ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

সেলুলয়েডে মুক্তিযুদ্ধ | সাইফ বরকতুল্লাহ

স্বাধীনতা দিবস / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৩৭ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০১৫
সেলুলয়েডে মুক্তিযুদ্ধ | সাইফ বরকতুল্লাহ

মুক্তিযুদ্ধ—আমাদের গৌরব আমাদের অহঙ্কার। লক্ষ প্রাণের রক্তের বিনিময়ে এসেছে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়।

নির্মাতারা আরেক যুদ্ধ করছেন তাদের চলচ্চিত্রে। রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধকেই বন্দি করছেন সেলুলয়েডে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের দেশে এত চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে যা আমাদের গর্ব। পৃথিবীর অন্য কোনও দেশে তাদের স্বাধীনতা নিয়ে সম্ভবত এত চলচ্চিত্র নির্মিত হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এত বেশিসংখ্যক প্রামাণ্য, স্বল্পদৈর্ঘ্য এবং পূর্ণদের্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে যে, দেশের বাইরেও তা প্রশংসা কুড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের হেরাল্ড ট্রিবিউন পত্রিকার ভাষায়, ‘আগামী প্রজন্মের কাছে সবচেয়ে গৌরব, গর্ব আর বেদনাগাথা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র পালন করে যাচ্ছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। দেশটির জন্য সত্যিই এটি আশা ও অহঙ্কারের বিষয়’। ওরা ১১জন থেকে গেরিলা পর্যন্ত যেক’টি ছবি তৈরি হয়েছে সেগুলোতে আমাদের মুক্তির সংগ্রামের ছবি ফুটে উঠেছে। বিজয়ের পর যেক’টি সিনেমা এদেশে মুক্তি পেয়েছে সেগুলোকে খাটো দেখার কোনও উপায় নেই।

১৯৬৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ছিল ৩৩টি। ১৯৭০ সালে সেটা বেড়ে হয়েছিল ৪১। যুদ্ধের আগে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ছাড়া ১৯৭১-এ আর কোনও ছবি নির্মাণ সম্ভব ছিল না। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে যুদ্ধের আগের নির্মীয়মাণ ছবিসহ ৭২ সালেই ২৯টি ছবির মুক্তি পায়।   ১৯৭২, ১৯৭৩ এবং ১৯৭৪ সালে মোট দশটি মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র তৈরি হয়। ২০০৪ সালে আবার একই বছরে তিনটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়।


 [ওরা ১১জন চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য]

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন চাষী নজরুল ইসলাম। চলচ্চিত্রটির নাম ‘ওরা ১১ জন’। ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন মাসুদ পারভেজ, জাগ্রত কথাচিত্রের ব্যানারে। চাষী নজরুল ইসলামের এটিই প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র যার কাহিনীকার আল মাসুদ, চিত্রনাট্যকার কাজী আজিজ, সংলাপে এটিএম শামসুজ্জামান। অভিনয় করেছিলেন  খসরু, শাবানা, রাজ্জাক, নূতন, সুমিতা দেবী, রওশন জামিল, এটিএম শামসুজ্জামানসহ আরও অনেকে। ১১ই আগস্ট ১৯৭২ এ মুক্তি পায় এই চলচ্চিত্রটি।

মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র সুভাষ দত্ত পরিচালিত সিনেমা ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ মুক্তি পায় ১৯৭২ সালের ৮ই নভেম্বর । কুসুমপুর গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন, নারী ধর্ষণ এবং প্রতিবাদে বাঙালিদের মুক্তি সংগ্রামকে কেন্দ্র করে এই চলচ্চিত্র নির্মিত। শতদল কথাচিত্রের প্রযোজনায় এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন আনোয়ার হোসেন, ববিতা, উজ্জ্বল প্রমুখ।

