এই সঞ্চয়িতা-সঙ্গে থাকলে আমি আর কিছুই চাই না। নাটক নয়, উপন্যাস নয়, কবিগুরুর গান ও কবিতাই আমার বেশি প্রিয়।
পাকিস্তানের উপনিবেশক শাসকরা বাঙালির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক অধিকারকে পর্যুদুস্ত করার প্রক্রিয়া চালু করে সেই সাতচল্লিশে দেশভাগের পর। নির্যাতন, নিপীড়ন, জেল, জুলুম, নিষেধাজ্ঞা, বহিষ্কারের মত কঠিন কঠোর পদক্ষেপ যেমন নেয়া হয়েছিল সেই আটচল্লিশ থেকেই, তেমনি রবীন্দ্রনাথকে নিষেধ, বর্জন ও নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে। শেখ মুজিবের কাছে রবীন্দ্রনাথ সাহস হয়ে দেখা দিতেন। আর সেই সাহসে ভর করে তিনি তারুণ্য থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত বারবার জেল খেটেছেন। ফাঁসির আসামীর সেলে কাটিয়েছেন। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েননি। জানা ছিল তার, ‘ওদের বাধন যতই শক্ত হবে, তোদের বাঁধন ততই টুটবে। ’ কিন্তু শেখ মুজিব সব বাধা বিঘ্ন মাড়িয়েছেন। তাই কণ্ঠে ধ্বনিত হতো, ‘নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়, খুলে যাবে এই দ্বার। ’
সেই আটচল্লিশেই যখন জেলে গেলেন মাতৃভাষা বাংলাকে রক্ষার জন্য, তখনও রবীন্দ্রনাথ যুগিয়েছেন প্রেরণা। মায়ের ভাষার বিলুপ্তি মানেই জাতি হিসেবে বাঙালির বিলুপ্তি—এমনটা মেনে নিতে পারেননি শেখ মুজিব। তাই ‘বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি বারে বারে হেলিস না’ গেয়ে প্রতি পদক্ষেপেই বাঙালির স্বার্থরক্ষার আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়েছেন, ‘জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য’ বানিয়ে। বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের অগ্রদূত হয়ে জেগেছিলেন জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর সেই সংগ্রামের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ছিলেন যিনি পঞ্চাশ, ষাট ও মুক্তিযুদ্ধে—বাঙালির সমগ্র সংগ্রামেরই অংশবিশেষ। যে সম্মিলিত সংগ্রাম শুরু বায়ান্ন সালে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন বাঙালির রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনাকে প্রশস্ত করে নিজের দিকে ফিরে তাকানোর পথ দেখায়। বাঙালি নিজের স্বাজাত্যবোধের প্রতি ক্রমশ আগ্রহী হয়ে ওঠে। মা, মাটি, মাতৃভূমির সঙ্গে মাতৃভাষাকে অঙ্গাঙ্গি করে স্বাধিকারকামী হতে থাকে। এই স্বাজাত্যবোধের রাজনৈতিক অগ্রনায়ক হিসেবে অবস্থান পেলেন শেখ মুজিব। আর সাংস্কৃতিক অগ্রদূত হিসেবে আবির্ভূত হন রবীন্দ্রনাথ। হয়ে ওঠেন তিনি বাঙালির চেতনা স্বরূপ। যে চেতনা আপন সাহিত্য-সংস্কৃতির লালনে পুষ্ট হবার পরে বাঙালিকে বিশ্বের দিকে হাত বাড়িয়ে সকল গ্রহণীয় ঐশ্বর্য অধিগত করতে বলে। রবীন্দ্রনাথ বাঙালির জাতিসত্ত্বা সন্ধানের সহযাত্রী হয়ে ওঠেন। তার গান, কবিতা, নাটকসহ সাহিত্য মুক্তির সংগ্রামে ও যুদ্ধে বাঙালিকে এক অসমতম সংগ্রামে জয়ী হতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
বঙ্গবন্ধুর প্রতি পাকিস্তানের শাসকদের যে ঘাতক মনোভাব এবং প্রতিপক্ষে রূপান্তর করা হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথও ছিলেন পাকিস্তানী জান্তাদের প্রতিপক্ষ। তাদের সমর্থনে বাঙালি বংশোদ্ভূত পাকিস্তানী মানসিকতার শিক্ষিতজনরা বঙ্গবন্ধু এবং রবীন্দ্রনাথকে প্রতিপক্ষে পরিণত করেছিল বিশ শতকের পঞ্চাশ-ষাট দশকে। তেমনি স্বাধীনতাত্তোর বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আবারও বিতর্কিত করা হয়—যেমন বঙ্গবন্ধুকে, তেমনি রবীন্দ্রনাথকেও। আজও যা নিঃশেষ হয়ে যায়নি।
