ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

চূড়ান্ত ফাইট হবে পাঞ্জাবিদের ক্যাম্প অ্যাটাক করব

স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৪০ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৫
চূড়ান্ত ফাইট হবে পাঞ্জাবিদের ক্যাম্প অ্যাটাক করব ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হবার মাত্র দু’দিন আগে বাবা আক্তার হোসেন সরকারের সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল বড় ছেলে ইউসুফ আলী সরকারের। সেইদিন বাবা জড়িয়ে ধরে তাকে বলেছিলেন, ‘তোমাদের জন্যই দেশটা স্বাধীন করব।

চূড়ান্ত ফাইট হবে। আমরা পাঞ্জাবিদের ক্যাম্প অ্যাটাক করব। দেশ স্বাধীন করেই বাংলাদেশে ফিরমু। তোমরা সাবধানে থেকো। ’

মুক্তিযোদ্ধা বাবার সেই কথাগুলো ৪৪ বছর পরও—আজও বারবার মনে পড়ে ইউসুফের। ‘বুকের ভেতর চিলিক মেরে উঠে। কখনো দুঃখ হয়। আবার এই ভেবে গর্ব হয় আমি একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। কিন্তু বাবার লাশ শেষবারের মত দেখতে না পারার শূন্যতা এখনও কুড়ে কুড়ে খায়’—বলেন আর্থিক দৈন্যতায় জীবনগতি শ্লথ হয়ে পড়া ইউসুফ।

দূর থেকে গারো পাহাড়ের হাতছানি দিয়ে যাওয়া ময়মনসিংহের সীমান্তঘেঁষা উপজেলার নাম হালুয়াঘাট। এ উপজেলার ভুবনকুড়া ইউনিয়নের মাজরাকুড়া গ্রামেই নিজের পরিবার নিয়ে থাকেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ইউসুফ আলী। ১৯৭১ সালের ৩ নভেম্বর পাকিদের সঙ্গে তেলিখালিতে সম্মুখ সমরে শহীদ হন তার বাবা।

৫৩ বছরে পা রাখা ইউসুফের যুদ্ধকালীন সময়ে বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর। ওই সময় তিনি স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বাবার সঙ্গে জীবনের শেষ দেখার ক্ষণটি এখনও অমলিন স্মৃতি হয়ে আছে তার মনে।

ময়মনসিংহের বীর মুক্তিযোদ্ধা বিমল পাল ও হালুয়াঘাট উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার কবির বেগের মাধ্যমে সন্ধান মেলে ‘মা এবং দেশের জন্য যুদ্ধে’ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আক্তার হোসেনের ছেলে ইউসুফের। মোবাইল ফোনে আলাপের পর স্ত্রী রোকেয়া খাতুনকে নিয়ে সোমবার দুপুরে আসেন শহরের গুলপুকুরপাড় ঈষাণ চত্রবর্তী রোডের ময়মনসিংহ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ইউনিট কমান্ড অফিসে।

সেখানে বসেই যুদ্ধকালীন সময়ে বাবার সঙ্গে নিজের স্মৃতিকথা বাংলানিউজের কাছে তুলে ধরেন ইউসুফ আলী সরকার। জীবনের পড়ন্ত বেলায় স্মৃতির পাতা উল্টে তিনি বলেন, শহীদ হবার দু’দিন আগে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেবার আগে বাবা আমাকে খুব আদর করেছিলেন। এটাই ছিল শেষ আদর। যুদ্ধে বাবাকে হারিয়ে বাবার শূন্যতার মাঝেই বেড়ে উঠি। ’

ইউসুফের বাম চোখে ছানি পড়লেও মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নিজের বাবার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বাবাই আমার একাত্তর। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাটি নিজের মত করে উপলব্ধি করি। বাবার শেষ কথাটির মত নিজেকে স্বাধীন দেশের একজন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় জাগে মনে। ’

শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আক্তার হোসেন সরকারের ৬ কন্যা ও ৪ পুত্রের মধ্যে দ্বিতীয় ইউসুফ। বড় বোন আমেনা খাতুনের বয়স তখন ২০ বছর। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ইউসুফ বলেন, ‘বাবা এলাকার মাতাব্বর ছিলেন। ৭১-এর এপ্রিল মাসে বাবার সঙ্গে আমরা স্বপরিবারে ভারত চলে যাই।

ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ঢালু থানার গাছুয়াপাড়া এলাকায় শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেই। সেখান থেকেই বাবা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এরপর তেলিখালি যুদ্ধে ৮ মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে তিনিও শহীদ হন। ’

শহীদ বাবার লাশ দেখা হয়নি ইউসুফের। সেই কষ্ট আজও তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায়। নিজের মুখেই বলেন, ‘আমরা বাবার লাশ পাইনি। ওই সময় পাঞ্জাবিদের ক্যাম্পে কেউ যেতে পারেনি। হানাদাররা তাদের ওই ক্যাম্পে কয়েকদিন মর্টার শেল নিক্ষেপ করায় ভয়ে কেউ আর লাশ আনতে যায়নি। মা (জান্নাত বেওয়া) সব সময় এ কষ্টে কান্নকাটি করত। ’

