মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স মাত্র ৬/৭ বছর। এ সময়ের স্মৃতি মানুষের মনে থাকে না।
জালাল চাচার কথা মনে পড়ে গেল। আমাদের পাড়াতেই তার বাড়ি। আমার বাড়ি থেকে কয়েক কদম পূর্বদিকে। তিনি আমাদের থেকে ৪/৫ বছরের বড়। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি আমাদেরকে নিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলতেন। বাঁশ দিয়ে এক ধরনের নকল বন্দুক বানানো হতো। এর কৌশলটি তার নিজের আবিষ্কার ছিল। এই বাঁশের ভেতর বন্দুকের ট্রিগারের মত একটা জিনিস থাকে। সেখানে গুলিও ভরা যেত। গুলি ছিল পাটকাঠি। এই পাটকাঠির গুলি দিয়ে পাঞ্জাবি আর মুক্তিরা যুদ্ধ করত। জালাল চাচা আমাদের কমান্ডার, তিনি আমাদেরকে দাঁড় করিয়ে লেফট-রাইট করতেন। তার কাছ থেকেই প্রথম শোনা—এটেনশন, স্টেন্ডেট ইজ, ফরোয়ার্ড মার্চ, কুইক মার্চ—এসব শব্দ। আমার সঙ্গে আরও কয়েকজন ছিল এই খেলায়। সবার নাম মনে নাই। নানাবাড়ির জামাল, তার পাশের বাড়ির হেলাল, তার ছোট ভাই জালাল, ছফর, আছাদ—এরা ছিল আমাদের যোদ্ধাদলের সঙ্গী। আমাদের কাজ ছিল মাঝে মাঝে দল বেঁধে বাড়ির পাশের রাস্তায় শ্লোগান দেয়া।
আমার জীবনে একমাত্র মুক্তিযোদ্ধাকে দেখেছিলাম যুদ্ধের সময়কালে। তিনি আমাদের হান্নান দাদা। আমাদেরই আত্মীয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি যুদ্ধে গিয়েছিলেন। তাঁর মা আমাদের বাড়িতে এসে প্রতিদিন কান্নাকাটি করতেন। ছেলে বেঁচে আছে, না মারা গেছে, এটা তিনি জানতেন না। যুদ্ধের সময়ই তিনি একদিন বাড়ি এলেন। তাঁর গায়ে বাদামি রঙের খাকি পোশাক। কোমরের কাছে বিরাট আকারের একটা বেল্ট। বেল্টের সঙ্গে গুলি লাগানো, আমরা তাঁর পাশে গিয়ে বসি। তার পাশে রাখা বন্দুক ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করি। তিনি বন্দুকে হাত দিতে দেন না। আমি নাম জিজ্ঞেস করি। বলেন, এটা ‘ইস্টেনগান’।
এই স্টেনগান থেকে কী করে গুলি বের হয় আমার খুব জানতে ইচ্ছে হয়েছিল। তিনি আমাদের নিয়ে বাড়ির পুকুরপাড়ে আসেন। তার সঙ্গে আমরাও আসি। কাচ্চাবাচ্চার দল—১৫-২০ জন তো হবেই। আমাদের নিয়ে হান্নানদা বাড়ির বাইরে পুকুরপাড়ে আসেন। বেল্ট থেকে বের করে গুলি লোড করেন, ট্রিগার টিপে টিপে অনেক খোলা ফায়ার করেন উপরের দিকে।
আরেক মুক্তিযোদ্ধাকে দেখেছিলাম, সেটা অবশ্য দেশ স্বাধীন হবার পর। ২৫-২৬ বছর বয়স তার। তরুণই। কিন্তু চুলদাঁড়িগোঁফ কিছুই কাটা নেই। বাউল দরবেশের মত চেহারা, অনেক বড় হবার পর বিপ্লবী নেতা চে গুয়েভারার যে ছবিটা দেখেছিলাম, অনেকটা সেরকম। ঈদগাঁ বাজারে হাঁটতে গিয়েছি। সে-যোদ্ধা তখন বাজারে এসেছেন। তাঁর হাতেও তখন বন্দুক। লোকজন বলল, উনিও আমাদের গ্রামের যোদ্ধা, তবে যুদ্ধ করেছেন খুলনা অঞ্চল থেকে। সেখানেই সে সময় ছিলেন তিনি। তার নাম আতাউর। তিনি নাকি পণ করেছিলেন দেশ স্বাধীন না হলে কোনওদিন চুলদাঁড়ি কাটবেন না। এখন দেশ স্বাধীন হয়েছে। অস্ত্র জমা দেবেন আর চুলদাঁড়িও কাটবেন।
দেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। এটা খুব ভালো করে বুঝতে পারতাম না। আমার বাবা জাহাজে চাকরি করতেন, তিনি তখন জাহাজে। দাদা হ্বজে। বাড়িতে মা আর দাদী। আমার ছোট একটা বোন আছে। ওর মুখ থেকে একটু একটু কথা ফুটেছে। হঠাৎ শুনি সে বলে—‘জালাললা, জালাললা’—এর কোনও মানে বুঝি না। দু একদিন পর শুনি ও বলছে, ‘হুশিয়া, হুশিয়া...’।