পাকিস্তান যুগে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়া যেমন অপরাধ ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশে পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটে। কোনও কিছুই রবীন্দ্রনাথকে শরবিদ্ধ করতে পারেনি। ১৯৫৩ সালে ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদ ভাষা আন্দোলনের শহীদ স্মরণে ২১ ফেব্রুয়ারি এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। তাতে আবদুল লতিফের সুর দেওয়া ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ ছাড়াও গাওয়া হয়েছিল ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। এসব গান গাওয়ার জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষ উদ্যোক্তা ছাত্রদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছিল। তবে প্রকাশ্য সভায় সে সময়ে দুঃসাহসী কাজ করেছিল ডাকসু। ১৯৫৩-৫৪ সালের ডাকসুর অভিষেক অনুষ্ঠানে গাওয়া হয় ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি। আর ছাত্রসমাজ হয়ে রবীন্দ্রনাথ ক্রমশই প্রসারিত হতে থাকেন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজে।
১৯৫৬ সালে ঢাকায় পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশন বসেছিল। পাকিস্তানের পশ্চিমাংশ থেকে আসা সংসদ সদস্যদের সম্মানে কার্জন হলে আয়োজন করা হয়েছিল অনুষ্ঠানের। উদ্যোক্তা ছিলেন গণপরিষদ সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান। অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বাঙালি সংস্কৃতিকেই তুলে ধরেছিলেন। তাতে রবীন্দ্রনাথ, ডি এল রায়, নজরুল, লোকগানও ছিল। ডি এল রায়ের ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা’ বঙ্গবন্ধুর প্রিয় গান বলেই গাওয়া হয়েছিল। অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসঙ্গীতজ্ঞ সনজীদা খাতুনও ছিলেন আমন্ত্রিত শিল্পী। তিনি মঞ্চে আসার আগে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে তাকে বলা হলো ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইবার জন্য। কারণ তিনি চাইছেন পাকিস্তানীদের কাছে ‘সোনার বাংলা’র প্রীতি ও ভালোবাসার জানান দিতে। কিন্তু সনজীদা খাতুনের গানটি পুরো মুখস্থ ছিল না। সনজীদা খাতুনের ভাষ্যে, ‘বেকায়দা হলো, কারণ অত লম্বা পাঁচ স্তবকের গানটি যে আমার মুখস্থ নেই। গীতবিতান-এর খোঁজ পড়ল। বই হাতে পেয়ে কোনওমতে অত বড় গানটি গেয়েছিলাম আমি। গানটি বাঙালিকে কতখানি আবেগ তাড়িত করে, সেইটি বোঝাবার জন্যে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিদেরকে গানটি শোনাতে চেয়েছিলেন শেখ মুজিব। তখনো “বঙ্গবন্ধু” নামটি দেয়া হয়নি তাকে। ’
এরপর থেকে সনজীদা খাতুনসহ অন্য শিল্পীরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইতে থাকেন। আর ১৯৬১ সাল থেকে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরীর অন্যতম গান হয়ে ওঠে আমার সোনার বাংলা। এ গানকে যেন বঙ্গবন্ধু আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত করে দিলেন।
