এখন যে লড়াইটা লড়তে হচ্ছে সে লড়াইয়ে ভয় পাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা আবদুল করিম। বললেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে ভয় করিনি কিন্তু এখন অনেক ভয় লাগে।
এই আবদুল করিমদের নিজস্ব পারিবারিক জমিতে স্থান হয়েছে অর্ধশত শহীদ মুক্তিযোদ্ধার। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার কুল্লাপাথরে এই ঐতিহাসিক কবরস্থান।
আবদুল করিমের প্রয়াত বাবা আবদুল মান্নানের দান করা জমিতে মহান মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ধরেই রচিত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধি। তাতে স্থান পেয়েছে ২ জন বীরউত্তম, ২ জন বীরবিক্রম, ২ জন বীরপ্রতীকের সমাধি। আর ২৬ জনই চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনা।
সমাধিগুলো প্রথমে এলোমেলো করে দেওয়া হলেও পরে টিলার ওপর সারিবদ্ধ করে সেগুলো চিহ্নিত করা হয়। আর সমাধি দেওয়ার সেই টিলাসহ একটি বড় কম্পাউন্ড রয়েছে, সৌধের পাশে একটি রেস্ট হাউসও তৈরি হয়েছে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে।
কুল্লাপাথরের সমাধিস্থল ঘিরে একাই পাহারা বসিয়ে বসে থাকেন আবদুল করিম। পাশেই তার বাড়ি। কিন্তু দিন-রাত কাটে সমাধিস্থল আর রেস্ট হাউসে। তবে ভয়ে ভয়ে।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘এখানে এখন মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তির লোকেরাই বেশি শক্তিশালী। যারা কখনওই মুক্তিযোদ্ধা ছিল না, উপরন্তু যাদের রয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানি হানাদারদের সহযোগিতা করার ন্যাক্কারজনক আচরণ তাদেরই আত্মীয়-স্বজন এখন দাপটে দাবড়ে বেড়ায়। ’
আবদুল করিম জানালেন, এরই মধ্যে প্রভাবশালীরা সমাধির কম্পাউন্ডে দুটি দোকান বসিয়ে ব্যবসা জমিয়েছে। এই দোকান ঘিরে বখাটেদের আড্ডা চলে। আর সে কারণে অজ-পাড়াগাঁয়ের এই সমাধিস্থলে দর্শনার্থীরা আসতে চায় না।
দুই চারজন দর্শনার্থী এলে আবদুল করিম খুব খুশি হয়ে যান। নিজের অর্থ খরচ করে তাদের খাবারেরও ব্যবস্থা করেন কখনও কখনও। তার খুব ইচ্ছা, এই স্থানটি হয়ে উঠবে অনেকের কাছে আকর্ষণের। নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা এখানে বেড়াতে আসবে। মুক্তিযুদ্ধে সাহসী যোদ্ধাদের কথা জানবে। কিভাবে তারা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে সে কথা জানবে।
আবদুল করিম বলেন, শহীদ মঈনুল, শহীদ বেলায়েতদের বীরত্বগাথা তার জানা। তার জানা আছে হাবিলদার তৈয়ব আলী, ল্যান্স নায়েক আব্দুস সাত্তারের কথা। মাথায় বিস্ফোরক নিয়ে তার বিস্ফোরণে মৃত্যু ছিল যেকোন ঘটনার চেয়ে মর্মান্তিক। দর্শনার্থীরা এলে তিনি সেগুলো শোনাতে পারেন।
আবদুল করিম তখন ২৬ বছরের টগবগে যুবক। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক অ্যাডভোকেট সিরাজুল হকের শিষ্যত্ব নিয়ে তখন নিজেকে জড়ান দেশ-মাতৃকার জন্য সংগ্রামে। তার দায়িত্ব পড়ে আগরতলায় যারা প্রশিক্ষণ নিতে যায়—সেইসব মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য রাখা। এরই মধ্যে আসতে শুরু করে বিভিন্ন স্থানে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মরদেহ। এক পর্যায়ে তার অন্যতম দায়িত্ব হয় এইসব মরদেহ দাফনের।
সে ছিল এক বড় সংগ্রাম’—বলেন আবদুল করিম। গ্রামের আবু তাহের, আনু মিয়া, গেদু মিয়া, কাশীরামপুরের মর্তুজা আলী আর বায়েকের রশিদ এরা হয়ে গেলেন করিমের সার্বক্ষণিক সঙ্গী। তারা ঝুঁকি নিয়ে কবর খুঁড়তেন, আর্টিলারি শেল এসে আশেপাশে পড়ত তাতেও ভয় না পেয়ে দাফন সুসম্পন্ন করতেন।
আবদুল করিম জানান, একসঙ্গে বেশি করে কাফনের কাপড় এনে রেখেছিলেন। দাফনের আগে তার বাবা আবদুল মান্নান মুক্তিযোদ্ধাদের জানাজা পড়াতেন।
তিনি বলেন, ‘গ্রামের যারা তখন এসবের ধারে কাছেও ভিড়ত না, বরং এড়িয়ে থাকত, নাক সিটকাতো—তারাই এখন বড় মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে।
আবু তাহের ও মর্তুজা আলীকে দেখিয়ে বলেন, এরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছে কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হতে পারে নি। ’
আবদুল করিম বলেন, ‘এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে সবাই দূরে সরে যাচ্ছে। স্কুলগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা হয় না। নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা মুক্তিযুদ্ধের কথা জানতে পারে না—সেটা খুবই কষ্টের।
তিনি বলেন, ‘এসবের বিরুদ্ধে এখন একাই যুদ্ধ করে যাচ্ছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় সেনা কর্মকর্তারা ছিলেন, অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক ছিলেন, তারা অভয় দিতেন কিন্তু এখন অভয় দেওয়ার কেউ কাছে নেই।
সেই সময়ের যোদ্ধারা কেউ কেউ মাঝে মধ্যে এই কুল্লাপাথরে আসেন জানিয়ে বলেন, তারা এসে আবার চলে যান, কিন্তু এখানকার অপশক্তিগুলোর তৎপরতা থেমে থাকে না। ’
আবদুল করিমের ইচ্ছা, এই পুরো কম্পাউন্ড জুড়ে একটি পর্যটন কেন্দ্রের মত গড়ে উঠবে। আর মানুষ এখানে এসে দেখতে পাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধি। তার আরও ইচ্ছা, পুরো অঞ্চলে আরও এক হাজারেরও বেশি মুক্তিযোদ্ধার কবর রয়েছে—সেগুলো চিহ্নিত করে তুলে এনে এই কুল্লাপাথরে স্থান করে দেওয়া।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যারা মারা গেছে তাদের সমাধি একসঙ্গে করা সম্ভব হলে আমরা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধি কেন এক জায়গায় আনতে পারবে না?’—প্রশ্ন আবদুল করিমের।
বাংলাদেশ সময় ১৭১৭ ঘণ্টা, মার্চ ২৭, ২০১৫