মুক্তিযুদ্ধের তৃতীয় ও চতুর্থ চলচ্চিত্র ‘রক্তাক্ত বাংলা’ এবং ‘বাঘা বাঙালী’ মুক্তি পায় ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭২ সালে। ‘রক্তাক্ত বাংলা’ পরিচালনা করেন মমতাজ আলী এবং ‘বাঘা বাঙালী’ পরিচালনা করেন আনন্দ। ১৯৭৩ সালে মুক্তি পায় আলমগীর কবির পরিচালিত ‘ধীরে বহে মেঘনা’, আলমগীর কুমকুম পরিচালিত ‘আমার জন্মভূমি’ এবং খান আতাউর রহমান পরিচালিত ‘আবার তোরা মানুষ হ’। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তরুণ প্রজন্ম কী করছে তা নিয়ে তৈরি হয় ছবিটি।

পরিচালক আলমগীর কবিরের নির্মিত ‘ধীরে বহে  মেঘনা’ চলচ্চিত্রটিতে অভিনয় করেছেন বুলবুল আহমেদ, জয়শ্রী কবির, আনোয়ার হোসেন প্রমুখ। এটি আলমগীর কবিরের প্রথম চলচ্চিত্র। ১৯৭৩ সালে নির্মিত অন্যান্য ছবিগুলো হলো, আলমগীর কুমকুম পরিচালিত ‘আমার জন্মভূমি’। ১৯৭৪ সালে মুক্তি পায় চাষী নজরুল ইসলামের ‘সংগ্রাম’, নারায়ন ঘোষ মিতার ‘আলোর মিছিল’ এবং আনন্দের ‘কার হাসি কে হাসে’।

নারয়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘আলোর মিছিল’ ছবিতে অভিনয় করেন রাজ্জাক-সুজাতা। পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবি এটি।

এ ছবিতে পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেন ববিতা। ’৭৪-এ আরও নির্মিত ছবির মধ্যে রয়েছে, মোহাম্মদ আলী পরিচালিত ‘বাংলার ২৪ বছর’। সত্তর দশকেই মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক মোট ১৩টি ছবি নির্মাণ হয়। সত্তর দশকে এতগুলো মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি নির্মাণ হলেও আশির দশকে নির্মাণ হয় মাত্র ৩টি ছবি। তাও আবার শুধু ১৯৮১ সালে। ছবিগুলো হলো, এজে মিন্টু পরিচালিত ‘বাধন হারা’, শহীদুল হক খান পরিচালিত ‘কলমীলতা’ এবং মতিন রহমান পরিচালিত ‘চিৎকার’। অবশ্য ’৯০-এর দশকে এসে মুক্তিযুদ্ধের ছবির সংখ্যা আবার বৃদ্ধি পেয়ে মোট ৭-এ দাঁড়ায়।

১৯৯৩ সালে লেখক শাহরিয়ার কবিরের লেখা এবং নাসির উদ্দীন ইউসুফ-এর পরিচালনায় নির্মিত ছবি ‘একাত্তরের যীশু’। ছবির প্রধান চরিত্রগুলোতে অভিনয় করেছেন পীযূষ বন্দোপাধ্যায়, হুমায়ূন ফরীদি, জহির উদ্দিন পিয়াল, আবুল খায়ের, আনওয়ার ফারুক, কামাল বায়েজীদ ও শহীদুজ্জামান সেলিম। এছাড়া বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন ইব্রাহীম বিদুৎ, শতদল বড়ুয়া বিলু, সাইফুদ্দিন আহমেদ দুলাল, ফারুক আহমেদ, ইউসুফ খসরু, দেলোয়ার হোসেনসহ আরও অনেকেই। ১৯৯৩ সালে হারুন উর রশীদ পরিচালিত ‘মেঘের অনেক রং’ ও ‘আমরা তোমাদের ভুলব না’ নির্মিত হয়। ১৯৯৪ সালে তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত ‘নদীর নাম মধুমতি’।