১৯৬৮ সালের ১৯ জুনের ঘটনা। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা আনুষ্ঠানিকভাবে ওঠানো হলো ক্যান্টনমেন্টে স্থাপিত বিশেষ আদালতে। সব আসামীকে (মোট ৩৫ জন) একত্রিত করা হলো এই প্রথম। আর তাদেরও জানানো হলো কারা এই মামলার আসামী। ওই দিন সকালে লোহার জাল ঘেরা ভ্যানে ওঠানোর পর পরস্পরকে দেখে আবেগ, উচ্ছ্বাস, চিৎকার, হাসিকান্নায় ভ্যান সরগরম হয়ে উঠেছিল। ছাড়ার অল্প আগে বঙ্গবন্ধুকে ওঠানো হলো ভ্যানে। বসেছিলেন ভ্যানের পেছনের দরজার কাছে। সশস্ত্র প্রহরাযুক্ত ভ্যানটি ট্রাইব্যুনালের পথে যাত্রা করে। মামলার আসামী পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধা নৌকমান্ডার আবদুর রউফ সে মুহূর্তের বর্ণনা করেছেন, ‘ভ্যান চলতে শুরু করার সাথে সাথেই আমাদের কণ্ঠে একটি গানের কলি গুনগুনিয়ে উঠল। দেখতে দেখতে সমস্ত ভ্যানের আরোহীরাই তাতে কণ্ঠ মিলালো। শুধু বাসের ভেতর নয়, পথের দু’পাশেও ধ্বনিত হলো, ‘ধন্য ধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’। সশস্ত্র সেন্ট্রি ভয় পেয়ে আমাদের থামতে বলল। ভ্যানে গান গাওয়া নিষেধ আছে শুনে আমরা গান থামিয়ে দিলাম। গান থেমে গেছে দেখে বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞেস করলেন, “গান থামিয়েছিস কেন?’ আমরা বললাম যে, সেন্ট্রি গানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। বঙ্গবন্ধু এবার উচ্চকণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘আমি শেখ মুজিব নির্দেশ দিচ্ছি, তোরা গান গা...”। এরপর আমরা গাইতে শুরু করলাম। পুলিশ এবার আর কিছু বলল না। “ধন ধান্য পুষ্প ভরা” গান গাইতে গাইতে আমরা ট্রাইব্যুনালে হাজির হলাম। ’ এই মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়ে বঙ্গবন্ধু জেল থেকে বেরিয়ে এলেন। কারাফটকের সামনে দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করেচিলেন, ‘এই দেশেতে জন্ম আমার যেন এই দেশে মরি’।
তারও আগে সেই পঞ্চাশ দশকে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলাভাষায় বক্তৃতা প্রদান, রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে সোচ্চার ছিলেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বরাবর বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানতে থাকে। আরবি ও রোমান হরফে বাংলা লেখা শুধু নয়, বাংলা ভাষায় উর্দু, আরবি, ফারসি শব্দের যথেচ্ছাচার ব্যবহার চালানোর অপচেষ্টা চলে। কিন্তু বাঙালির তাতে নিশ্চুপ থাকার নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পঞ্চাশের দশকে যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী হবার পর প্রথমেই ঢাকায় গড়ে তুললেন চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা। বাঙালির জীবন ধারায় নতুন সংযোজন ঘটল। পূর্ববঙ্গেও চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হলো। বাঙালি নিজস্ব সংস্কৃতিকে তুলে ধরে চলচ্চিত্র নির্মাণে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এমনকী ষাটের দশকে পূর্ব বাংলায় উর্দু ছবির অত্যাধিক প্রদর্শনের বিরুদ্ধে এবং বাংলা ছবির করুণ অবস্থায় ক্ষোভ প্রকাশও করেছিলেন।
