‘মেজিক কারবার। ঢাকায় অখন মেজিক কারবার চলতাছে।
এরকম বহু শ্লেষ, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপাত্মক মন্তব্যে ভরপুর ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে সম্প্রচারিত ‘চরমপত্র’ অনুষ্ঠানটি। সে সময় স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান এটি। অনবদ্য এ অনুষ্ঠানটির প্রতিটি অধ্যায়ের রচয়িতা ও কথক ছিলেন কথাযোদ্ধা এম আর আখতার মুকুল (১৯২৯-২০০৪)।
হালকা ভাঙা-ভাঙা কণ্ঠের অসাধারণ শব্দচয়ন ও অনন্য বাচনভঙ্গিতে এই কথিকা মুক্তিকামী বাঙালিকে কেবল রোমাঞ্চিতই করেনি, ৫৬ হাজার বর্গমাইলের যুদ্ধাক্রান্ত দেশটির মানুষের মধ্যে বিনোদনের একমাত্র খোরাকও হয়ে উঠেছিল। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বর্বর শত্রুকে নিয়ে এমন শ্লেষ, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ নজিরবিহীনই বটে!
অন্যদিকে চরমপত্রের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ-শ্লেষ রাজাকার-আলবদর ও পাকিস্তানপন্থিদের কাছে ছিল দগদগে ঘায়ে নুনের ছিটার মত। নিছক ব্যঙ্গ-বিদ্রূপই কি ছিল চরমপত্রে? পাকিস্তানি সামরিক জান্তার পৈশাচিক বর্বরতার বিরুদ্ধে এটি হয়ে উঠেছিল মোক্ষম এক রাজনৈতিক হাতিয়ার।
১৯৭১ সালের মে থেকে ডিসেম্বর। এই আট মাস বাংলাদেশের যুদ্ধরত মুক্তিকামী মানুষ স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্রের ‘চরমপত্র’ শুনে আলোড়িত, আন্দোলিত উজ্জীবিত হতো। ২৫ মে স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্র চালু হওয়ার দিন থেকে ‘চরমপত্র’ পাঠ শুরু হয়। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয়ের দিনে ‘চরমপত্র’র শেষ পর্ব সম্প্রচারিত হয়।
‘চরমপত্র’ অনুষ্ঠানের নামকরণ করেছিলেন স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্রের একনিষ্ঠ কর্মী আশফাকুর রহমান খান।
মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ ও উদ্দীপনা দেওয়ার পাশাপাশি এই অনুষ্ঠান বাংলাদেশের শত্রুকবলিত এলাকার জনগোষ্ঠী ও ভারতে অবস্থানরত বাঙালি শরণার্থীদের মনোবল চাঙ্গা রাখতে রেখেছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
মানসম্মত রেকর্ডিং স্টুডিওর অভাবে টেপ রেকর্ডারে ‘চরমপত্র’ রেকর্ড করা হতো। ৮-১০ মিনিটের এই টেপ নিয়মিতভাবে স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্রের ট্রান্সমিটার থেকে সম্প্রচার করা হতো। ‘চরমপত্র’র প্রতি পর্বের রচনা ও ব্রডকাস্টিংয়ের জন্য এম আর আখতার মুকুল পারিশ্রমিক হিসেবে পেতেন মাত্র ৭ টাকা ২৫ পয়সা।
এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতিদিন গল্পের ছলে দুরূহ রাজনীতি ও রণনীতি ব্যাখ্যা করা ছাড়াও রণাঙ্গনের সর্বশেষ খবরাখবর সহজ, সাবলীল ও ব্রাত্যজনের ভাষায় অত্যন্ত নিষ্ঠা ও মুন্সিয়ানায় উপস্থাপন করতেন এম আর আখতার মুকুল।
যখন তিনি অনুধাবন করলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের ৯৫ শতাংশই গ্রাম-বাংলার সন্তান। তখন তিনি ‘চরমপত্র’ পঠনে চমক আনলেন। শহুরে প্রমিত ভাষা ত্যাগ করে ঢাকাইয়া ভাষার ব্যবহার করা শুরু করলেন। একইসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ঐক্য আনতে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারও শুরু করেন তিনি।
শুধু তাই নয়, নিজের সৃষ্টি নতুন নতুন শব্দ মাঝে মধ্যেই জুড়ে দিতেন চরমপত্রে। ১৯৭১ সালের ২৯ মে ‘চরমপত্র’র পঞ্চম পর্বের অংশবিশেষ ছিল এরকম—‘জেনারেল ইয়াহিয়া খান এখন ঝিম ধরেছেন। এদিকে আগায় খান, পাছায় খান, খান আব্দুল কাইউম খান আবার খুলেছেন, মাফ করবেন ‘মুখ’ খুলেছেন। আয় মেরে জান, পেয়ারে দামান, খান কাইউম খান তোমার ক্যারদানী আর কত দেখাইবা? জেনারেল ইয়াহিয়া, তোমাকে একটা কথা বলতে চাই। হা-ডু-ডু খেলা দেখেছো কখনও? সেই হা-ডু-ডু খেলায় কেচ্কি বলে একটা প্যাঁচ আছে। আর তুমি বুঝি হেই কেচ্কির খবর পাইয়া আউ-কাউ কইরা বেড়াই আছো। ’
আর ১৬ ডিসেম্বর শেষ পর্বটি ছিল—‘আইজ থাইক্যা বঙ্গাল মুলুকে মোছুয়াগো রাজত্ব শ্যাস। আট হাজার আটশ চুরাশি দিন আগে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট তারিখে মুছলমান মুছলমান ভাই ভাই কইয়া, করাচি, লাহোর, পিন্ডির মছুয়া মহারাজারা বঙ্গাল মুলুকে যে রাজত্ব কায়েম করছিল, আইজ তার খতম তারাবি হইয়া গেল। বাঙালি পোলাপাইন বিচ্ছুরা দুইশ পঁয়ষট্টি দিন ধইরা বঙ্গাল মুলুকের ক্যাদো আর প্যাঁকের মাইদ্দে ওয়ার্ল্ডের বেস্ট পাইটিং ফোর্সগো পাইয়া, আরে বাড়িরে বাড়ি। টিক্কা মালেক্যা গেল তল, পিঁয়াজী বলে কত জল?
প্রিয় পাঠক স্বাধীনতা খেতাবপ্রাপ্ত বাকযোদ্ধা প্রয়াত এম আর আখতার মুকুলের অনন্য কণ্ঠে শেষ পর্বের ‘চরমপত্র’ শুনেই দেখুন একবার। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বিশেষ আয়োজনের অংশ হিসেবে বাংলানিউজ তা ইউটিউব থেকে পাঠকদের জন্য তুলে ধরছে।
বাংলাদেশ সময়: ২২০৮ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৫