ইউসুফ বলেন, শরণার্থী শিবিরের লোকজন প্রথমে আমাকে ও পরিবারের সদস্যদের বোঝাত ‘তোমার বাবা আছে। ফিরে আসবে। কয়েকদিন পর সান্ত্বনা দিয়ে তারাই বলল তোমার বাবা মারা গেছেন, এই দেশের জন্য, তোমার জন্য। ’

স্মৃতি হাতড়ে সেই সময়কার ঘটনার সার সংক্ষেপ তুলে আনেন ইউসুফ। ‘বাবা কখনও গাছুয়াপাড়া আবার কখনও ঢালু মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প থেকে ১০ থেকে ১৫ দিন পরপর আমাদের শরণার্থী শিবিরে আসতেন। ওই সময় শরণার্থী শিবিরে ২০ থেকে ২৫ বছর বয়সী তরুণ যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে উদ্ধুদ্ধ করতেন।

পরে সেই তরুণ-যুবকদের নামের তালিকা করে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে নিযে নিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতেন। ’

শিশু বয়সী ইউসুফের মনে আজও সেইসব স্মৃতি দাগ কেটে আছে। তখন শরণার্থী শিবিরে চায়ের দোকান করতেন তিনি। তারও ইচ্ছা হতো পাকিদের বিপক্ষে সম্মুখ সমরে লড়তে—‘শরণার্থী শিবিরে বসেই প্রতিদিন গোলাগুলির শব্দ কানে ভেসে আসত।

হানাদারদের মর্টার শেল অনেক সময় আমাদের শিবিরে এসে পড়ত। এ কারণে বাবা সব সময় আমাদের গাছুয়াপাড়া পাহাড়ের নিচে আশ্রয় নিতে বলতেন। ’

‘আমার ঠিক মনে আছে শহীদ হবার দুদিন আগে হঠাৎ শরণার্থী শিবিরে এলেন বাবা। আমাদের সবার সঙ্গে খানিক সময় আলাপচারিতা করলেন। বললেন, “চূড়ান্ত ফাইট হবে। আমরা পাঞ্জাবিদের ক্যাম্প অ্যাটাক করব। ওদের এ দেশ থেকে তাড়াব। তোমরা সাবধানে থেকো। ’

যাবার আগে সেইদিন বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করেছিলেন। তখনও বুঝতে পারিনি বাবার এ স্নেহ-আদর যে শেষ আদর হবে’—বলতে বলতেই হু হু করে কেঁদে ওঠেন ইউসুফ। বলেন, বাবা মারা যাবার পর মাসিক সরকারি ভাতা পেত মা। কিন্তু মা মারা যাবার পর ভাতা তো দূরের কথা কেউ কোনওদিন খবর পর্যন্ত নেয়নি আমাদের। ’ আবারও হাউমাউ করে কাঁদেন ইউসুফ।

শহীদ মুক্তিযোদ্ধার এ সন্তান দারিদ্র্যতার শেকলে বন্দী নিজের জীবনের সংক্ষেপও তুলে ধরে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় ভিটেমাটি ছাড়া আর কিছুই ফেরত পাইনি। পাকিরা সব ধ্বংস করে গেছে। ১০ থেকে ১৫ বছর ঢাকার একটি টেক্সটাইল মিলে কাজ করেছি।

বাম চোখে ছানি পড়েছে। অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছি না। একমাত্র ছেলে ঢাকায় গার্মেন্টে কাজ করে। পরিবার নিয়ে খুব বেকায়দায় আছি। ’

ইউসুফের সন্ধানদাতা ময়মনসিংহের বীর মুক্তিযোদ্ধা বিমল পাল বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে ইউসুফের বাবা আক্তার হোসেন সরকার একজন গাইডার (পথ প্রদর্শক) ছিলেন। আমাদের চেয়ে বয়স বেশি হলেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাহসী মুক্তিযোদ্ধা। ’

’৭১-এর ৩ নভেম্বর তেলিখালি যুদ্ধে সম্মুখ সমরে তিনিসহ ৮ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং মিত্রবাহিনীর ২১ জন যোদ্ধা প্রাণ হারান। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই ৩৩ পাঞ্জাব তেলিখালি ক্যাম্প থেকে পাঞ্জাবিদের উৎখাত করতে পেরেছিলাম’—যোগ করেন একাত্তরের রণাঙ্গণের সেই বীর যোদ্ধা বিমল পাল।

একই বিষয়ে হালুয়াঘাট উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার কবির বেগ বলেন, ‘স্বাধীনতার আগে তিনি (শহীদ আক্তার হোসেন) আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। তিনি আমাদের পথ প্রদর্শক ও সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তার বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা আমাদের আজও আন্দোলিত করে। ’



বাংলাদেশ সময় ২০৪০ ঘন্টা মার্চ ১৭, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।