১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনে আসে বাধা। শেখ মুজিব এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। পাকিস্তান সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনের মাধ্যমে বাঙালির সংস্কৃতি ক্ষেত্রে এক বিশাল পরিবর্তন আসে। রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠেন বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার অন্যতম অবলম্বন। বাঙালির নিজের সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ, মমত্ব এবং ঐতিহ্য ধারণের বোধ জাগ্রত হতে থাকে। গড়ে ওঠে বাঙালির সংস্কৃতিচর্চার পাদপীঠ ‘ছায়ানট’। নববর্ষসহ ঋতুভিত্তিক উৎসব পালনের মাধ্যমে বাঙালি জাতিসত্ত্বার বিকাশে শেখ মুজিবুরের রাজনৈতিক সংগ্রামের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলন একাত্ম হয়ে উঠতে থাকে। বঙ্গবন্ধু তার পাশে পেয়েছিলেন কবি সুফিয়া কামালকে।
১৯৬৭ সালের ২৩ জুন পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী ঢাকার নওয়াব বংশোদ্ভূত খাজা শাহাবুদ্দিন বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার নিষিদ্ধ করে ঘোষণা দিল ‘রবীন্দ্র সংগীত আমাদের সংস্কৃতি নয়। ’ এর সমর্থনে এগিয়ে এলেন চল্লিশজন বাঙালি বুদ্ধিজীবী নামধারী। যাদের মধ্যে শিক্ষক, কবি, সাংবাদিক, আইনজীবী, গায়কও রয়েছেন। বাইশে শ্রাবণ উপলক্ষে তিনদিন ধরে সকল সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের যৌথ অনুষ্ঠান আন্দোলনের রূপ ধারণ করে। গভর্নর মোনেম খাঁর পুত্র অনুষ্ঠান পণ্ড করার অপচেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। বঙ্গবন্ধু বাঙালির সংস্কৃতি রক্ষায় এগিয়ে আসেন। রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে এগিয়ে নেবার প্রেরণা যোগান। রবীন্দ্র সংগীতকে মর্যাদা দান ও সাধারণ মানুষের মধ্যে তার প্রসার ঘটানোর জন্য সভা-সমাবেশে রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশন চালু করান। যার মধ্যে আমার সোনার বাংলা ছিল প্রধান। সঙ্গীতজ্ঞ ওয়াহিদুল হক, ছিলেন যিনি এই আন্দোলনের মুখ্য সংগঠকের অন্যতম, তার উপলব্ধি ‘সাতষট্টির আন্দোলনের সব চাইতে স্থায়ী ফসল “আমার সোনার বাংলা” গানটির যথাযোগ্য প্রতিষ্ঠা। ’
রবীন্দ্র বিরোধিতা পাকিস্তানি আমলেই এ দেশে রবীন্দ্রনাথকে আরো বেশি শক্তিশালী করেছে। বাঙালির জীবনে ও চেতনায় কবি আরও বেশি অবিভাজ্য হয়ে উঠেছিলেন। বাঙালির প্রেরণা, গরিমা, ঐতিহ্য, বীরত্ব, ভালোবাসা, গণমানসিকতা, সুস্থতা, পরিচ্ছন্নতা ও মানবিক মূল্যবোধের প্রতীক হয়ে ওঠেন ক্রমান্বয়ে। প্রাত্যহিক সুখ-দুঃখ আচার অনুষ্ঠান কিংবা জাতীয় সংকটে সবখানেই ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। হয়ে ওঠেন তিনি মুক্তির আশ্রয়। তার গান ছড়িয়ে পড়ে জনারণ্যে। মানব মুক্তির হাতিয়ার হলো রবীন্দ্রনাথের গান, রাজনৈতিক সম্মুখ সমরে। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় কেতনে আঁকা হলো রবীন্দ্র আলেখ্য। একাত্তরে পাক হানাদারদের বর্বরতার বিরুদ্ধে বাঙালির রক্তকে ফেনিয়ে তুলতে এবং স্বাধীনতার যুদ্ধে মৃত্যুর প্রতিরোধ ও জীবনের সংগ্রামে রবীন্দ্রনাথের গান ছিল পাথেয় ও প্রেরণা। মুক্তিবাহিনীর প্রতিটি প্লাটুন, সেকশন, লুঙ্গি পরে গেঞ্জি গায়ে চোখের জলে ভাসতে ভাসতে যে গান গেয়েছে, সেই ‘আমার সোনার বাংলা’ গ্রহণ করতে, গৌরবদান করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দেরি হয়নি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বাঙালির প্রধান সৈনিক, আদর্শের ধ্রুব। বাঙালি বারবার তার সৃষ্টির কাছে আশ্রয় খুঁজেছে অশেষ আকুলতায়। পেয়েছেও তাকে জীবনের নানা সংকটে, দুঃসময়ে। বাঙালির আনন্দ ও বেদনা, সংগ্রাম ও শান্তিতে রবীন্দ্রনাথ আজো তাই বাঙালির চিরসঙ্গী।
