‘খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানার অন্তর্গত চুকনগর একটি ছোট্ট ব্যবসাকেন্দ্রিক শহর। ভারত সীমান্তের কাছাকাছি হওয়ায় সবসময়ই ব্যস্ততা লেগে থাকে এই সুন্দর শহরটিতে।
১৯৭১ সালে পাক-বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে ভারতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে চুকনগরে অবস্থান নেয় লাখো মানুষ। পাকিস্তানি বর্বর সেনারা তাদের ওপর নির্মমভাবে হামলা চালায়। অতর্কিত এ হামলায় আমার বাবাসহ মুক্তিকামী ১০ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। সেদিনের সেই হত্যাকাণ্ডে আমার বাবার সাথে পরিবারের আরও ৭ জন শহীদ হন। ’
বুধবার (২৫ মার্চ) বিকেলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ বটিয়াঘাটা উপজেলা কমান্ড কার্যালয়ের সামনে পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম সে গণহত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে এসব কথা বলেন শহীদ অভিনাশ গাইনের ছেলে নিতাই গাইন (৬৭)। যুদ্ধাকালীন তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহকারী।
নিতাই গাইন খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান।
সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী নিতাই গাইন বলেন, ওইদিন আমাকে ঘটনাস্থানের একটি মসজিদের বারান্দায় বাড়ির পাশের এক মহিলা পাটি দিয়ে ঢেকে রেখেছিল। আমি পাটির ফাঁক দিয়ে দেখেছি পাকিস্তানিরা কিভাবে একে একে গুলি করে মানুষ হত্যা করেছে। আর সে গুলিতে আমার বাবা (অভিনাশ গাইন), চাচা (বাদল গাইন), চাচাতো ভাই (রঞ্জিত গাইন), চাচাত ভাইয়ের ছেলে (বিনয় গাইন), চাচাত ভাই (ইশ্বর গাইন), ফুফুর স্বামী (অধর মন্ডল), ফুফাত ভাই (ধীরেন মন্ডল), মালতী গাইন (চাচী) নিহত হন।
স্মৃতী চারণ করতে গিয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে গিয়ে তিনি বলেন, ‘গণহত্যার পর আমি পাশের নদীতে লাশ আর রক্তের স্রোত দেখেছি। যে স্রোতে ভেসে রয়েছে নারী, বৃদ্ধ, শিশু। ’
মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনারা যে নির্মম অত্যাচার, নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে তার এক নীরব সাক্ষী নিতাই গাইন বলেন, ‘অনেক শিশু মায়ের বুকের দুধ খাচ্ছিল সেই অবস্থায় চলে ঘাতকের কামান। ঘাতকের বুলেট মায়ের বুকে বিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছে মা কিন্তু অবুঝ শিশু তখনও অবলীলায় মায়ের স্তন মুখের মধ্যে রেখে ক্ষুধা নিবারণের ব্যর্থ চেষ্টা করেছে। ’
তিনি বলেন, ‘পাকবাহিনীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে খুলনাসহ দক্ষিণাঞ্চলের একটি জনগোষ্ঠী জীবন বাঁচানোর তাগিদে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। যাদের মধ্যে ছিল আমার পরিবার ও আত্মীয় স্বজন। তারা বটিয়াঘাটার ডাউনিয়াফাঁদ গ্রাম থেকে গেছিল। ভারতে যাবার জন্যে সবাই ট্রানজিট হিসেবে বেছে নেয় ডুমুরিয়ার চুকনগরকে। ১৯ মে রাতে সবাই চুকনগরে এসে পৌঁছায়। সাতক্ষীরা এবং কলারোর বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করার জন্য চুকনগরে সমাবেত হয়। সেখানে কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। চুকনগরের পাতোখোলা বিল, কাঁচাবাজার চাঁদনী, ফুটবল মাঠ, কালী মন্দিরসহ বিভিন্ন শ্মশানে আশ্রয় নেয় তারা। সারা রাত নির্ঘুম রাত কাটে। পরদিন সকালে (২০ মে) বিশ্রাম সেরে ভাত রান্না শুরু করে, কেউ চিড়ে মুড়ি ও অন্যান্য শুকনো খাবার দিয়ে শরীরে চলার শক্তি সঞ্চার করে নিচ্ছিল। সকাল ১০টার দিকে তিনটি ট্রাকে করে পাকিস্তানি সেনারা চুকনগর বাজারের ঝাউতলায় (তৎকালীন পাতখোলা) এসে থামে। তাদের সঙ্গে ছিল হালকা মেশিনগান ও সেমি-অটোমেটিক রাইফেল। সাদা পোশাকে মুখঢাকা লোকজনও আসে। দুপুর ৩টা পর্যন্ত তারা নির্বিচারে মানুষ হত্যা করতে থাকে। হত্যাযজ্ঞ থেকে বাঁচার আশায় অনেকে নদীতে লাফিয়ে পড়েন। ’
উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই গাইন বলেন, ‘ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধকালীর সময়ে আমি প্রথমে খুলনা বেতার কেন্দ্র এলাকায় যুদ্ধ করি। একাত্তরের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে এদেশের ৩০ লক্ষ মানুষসহ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বিপুল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ দিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের বর্তমান সরকার অনেক সহযোগিতা করছে। ’
তিনি সরকারের কাছে দাবি জানান, ‘দয়া করে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের দ্রুত ফাঁসি কার্যকর করুন। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৬০২ ঘণ্টা, মার্চ ২৮, ২০১৫