২৫ মার্চ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। কার্যত এদিন থেকেই হয়েছিল নয়মাসব্যাপী মহান মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত।
সময়টা ২৫ মার্চ, ১৯৭১। রাত তখন প্রায় ১টা। রাজধানীজুড়ে সবাই তখন ঘুমে নিমগ্ন। চারদিক সুনসান। হঠাৎ করেই যেন নেমে এলো গুমোট অন্ধকার। চারদিকে শুধু গুলির আওয়াজ। পাকিস্তানি হায়েনাদের অবিরাম তাণ্ডবে কাঁপছে বাংলার মাটি। বর্বর হানাদারের বুটের তলায় কান্নারত নিষ্পাপ শিশু আর নারী-পুরুষের বাঁচার আর্তনাদ। এ কী দুঃস্বপ্ন, নাকি সত্যি!
সেদিন খাকি পোশাকের পাকিস্তানি পিশাচদের একটাই চাওয়া, রক্ত! তারা রক্ত চায়। নিরীহ বাঙালির তাজা রক্তে পিপাসা মেটাতে চায় নিজেদের। নিমিষেই রক্তের জোয়ারে ভেসে গেল ঢাকা। বাতাস ভারি হয়ে এলো শত শত মানুষের তাজা রক্তের গন্ধে। এজন্য ২৫ মার্চের ভয়াল এ রাতের আরেক নাম কালরাত।
১.
স্বাধীন বাংলার ইতিহাসের পাতায় নিষ্ঠুর এ হত্যাযজ্ঞের নাম ‘অপারেশন সার্চলাইট’। কাপুরুষ পাকিস্তানিরা বাঙালির মুখোমুখি হতে না পেরে ঘুমন্ত মানুষের উপরই আক্রমণ চালায়। ভীতুরা দিনের আলো ভয় পায়। আর তাই বুঝি রাতের আঁধাকেই আশ্রয় করে নিল তারা। পশ্চিম পাকিস্তান এ ঘৃণ্য কাজের জন্য ব্যবহার করল ‘বেলুচিস্তানের কসাই’ খ্যাত জেনারেল টিক্কা খানকে।
একটু পেছন থেকে ইতিহাসের পাতা ওল্টালে, দিনটি ১৬ মার্চ, ১৯৭১। পশ্চিম পাকিস্তানের দমন-পীড়নে অতীষ্ট হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। বৈঠকের প্রতিপাদ্য বিষয়, বিগত দিনে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাজারো নিরীহ বাঙালি হত্যার প্রতিবাদ এবং আলোচনার মাধ্যমে সব দাবিদাওয়ার গ্রহণযোগ্য সমাধান করা। তবে কে জানত, এ আলোচনা ছিল শুধুমাত্র বাক্যব্যয় আর ইয়াহিয়ার নিছক ছলনা।
২.
আলোচনার আড়াই ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। সারাদেশের জনগণ আকুল হয়ে রয়েছে, আলোচনার ফলাফল শোনার জন্য। মনে পোষা স্বাধীন পায়রা বাংলার নীল আকাশে ওড়াবে বলে মানুষ যখন স্বপ্ন দেখছে, তখন ইয়াহিয়া তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানবাসীর মৃত্যুফাঁদের নকশা কেটে ঢাকা ছাড়লেন। ইয়াহিয়ার ঢাকা ত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় ঘুমন্ত-নিরস্ত্র জনতার উপর পাকিস্তানি সেনার পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ।
তারা বর্তমান ফার্মগেটসহ পিলখানা ইপিআর হেডকোয়ার্টারে আক্রমণ চালায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ, শাঁখারি বাজারসহ সমগ্র ঢাকাতেই শুরু হয় ব্যাপক জ্বালাও-পোড়াও ও আক্রমণ। ট্যাঙ্ক আর ভারী মেশিনগানের শব্দে ধু-ধু হয়ে যাচ্ছিল বাতাসের প্রতিটি ভাঁজ। শুধু তাই নয়, ঢাকার অলিগলিতে তারা চালায় হত্যা, লুট ও ধর্ষণ।
সে রাতেই হত্যা করা হয় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দার্শনিক অধ্যাপক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, ড. জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরদা, ড. ফজলুর রহমান খান, অধ্যাপক এম মনিরুজ্জামান, অধ্যাপক এম এ মুক্তাদির, অধ্যাপক এম আর খাদেম, ড. মোহাম্মদ সাদেক প্রমুখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের।
জগন্নাথ হলের কয়েকশ নিরীহ ছাত্রকে নির্মমভাবে হত্যা করে তাদের লাশ পুঁতে ফেলা হয় মাটিতে। রোকেয়া হলের মেয়েদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ক্যান্টনমেন্টে। বৃদ্ধ, শিশু, রিকশাওয়ালা, ভিখারি, ফুটপাথবাসী, দিনমজুর থেকে শুরু করে শহরের কোনও শ্রেণির মানুষই সেদিন রেহাই পায়নি তাদের পাশবিক অত্যাচার থেকে।
অন্যায়ভাবে পুড়িয়ে দেওয়া হয় দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ, সাপ্তাহিক গণবাংলা ও দৈনিক পিপলের অফিস। মিরপুর, মোহাম্মদপুরের বিহারিরা আশেপাশের বাঙালি প্রতিবেশিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রবল হিংস্র উন্মাদনায়।
একরাতেই চোখের পলকে বদলে গেল নগরীর চিত্র। ঢাকা পরিণত হলো মৃতের শহরে। যখন পাকিস্তানি পিশাচেরা থামল, রাত তখন শেষ। বাংলার আকাশে বিষণ্ণ সূর্য। সেদিনের সূর্যটাও যেন ছিল রক্তাক্ত। এলাকার পর এলাকা জুড়ে শুধু লাশ আর লাশ। পোড়া ছাইয়ের গন্ধের সঙ্গে মিশে গেছে লাশের গন্ধ।
৩.
এরপর ২৬ মার্চের সূর্য, প্রতিবাদের সূর্য। সবুজ বাংলার স্বাধীনতার এ লাল টুকটুকে সূর্যটাকে ছিনিয়ে আনবে বলে বেরিয়ে পড়ে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ রাতেই ঢাকায় নিয়ন্ত্রণ কায়েম করলেও দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থানীয় বাঙালি সশস্ত্র বাহিনীর সংকল্পবদ্ধ প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়।
২৫ মার্চের পাকিস্তানি সেনাদের এ আক্রমণ স্বাধীনতা যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায়, যা দীর্ঘ নয় মাস দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। আর মুক্তিযোদ্ধাসহ সব শহীদদের দৃঢ় সংকল্প আর আত্মত্যাগের মাধ্যমে আজ স্বাধীন বাংলায় উড়ছে লাল সবুজের পতাকা। তাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
বাংলাদেশ সময়: ২১২৮ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৫