সত্তর সালের গোড়ায় বঙ্গবন্ধু জাহিদুর রহিমকে দায়িত্ব দেন ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের রেকর্ড প্রকাশের জন্য। কলিম শরাফী তখন ই এম আই গ্রামোফোন কোম্পানির ঢাকার কর্ণধার। ১৯৬৯ ও ৭০ সালের মধ্যে এই কোম্পানি রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীদের দুইশ’ গান রেকর্ডে ধারণ করে। প্রথম ১২টি গানের একটা গুচ্ছ গেয়েছিলেন সনজীদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন, রাখী চক্রবর্তী, আফসারি খানম, বিলকিস নাসিরউদ্দিন ও কলিম শরাফী। ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের রেকর্ড প্রকাশে ছায়ানটের শিল্পীরাও এগিয়ে আসেন। কলিম শরাফীর ব্যবস্থাপনায়, আবদুল আহাদের পরিচালনায়, সনজীদা খাতুনের বাসায় তাঁরই যত্ম-আত্তিতে খাটুনিতে তৈরি হয় গানটি। সম্মেলক কণ্ঠে ছিলেন, জাহিদুর রহিম, অজিত রায়, ইকবাল আহমদ, ফাহমিদা খাতুন, জাহানারা ইসলাম, হামিদা আতিক, নাসরীন আহমদ প্রমুখ। সর্বত্র বাজতে থাকে এই রেকর্ড। অসহযোগ আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধকালে বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের কণ্ঠে এই গান ধ্বনিত হতো। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে শিল্পী কলিম শরাফী রমনা রেসকোর্সে লাখো লাখো জনতার উপস্থিতিতে সোনার বাংলাসহ রবীন্দ্রসংগীতের এক সেট গানের রেকর্ড উপহার দিয়েছিলেন সাড়ে সাতকোটি মানুষের বিজয়ী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে।
৭০ সালে জহির রায়হান তার ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি ব্যবহার করেন। অসহযোগ আন্দোলনের সময় দিকে দিকে বেজে ওঠে ‘আমার সোনার বাংলা’। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার আগেই ভবিতব্য বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে জনগণ ‘আমার সোনার বাংলা’কে নির্বাচন করেছিল। আর এই গ্রহণের ক্ষেত্রটি তৈরি করেছিলেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। কারণ বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন রাজনীতি এবং শিল্প ও সাহিত্য একই জীবনের দু’রকম উৎসারণ। অসহযোগ আন্দোলনকালে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বেতার টিভিতে সোনার বাংলাসহ দেশপ্রেমের গান বেজেছে। সে সময় পুরো পাঁচ স্তবকই গাওয়া হতো অনুষ্ঠানে। রবীন্দ্রনাথ মূর্ত হয়ে ওঠেছিলেন বাঙালির জীবনে গণ-অভ্যূত্থানের সেই উনসত্তর সালে।
[জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে ‘আমার সোনার বাংলা’]
সোনার বাংলা গানটি পূর্ববাংলার শিল্পীরা যে সুরে গাইতেন বা এখনও গাওয়া হয়, তা স্বরবিতানে ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীর ছাপা স্বরলিপির সুরের অনুসরণ নয়। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এইচ এম ভি প্রথম ‘আমার সোনার বাংলা (নম্বর-২৭৭৯০) গানের রেকর্ড প্রকাশ করে। রেকর্ডের অপর পিঠে ছিল ‘সার্থক জনম আমার’। গেয়েছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত কন্যা সুচিত্রা মিত্র।