১৯৯৫ সালে কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের প্রথম নির্মিত মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমনি’। এ ছবিতে নায়ক হিসেবে মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রে অভিনয় করেন আসাদুজ্জামান নূর। ছবির নায়িকা বিপাশা হায়াত। এ ছবিতে আবুল হায়াতই তার বাবার ভূমিকায় অভিনয় করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি পরিবারের বিভিন্ন ঘটনা নিয়েই এ ছবি নির্মিত। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৯৫ সালে।   এ বছরের আরও একটি চলচ্চিত্র হলো তারেক মাসুদ পরিচালিত ‘মুক্তির গান’। চলচ্চিত্রটি প্রযোজনা করেন ক্যাথরিন মাসুদ।

১৯৯৭ সালে সেলিনা হোসেনের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ছবি ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ মুক্তি পায়। একই বছরে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে তিনটি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার পায় ছবিটি। তারেক মাসুদ পরিচালিত ও ক্যাথরিন মাসুদ প্রযোজিত ১৯৯৯ সালে নির্মিত ছবি ‘মুক্তির কথা’। ১৯৯৮ সালে নির্মিত হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’। ২০০২ সালে তারেক মাসুদ নির্মাণ করলেন ‘মাটির ময়না’।

২০০৪ সালে হুমায়ূন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নির্মিত চলচ্চিত্রের মধ্যে আরেকটি বিশেষ ছবি ‘শ্যামল ছায়া’। এছাড়া একই বছর তৌকির আহমেদ নির্মাণ করেন জয়যাত্রা, হুমায়ূন আহমেদ পুনরায় নির্মাণ করলেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র শ্যামল ছায়া। ২০০৪ সালে চাষী নজরুল ইসলামের ‘মেঘের পর মেঘ’।

২০০৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তি পায় চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ছবি ‘ধ্রুবতারা’। এ ছবির বিশেষ ভূমিকায় অভিনয় করেন মৌসুমী। মৌসুমী অভিনীত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম ছবি এটি। ২০০৬ সালে মোরশেদুল ইসলাম নির্মাণ করেন ‘খেলাঘর’।

সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘নিষিদ্ধ লোবান’ অবলম্বনে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও চলচ্চিত্রকার নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু ২০১১ সালে নির্মাণ করেন ‘গেরিলা’। গেরিলা ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পুরস্কার ও প্রশংসা অর্জন করেছে। এতে অভিনয় করেছেন জয়া আহসান, ফেরদৌস, শতাব্দী ওয়াদুদ প্রমুখ।

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আরও ছবি হলো, শাহজাহান চৌধুরীর ‘আত্মদান’। ছবিতে অভিনয় করেছেন নিরব ও নিপুন। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে একজন মুক্তিযোদ্ধা ভিক্ষুকের গল্প নিয়ে খালিদ মাহমুদ মিঠু নির্মাণ করে ‘গহীনে শব্দ’। ছবিতে মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রে অভিনয় করেছেন মাসুম আজিজ। সোহেল আরমান পরিচালিত ‘এই তো প্রেম’। ইলাজার ইসলাম পরিচালিত ‘দীপ নেভার আগে’।

এ ছবিটি জাহানারা ইমামের উপন্যাস ‘একাত্তরের দিনগুলি’ অবলম্বনে নির্মিত। মুক্তিযুদ্ধের নির্মিত চলচ্চিত্র ‘কারিগর’। ইমপ্রেস টেলিফিল্ম প্রযোজিত স্বাধীনতা দিবসকে উদ্দেশ্য করে, গত ২৩ মার্চ বলাকা সিনেওয়ার্ল্ডে মুক্তি পেয়েছে এ ছবিটি। এ ছবিতে অভিনয় করেছেন রোকেয়া প্রাচী, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, সুষমা সরকার, রাণী সরকার, হিমা মৃধা, গোলাম মোস্তফা, মাসুদ আলম বাবু, শামীম খান প্রমুখ।

আমাদের চেতনা জুড়ে ছড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের জাতীয় জীবনে সবচেয়ে গৌরব ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে মর্যাদার সঙ্গেই চলচ্চিত্রে তুলে ধরেছেন আমাদের অভিনয় শিল্পী, নির্মাতারা। যা দিয়ে আমাদের আগামী প্রজন্ম জানতে পারবে আমাদের গৌরব সম্পর্কে।



বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৮ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।