আমরা তখন আমাদের কমান্ডার জালাল চাচার নেতৃত্বে যে স্লোগান পেতাম—‘পাকিস্তানের দালালরা, হুঁশিয়ার, হুঁশিয়ার’ আসলে এই কথাগুলোই সে তখন বলত।
বিকেলবেলা আমরা কখনও ‘মুক্তি মুক্তি’ খেলতাম কখনও বা গোল্লাদৌড়। গ্রামে আমাদের বাড়িটি শেষ মাথায়, পশ্চিমপাড়ে। তারপর মাঠ। সেই মাঠে আমরা খেলছি। এমন সময়, দেখি আমাদের বাড়ির উপর দিয়ে ধোঁয়া উড়ছে। বেশ বড় কুণ্ডলি পাকানো ধোঁয়া। এরকম ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। কিছু কিছু বাড়িতে আগুন লাগানো হয়েছে। যেসকল পরিবারের লোকজন মুক্তিযুদ্ধে গেছে, তাদের বাড়ি পোড়ানো হচ্ছে। আমি প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেলাম—নিশ্চয়ই হান্নানদার ঘরে আগুন দেয়া হয়েছে। আমরা দৌড়ে আবার বাড়ির কাছাকাছি এসে দেখি—আগুন আসলে অনেক দূরে। খালেদ ছিল আমাদের সাথে খেলায়, সে বলল আজির উদ্দিনের বাড়িতে আগুন দিয়েছে। আজির উদ্দিন আমার মামা হন, তিনি মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক।
এর কয়েকদিন পর আবার মাঠে খেলছি। আজ খালেদ নাই। ২/৩ দিন ধরে সে খেলতে আসছে না। হঠাৎ দেখি তার বাড়ির উপর আগুনের ধোঁয়া। আমরা দৌড়ে তার বাড়ির দিকে যেতে চাইলাম। গ্রামের লোকজন বলল, রাজকাররা আছে ওখানে, যে আগুন নেভাতে যাবে, তাকেও পিটাবে। আমরা ভয়ে কেউ আর যাইনি।
আরেকদিন বিকেলবেলা। পশ্চিমের মাঠে খেলছি, এমন সময় ২০-২৫ জনের একদল লোক পশ্চিমের হাওড় পেরিয়ে আমাদের গ্রামের দিকে যাচ্ছে। ওদের দলে বুড়াবুড়ি, তরুণী আর কোলে ২-৩টা বাচ্চাও ছিল। ওদের চেহারা দেখে বুঝতে পারছি, ওরা হিন্দু। মহিলাদের কপালে সিঁদুর, লোকগুলোর কারও কারও পরনে ধূতি। মাগরিবের আজান হয়ে গেছে, আমরা খেলা ছেড়ে বাড়ির দিকে রওনা দিই।
বাড়ি এসে দেখি, সেই দল, আমাদের বাড়ির পূর্বপাশে যে টংগি ঘর ছিল, তার বারান্দায় বসে আছে। ঘরের ভেতর গিয়ে শুনি অন্য অবস্থা। আম্মা বলেন, এরা হিন্দু শরণার্থী। সুনামগঞ্জ থেকে হেঁটে এসেছে সারাদিন, কেউ খায়নি। তারা নাকি রাতে আমাদের বাড়িতে থাকতে চায়। সকাল হলেই তারা আবার চলে যাবে। এরা যাবে ইন্ডিয়া। ইন্ডিয়ার বর্ডার আমাদের বাড়ি থেকে আরও ৪-৫ মাইল দূরে।
আমার আম্মা খুব ধর্মপ্রাণ মহিলা। তিনি হিন্দুদের ঘরের ভেতর ঢুকতে দেন না। গগন নামে এক হিন্দু দইয়ালা আমাদের বাড়িতে আসত যখন বাবা থাকতেন। এই দইওয়ালাকে তিনি ঘরে ঢুকতে দিতেন না। কিন্তু এখন দেখি আম্মার অনেক ব্যস্ততা। তিনি বললেন—এসে লোককে খাওয়ানোর মত কিছু নাই। আমাকে পাঠালেন মুদরিছ চাচার দোকানে ডাল আর পেঁয়াজ কেনার জন্য। আমি আমার চাচাত ভাই আলমকে নিয়ে সন্ধ্যাবেলা দোকানে গেলাম। ডাল এলো, পেঁয়াজ এলো। এক ফাঁকে টংগি ঘরে এসে দেখি, মহিলারা বাচ্চা নিয়ে ঘরের মেঝেতে শুয়ে আছে, পুরুষেরা বারান্দায়। এরা কত রাত এভাবে থাকবে বুঝতে পারি না। ভেতর বাড়িতে তাদের নিয়ে যাবার কোনও পরিকল্পনা আম্মার যে নেই, এটা বুঝতে পারছিলাম।
নিজের ঘরে এসে দেখি, আম্মা রান্নাঘরে ডাল রাধতে ব্যস্ত। গরম ভাত আর ডাল পাঠানো হলো টংগি ঘরে।
পরদিন সকালবেলা মসজিদে যাব মিয়াছাবের কাছে পড়তে। আমি উঁকি মারি টংগি ঘরের ভেতর। গিয়ে দেখি, কেউ নেই।
দিনের আলো ফুটে ওঠার আগেই হিন্দু শরণার্থীরা সবাই চলে গেছে। ২০-২৫ জনের দল কেমন করে একটা ঘরে রাত কাটাল, কিছুই জানতে পারলাম না। ১৯৭১ সালে ৬-৭ বছরের এক শিশুর তখন কতটুকুই বা জানার কথা!
বাংলাদেশ সময়: ০৯১৭ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০১৫