শান্তিদেব ঘোষ ছিলেন এই গানের ট্রেনার। ফলে স্বরবিতানের সুর থেকে এই সুরটি আরও বেশি বাউলাঙ্গ হয়ে পড়ে। এই সুরেই ফাহমিদা খাতুন ষাটের দশকের শেষ দিকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাইতেন। তারা সুচিত্রা মিত্রের রেকর্ড থেকেই গানটি তুলেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় গানটি এতোই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, ‘তখন বহু জায়গায় তা অশুদ্ধ উচ্চারণে ও ভুল সুরে কিন্তু সত্যিকার আবেগ দিয়ে গাইতে শুনেছি। ’ মুক্তিযুদ্ধকালীন শিল্পী সংস্থার অন্যতম উদ্যোক্তা সনজীদা খাতুনের উপলব্ধি ছিল তাই। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পর ‘আমার সোনার বাংলা’র প্রথম দশ চরণ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত রূপে আর ডি এল রায়ের ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা’ জাতীয় গীত হিসেবে গৃহীত হয়। আর বঙ্গবন্ধু এভাবেই তার স্বপ্নকে রূপ দিলেন মূর্ততায়।
‘আমার সোনার বাংলা গানে’ রবীন্দ্রনাথ বাউল সুর প্রয়োগ করেছিলেন। স্বদেশের বাণীকে সাধারণের মর্মমূলে প্রবেশ করানোই ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, যিনি সঙ্গীত নিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পত্রালাপ এবং বাহাস করতেন, বলেছেন তিনি, ‘বাংলাদেশের বাউল, কীর্তন, ভাটিয়ালী প্রভৃতি বিশিষ্ট প্রাদেশিক অর্থাৎ দেশি সুর পদ্ধতির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হন। বাংলাদেশের মাটির সঙ্গে, দেশের প্রাণের সঙ্গে যোগ তার খুবই নিবিড় ছিল। সেজন্য বিদেশি সভ্যতার কল্যাণে পুষ্ট স্বাধীন চিন্তা ও সৃষ্টির ধারা এই দেশের, গ্রামের পলিমাটি কেটেই বইল। ’
স্বাধীনতার পর কেবিনেট ডিভিশনের সভায় বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ও জাতীয় গীত হিসেবে দু’টি গান অনুমোদন করা হয়। কেবিনেট সচিব হোসেন তৌফিক ইমাম; টেলিভিশনের পক্ষে জামিল চৌধুরী সভায় আলোচনায় অংশ নেন। সভায় বঙ্গবন্ধু শোনেন যে, স্বরবিতানের ছাপানো সুরের সঙ্গে আমাদের শিল্পীদের গাওয়া সুরের মিল নেই। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘যে সুর গেয়ে এদেশ স্বাধীন হয়েছে, সে সুরেই আমাদের জাতীয় সংগীত গাওয়া হবে, সেটিই জাতীয় সংগীতের সুর। ’ পরবর্তীকালে জামিল চৌধুরী ‘শ্রোতার আসর রেকর্ড ক্লাব’ থেকে জাতীয় সংগীত ও জাতীয় গীতির একটি এক্সটেনডেড প্লে বা ব্যাপ্ত বাদন রেকর্ড বের করেন। দু’টি পিঠে দু’টি গান। যুদ্ধের সময় মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে যে সুরে ‘সোনার বাংলা’ গেয়েছিলেন, সেই সুরেই রেকর্ডে গাওয়া হয়। সুচিত্রা মিত্রের গাওয়া সুরের অনুসরণে মুক্তিযুদ্ধের সময় গাওয়া সুরটি ধরে রাখার জন্য তা রেকর্ডে ধারণ করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর নিদের্শে কেবিনেট সচিব এইচ টি ইমাম জাতীয় সংগীতের স্বরলিপি সংগ্রহের উদ্যোগ নেন। দায়িত্ব দেন শান্তিনিকেতনের প্রথম মুসলমান ছাত্র রবীন্দ্র স্নেহধন্য শিল্পী আবদুল আহাদকে। বলেছিলেন, ‘আমার সোনার বাংলা গানটির স্বরলিপি নিয়ে আসার জন্য আপনাকে কলকাতা অথবা শান্তিনিকেতন যেতে হবে। ’ আবদুল আহাদ, শিল্পী আতিকুল ইসলাম এবং আফসারী খানমসহ শান্তিনিকেতন যান। বিশ্বভারতীর মিউজিক বোর্ডের সভায় উপস্থিত হয়ে তারা জানালেন, ‘আমার সোনার বাংলা গানটি স্বরলিপি বইয়ে যেভাবে ছাপা আছে, সেটা আমরা গাই না। যে সুরটি প্রথম খুব সম্ভব সুচিত্রা মিত্র শিখেছিল ইন্দিরা দেবীর কাছ থেকে এবং রেকর্ডও করেছিল—বাংলাদেশের দরকার সেই সুরটির স্বরলিপি। শান্তিদেব ঘোষ যিনি রেকর্ডে সুচিত্রা মিত্রের ট্রেনার ছিলেন, সভায় তিনিও ছিলেন। আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত জানালো বিশ্বভারতী যে, তারা স্বরলিপি তৈরি করে বাংলাদেশের সরকারকে কিছুদিনের মধ্যে পাঠিয়ে দেবেন। যথারীতি বিশ্বভারতী স্বরলিপি