ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

বাংলাদেশ বেতারের শ্রোতাবন্ধুহীনতা | তুষার আবদুল্লাহ

স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯২০ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০১৫
বাংলাদেশ বেতারের শ্রোতাবন্ধুহীনতা | তুষার আবদুল্লাহ

লেখার প্রতিপাদ্য যদি হয় উজ্জীবিত বা প্রণোদিত শব্দ যুগল, তাহলে আলোচনার ব্যপ্তি ’৭১ থেকে ২০১৫ নাগাদ বিস্তৃত করা সহজ হবে। মনে করি এই বিস্তৃতির অনিবার্যতাও আছে।

একাত্তরে রণক্ষেত্রে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য উজ্জীবনী ভূমিকা রেখেছিল বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। যা পরবর্তীতে পরিচিতি পায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নামে।

বাংলাদেশের প্রথম বেতার কেন্দ্রের কাজই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে। দেশের শিল্পী ও চিন্তক শ্রেণির যারা বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম বাংলায় যেতে পেরেছেন, তাদের একটি বড় অংশই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। রণাঙ্গন থেকে কোনও কোনও মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাংবাদিকতাও করেছেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিকল্প সেনাপতির কাজও করেছে। কারণ যুদ্ধের গতি প্রকৃতি কোন দিকে যাচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধাদের কী কৌশল নিতে হবে, সেটা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র সূত্রে পেয়ে যেতেন মুক্তিযোদ্ধারা।

অন্যদিকে পাক হানাদার বাহিনীকে হতাশায় নিমজ্জিত করা, মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করার কাজটিও করেছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত উর্দু অনুষ্ঠান। যারা মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নিতে পারেননি, তারাও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের নয়মাসে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র জনমানুষের গণমাধ্যম হিসেবে নিজের স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করতে পেরেছিল। জনগণ এই বেতারকে গ্রহণ করেছিল নিজেদের মত প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে। বলা যায় একাত্তরের এটিও একটি বড় বিজয় বা অর্জন।

মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন হবার পর গঠিত হলো বাংলাদেশ বেতার। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অভিজ্ঞতার আলোকে প্রজাতন্ত্রের নাগরিকেরা ভেবেছিলেন, বাংলাদেশ বেতারও তাদের মতপ্রকাশের মাধ্যম হবে। কিন্তু তাদের সেই ধারণা বা বিশ্বাসটি মিথ্যে হয়েছে বা বলা যায় তারা প্রতারিত হয়েছেন। এই গণমাধ্যমটি আর জনমানুষের থাকেনি। বাংলাদেশ বেতার বিভিন্ন তরঙ্গ এবং উপকেন্দ্রে বিস্তৃত হয়েছে, কিন্তু সেই তরঙ্গটি রাষ্ট্র বা ক্ষমতার কাঠামোর প্রচার যন্ত্র হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে বেশি। দেশে টেলিভিশন সহজলভ্য হবার আগ-পর্যন্ত বেতারের ওপরই ছিল শ্রোতাদের নির্ভরশীলতা। খবরের জন্য তারা বেতারের দিকেই কান পেতে থাকতেন। একটা পর্যায় পর্যন্ত মানুষ বেতার যা বলত, তাই বিশ্বাস করত।

ধীরে ধীরে মানুষের সেই বিশ্বাসের ভূমিতে ধস নামতে থাকে। রাজনৈতিক সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে যখন সামরিক সরকার ক্ষমতায় আসে, তখন থেকেই মূলত বেতার সরকারি যন্ত্রে রূপ নিতে থাকে। স্বৈরাচার সরকারের সময় থেকেই বেতার সাহেব-গোলামের বাকসোতে রূপ নেয়। বেতারের এই রূপবদল ঐ মাধ্যমটির প্রতি সরিয়ে নেয় জনগণের আস্থা। এর যৌক্তিক কারণও ছিল। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময় সাধারণ জনগণের ওপর রাষ্ট্রযন্ত্রের যে নৃশংসতা  নেমে  এসেছিল, তার খবর কিন্তু বাংলাদেশ বেতারে আসেনি। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের খবরও জায়গা পায়নি সরকারি বেতার যন্ত্রে।

হুম, বাংলাদেশ বেতার আসলে এতদিনে সরকারি বেতার যন্ত্রের পুরো চরিত্রই নিয়ে নিয়েছিল। সেখানে জনগণের কোনও সংবাদ পাওয়ার সুযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। জনগণ তখন সত্য খবরের জন্য আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকার প্রতি নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। সেখান থেকেই দিনশেষে দেশের রাজনৈতিক খবরাখবরের হাল নাগাদ অবস্থা জানতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে শ্রোতারা।

নব্বইতে স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটলেও, বাংলাদেশ বেতারকে ব্যবহারের যে অভ্যাসটি রাষ্ট্রযন্ত্র বা ক্ষমতাসীনদের হয়ে উঠেছিল—সেই বলয় থেকে পরবর্তী গণতান্ত্রিক সরকারগুলোও আর বের হতে পারেনি। আজও বাংলাদেশ বেতার সরকারের প্রচার যন্ত্র হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে। গণমাধ্যম বিস্ফোরণের ফলে বেসরকারি টেলিভিশন এবং বেতার আসাতে সত্য খবরের জন্য আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের প্রতি শ্রোতাদের এখন আর নির্ভর করতে হচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু বাংলাদেশ বেতার তার শ্রোতাদের আর ফিরিয়ে আনতে পারেনি সত্য খবর জানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে।

কেবল খবরের কথাই বলছি কেন, অনুষ্ঠান তৈরির ক্ষেত্রেও দলীয় বিভাজন বা দলকানা আচরণটি বেতারে স্পষ্ট। অনুষ্ঠানগুলোকেও সরকারের প্রপাগান্ডা এবং সরকারিদল মনষ্কদের পদচারণায় মুখর রাখা হয়েছে। কোনও কোনও গণমাধ্যম বিশ্লেষকদের মতে, এই ভূমিকাটি স্বৈরাচার সরকারের সময়কালের চেয়ে গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর সময়কালে আরও প্রকট হয়ে দেখা দেয়। এবং ক্রমশ তা ঘনীভূতই হচ্ছে।

বেতার তার পচাঁত্তর বছর পালন করল। বিষয়টি গৌরবের। কিন্তু এই বেতারের গোড়া পত্তন বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালীন সূচনালগ্নে এবং স্বাধীন বাংলা বেকারকেন্দ্রের সঙ্গে যাদের সম্পৃক্ততা ছিল, তারা গৌরবের চেয়ে বরং শ্বাস ছাড়ছেন বড় দীর্ঘ করে। আফসোসের এবং বেদনার জায়গাটি হলো—তাদের প্রত্যক্ষ সময়কালেই বাংলাদেশ বেতার তাদের সাধারণ শ্রোতাদের থেকে দূরের তারা সম দূরত্বে অবস্থান নিয়েছে। বাংলাদেশ বেতারকে এখন আর প্রজাতন্ত্রের নাগরিকেরা তাদের উচ্চারণ ও ভাবনার মাধ্যম মনে করেন না। এই দুঃখবোধের জায়গা থেকে বাংলাদেশ বেতার অদূর সময়ে মুক্তি পাবে, সেই স্বপ্ন দেখারও ভরসা পাচ্ছেন না তারা।



বাংলাদেশ সময়: ০৯২১ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।