে দুই উপজেলার ডজনখানেক গ্রামের বুক চিরে। আখাউড়া থেকে কসবার দিকে গেলে হাতের বায়ে বিস্তীর্ণ মাঠের ওপারেও গুটিকয় বাড়ির বসতি কিন্তু তার ওপারেই ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগড়তলা। কোথাও কোথাও এতই কাছে যে ওইদেশের দু’একটি স্থাপনাও চোখে পড়ে।
১.
প্রথম বাড়িটিই যুদ্ধাপরাধী মোবারকের। গ্রামের নাম নয়াদিল।
একাত্তরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রাজাকার কমান্ডার ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা মোবারক হোসেনকে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানিদের দোসর হয়ে হত্যা, নির্যাতন চালানোর দায়ে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত। আখাউড়ার টানমান্দাইল গ্রামের ৩৩ জনকে গঙ্গাসাগর দিঘির পাড়ে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যার দায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে মোবারক তার সহযোগী রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। গণহত্যা, হত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের মত সব ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের মূল হোতা ছিলেন এই মোবারক।
২.
ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীর বাড়িটি পার হয়ে মাইল দুয়েকের মধ্যেই রাস্তার পশ্চিম পাশে রেলগেট পার হলেই আরেকটি স্থাপনা। গ্রামের নাম দরুইন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যাদের জানা তারা একবাক্যেই বলে দিতে পারবেন কী আছে এই দরুইন গ্রামে। এখানেই বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের সমাধি। এই গ্রামে ঘাঁটি গেড়ে যখন যুদ্ধ করে চলেছিলেন পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে—এক পর্যায়ে বিপাকে পড়ে গেলে সহযোদ্ধাদের সরে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়ে একাই যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়েছিলেন এই বাঙালি বীর। শহীদের মৃতদেহ ঘটনাস্থলের কাছেই দাফন করেন স্থানীয়রা। আর সেখানেই পুকুর পাড়ে নির্মিত হয়েছে বীর শহীদের স্মৃতিস্তম্ভ।
৩.
সড়ক ধরে আরও কয়েক মাইল এগিয়ে গেলে আরেকটি গ্রাম। নাম গোপিনাথপুর। সেখানেই হাতের ডানে চোখে পড়বে একটি বিলাসবহুল বাড়ি। বাড়ির সামনে চাঁদ-তারা। নাম ‘লালকুঠির’। আগ্রহ জাগাবেই রঙচঙে এই বাড়ি। তিন বা চারতলা ভবনটির সামনে কোনও ফটক নেই। লোহার তারের শক্ত বেড়া দিয়ে সড়কপাশের দিকটি সুরক্ষিত। কার এই বাড়ি! এটি সেনাবাহিনীর বহিষ্কৃত কর্নেল শাহরিয়ার রশিদ খানের বাড়ি। জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করে দাম্ভিক যে কয় সেনা কর্মকর্তা তাদেরই একজন এই শাহরিয়ার রশিদ খান। হত্যার প্রায় চার দশক পর বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে। ফাঁসি দেওয়া হয়েছে এই খুনিকে। তাকে কবরও দেওয়া হয়েছে এই বাড়িরই অদূরে আরেকটি স্থানে।
৪.
বাড়িতে কেউ থাকে কিনা? পথচারীদের সে প্রশ্ন করে উত্তর মিলল না। প্রত্যেকের মধ্যেই যেন এড়িয়ে যাওয়ার মনোভাব। অভিব্যক্তিতেও ঘৃণা আছে। তবে এ নিয়ে কথা বলায় অনাগ্রহটাই বেশি। পাশের বাড়ির একজন নাম না প্রকাশ করেই বললেন, শাহরিয়ার রশিদের ঘৃণিত কাজের কথা গ্রামবাসী জানে, আর সে কারণেই যত চাকচিক্য থাকুক এই বাড়ির দিকে অনেকে ফিরেও তাকায় না।
৫.
এই সড়কেরই আরেক গ্রাম পানিয়ারুপ। যে গ্রামে জন্ম এক বড় যোদ্ধার, নাম অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন দেশ স্বাধীন করার লড়াইয়ে, একটি নতুন রাষ্ট্রগঠনের স্বপ্নে বিভোর তখন তার বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকার যে আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা ফেঁদেছিল সেই মামলা লড়ে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করে এনেছিলেন এই অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক। সড়কের কসবা অংশে বায়েকপুরের গ্রাম এই বানিয়ারুপ। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এই অঞ্চলে অন্যতম সংগঠকও ছিলেন এই অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক।
৬.
অপর যোদ্ধা অ্যাডভোকেট আনিসুল হক, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে জাতির জনকের খুনিদের বিরুদ্ধে টানা আইনি লড়াই করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন। তার একনিষ্ঠ প্রচেষ্টায় ফাঁসির রায় হয় খুনিদের। যার মধ্যে কয়েকজনের ফাঁসির রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে জাতি হয়েছে কলঙ্কমুক্ত। এর পাশাপাশি বর্তমান সরকার এই আনিসুল হককে একজন দক্ষ ও যোগ্য আইনমন্ত্রী হিসেবেও পেয়েছে। কসবা এলাকায় অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি নাম এই আনিসুল হক।
বাংলাদেশ সময় ১৮৪৪ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৫