ছাপিয়ে পাঠিয়েছিলেন সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু সে চিঠি খোলা হয়নি। দুঃখ করেন সনজীদা খাতুন, ‘বেশ কিছু পরে জামিল চৌধুরী সরকারি দপ্তরে অনাদরে পড়ে থাকা বিশ্বভারতীর ছাপানো সোনার বাংলা স্বরলিপিপত্র দেখতে পেয়ে আমাকে এনে দেন। পত্র শেষে ছাপা আছে ‘প্রথম মুদ্রণ: ফাল্গুন, ১৩৭৮’ এবং ‘দ্বিতীয় মুদ্রণ: অগ্রহায়ণ ১৩৭৯। ’ সুরটির বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে ছায়ানটের সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতার আসর রেকর্ড ক্লাবও এগিয়ে এসেছিল। জাতীয় সংগীতের সুর নিয়ে বিভ্রম ঘোচাতে তারা সচেষ্ট হলেও তা ঘোচেনি। সুর লোকমুখে প্রায় বদলে গেছে। যথাযথ সুর অনুসরণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয় না।
রবীন্দ্র সংগীত বিশেষজ্ঞ ও সংগঠক সনজীদা খাতুন বলেছেন, ‘বিশ্বভারতীর প্রকাশিত “স্বরবিতান” ষট্চত্বারিংশ খণ্ডের পৌষ ১৩৬২ থেকে শুরু করে ভাদ্র ১৩৭৮ পর্যন্ত “আমার সোনার বাংলা” গানের কেবল ইন্দিরা বেদ চৌধুরাণীর স্বরলিপিটি পাই। তার পরে শ্রাবণ ১৩৮৫ (পুনর্মুদ্রণ) প্রকাশিত স্বরবিতান ৪৬ নম্বরের শেষে ‘সুরভেদ/ছন্দোভেদ’ শিরোনামে ‘আমার সোনার বাংলা’র দ্বিতীয় স্বরলিপিটি পাচ্ছি। শুরুতে বলা আছে ‘শ্রীমতি সুচিত্রা মিত্র—গীত গ্রামফোন রেকর্ড অনুসারে শ্রীশান্তিদেব ঘোষকৃত স্বরলিপি। ’
দু’টি শক্তি এখানে মুখোমুখি। একটি শক্তি সাম্প্রদায়িক, ধর্মান্ধ হিংসার দর্শন দ্বারা পরিচালিত। অপরটি ভাষা আন্দোলনের পধ ধরে যে অসাম্প্রদায়িক, মননশীল, উদার মানবিকতার বিকাশ ঘটেছে তার পক্ষে। যদিও বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছে ধর্মীয় জাতীয়তাবোধকে বর্জন করে। বাংলাদেশে প্রকাশ্য রবীন্দ্রবিরোধিতা শুরু হয় ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর। সেই সঙ্গে বিতর্কিত করা হয় বাঙালি জাতীয়তাবোধকে। বঙ্গবন্ধুর জনসভার বাঁধা গায়ক শুধু নয়, জাহিদুর রহিম ছিলেন এদেশের প্রাগ্রসর শিল্পী। স্বাধীনতার পর স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে বাংলাদেশ বেতারে যোগ দেন। ১৯৭৭ সালের ১৬ ডিসেম্বরে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। ‘অপমানের দাহ তার পক্ষে দুঃসহ হলো’। ১৯৭৮ সালের জুন মাসে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চলে গেলেন ষাটের দশক থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রিয় গায়ক জাহিদুর রহিম। যাকে বঙ্গবন্ধু ডাকতেন ‘বাবু’ নামে। আমাদেরও জানা ছিল, তাই ‘বাবুভাই’ সম্বোধন পেতেন।
অমিতাভ চৌধুরী রবীন্দ্রনাথ নিয়ে অনেক গ্রন্থ লিখেছেন। বাহাত্তরের জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের পর লিখেছিলেন, ‘শেখ মুজিব রবীন্দ্রনাথকে কতটা ভালোবাসতেন তার পরিচয় আমরা পেয়েছি গোড়া থেকেই। মনে আছে, ১৯৭১ সালে তিনি যখন পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি জেলে বন্দী, তখন বারবার আবৃত্তি করতেন, “নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়, খুলে যাবে এইদ্বার। ” বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বাহাত্তর সালের ৮ জানুয়ারি লন্ডনে যান। অমিতাভ চৌধুরী ফোনে বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানান। বঙ্গবন্ধুর মুখে “জয় বাংলা” কথাটা শুনে আমি শিহরিত হয়েছিলাম এবং তিনি যখন ওই টেলিফোনেই বলতে শুরু করলেন “উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই, ওরে ভয় নাই” তখন আমি বাকরুদ্ধ। ’
ঢাকায় বঙ্গবন্ধুকে বাহাত্তরের জানুয়ারিতে সাক্ষাৎকালে অমিতাভ চৌধুরী উপহার দিলেন অখণ্ড গীতবিতান, সঞ্চয়িতা এবং সমগ্র রবীন্দ্র রচনাবলী। সঙ্গে সুচিত্রা মিত্রের গাওয়া একাত্তরে প্রকাশিত রেকর্ড ‘আমার সোনার বাংলা’ এবং অংশুমান রায়ের গাওয়া ‘শোন, একটি মুজিবরের থেকে। ’ উপহার নিয়ে বঙ্গবন্ধু সঞ্চয়িতার পাতা তখন উল্টে চলেছেন। পরনে হাফশার্ট ও লুঙ্গি। অমিতাভ চৌধুরী সেই মুহূর্তের কথা বর্ণনা করছেন এভাবে, ‘হাসিনা বলেন, আব্বা, মনে আছে তোমার, একটা বই—রবীন্দ্রনাথের—তাতে সব জেলের ছাপ ছিল? শেখ সাহেব সঞ্চয়িতার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে মুখ না তুলেই বললেন, “মনে থাকবে না, ও বইখানা তো ওরা পোড়ায়া দিছে। ’
বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ২৫ মার্চ রাতে যে গোলাবর্ষণ হয়েছিল, তাতে সঞ্চয়িতাও গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর গ্রন্থের সংগ্রহ পাকবাহিনী লুটপাট করে নিয়ে যায়, এমনকি গ্রামোফোন যন্ত্র। তাই রেকর্ড হাতে আক্ষেপ করে বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব বলেছিলেন অমিতাভ চৌধুরীকে উদ্দেশ্য করে, ‘হায়রে কপাল, ও তো জানেও না যে, বাড়িতে গ্রামোফোন নাই। ’ রবীন্দ্রনাথের প্রচুর কবিতা বঙ্গবন্ধুর মুখস্থ ছিল। কবিতা তাকে প্রেরণা যোগাতো। পাকিস্তানী কারাগারে নয়মাসের বন্দীজীবনে রবীন্দ্র কবিতা আওড়াতেন, ছিল যা মুখস্থ।
বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু ও রবীন্দ্রনাথকে প্রতিষ্ঠিত হতে হয়েছে অনেক ত্যাগ, তিতিক্ষা, সংগ্রাম আন্দোলনের মাধ্যমে। দীর্ঘ পরাধীন একটি পশ্চাৎপদ জাতিকে তারা আত্মবোধনে উদ্বোধন করেছিলেন। আর সেই জাতিকে তার ভাষা, সংস্কৃতিসহ একটি রাষ্ট্র উপহার দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর। ‘বাঙালি’ বলে যে জাতির কথা রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, বঙ্গবন্ধু সেই জাতিকেই আবিষ্কার করেন সোনার বাংলায়। এনে দেন আত্মমর্যাদা, স্বাধীন সত্তা। এই বাংলাকে ভালোবেসে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘আমার সোনার বাংলা’। আর বঙ্গবন্ধু তা একটি জাতির জাতীয় সঙ্গীতে রূপান্তর করে, চিরস্থায়ী করে দেন। সেই জাতীয় সংগীতের সঠিক সুর প্রয়োগ যদি না হয়, তবে বঙ্গবন্ধু বা রবীন্দ্রনাথের কাছে দায়বদ্ধতা শুধু নয়, একটি জাতির প্রতি অবহেলার নামান্তর হবে।
তবে আশার কথা যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগ জাতীয় সংগীতের জন্য একটি সংক্ষিপ্ত শিক্ষা কোর্স চালু করেছে। সেখানে ছায়ানট প্রণীত স্বরলিপি অবলম্বনে জাতীয় সংগীত শেখানো হয়। কিন্তু সাধারণ স্কুল কলেজ বা অনুষ্ঠানগুলোতে জাতীয় সংগীত যে যথাযথভাবে গাওয়া হয় না, সে বলাই বাহুল্য। বেতার টেলিভিশনও পারে যথা সুরে জাতীয় সঙ্গীত শেখানোর আয়োজনে এগিয়ে যেতে। বাংলার স্বাধীনতার সশস্ত্র সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু ও রবীন্দ্রনাথ দু’জনেই শারীরিক অনুপস্থিত থাকলেও ছিলেন সবসময়ই প্রতিটি মুক্তিকামী বাঙ্গালীর পাশে ও মনে এবং জীবনযাপনে। তারা তাদের দেশকে ভালোবাসতেন বলেই গেয়েছিলেন, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। ’
বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৪ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০১৫