ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

অযাপিত জীবন | অনীলা পারভীন

গল্প / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩৭ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০১৫
অযাপিত জীবন | অনীলা পারভীন

জবার জন্য আজ কি কোনও বিশেষ দিন? হতেও পারে। শেষ কবে তার জীবনে একটি বিশেষ দিন এসেছিল, এখন আর মনে করতে পারে না সে।

অসীম শূন্যতায় কেটে গেছে অনেকগুলি বছর। উল্লেখ করার মত তেমন কিছুই ঘটেনি। কিন্তু আজ হঠাৎ গত ৪৪ বছরের চাপাকষ্ট দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে আসে, মনের গহীন থেকে।

বাবাকে জবা মনে করতে পারে না। বাবা মারা যাবার পর মা তাদের দুই ভাইবোনকে ফেলে চলে গেলেন। বড় ভাইটা এক চাচার বাড়িতে আর জবা মামাবাড়িতে বড় হয়েছে। জবাকে লেখাপড়া করানোর মত অবস্থা মামাদের ছিল না। তারপরও জবা নিজ আগ্রহে লিখতে পড়তে শিখেছে। আর এতে সাহায্য করেছে চম্পা ভাবী। জবার ৭ বছর বয়সে চম্পা ভাবী বউ হয়ে আসেন পাশের বাসায়। কোনও এক অজানা কারণে ভাবী তাকে খুব স্নেহ করতেন। জবা যখন তখন তার কাছে গিয়ে আবদার করত,
- ভাবী, কুনসমে পড়াইবেন।
- আরে থাম, হাতের কাজটা শেষ করে নেই।
ঘরের কাজ শেষে বিকেলে সবাই যখন ঘুমে, ভাবী তখন পড়াতে বসতেন।
আসলাম প্রায়ই ভাবীদের বাড়িতে বেড়াতে আসত। আসলাম, ভাবীর দূর সম্পর্কের দেবর। সে এলেই জবার কাছে মনে হতো, চারপাশটা কেমন আলোকিত হয়ে উঠছে! মনের মাঝে কী এক অস্থিরতা! অজান্তেই বারবার তার দিকে চোখ চলে যেত। একটা সময় আসলামও বেশ ঘন ঘন আসা-যাওয়া শুরু করল। জবাও খেয়াল করল, আসলাম জবার ডাগর কালো চোখ দু’টি থেকে দৃষ্টি সরাতে পারে না। জবা তা বুঝতে পেরে খুব যত্ন করে চোখে কাজল দিত। আসলামের গানের গলা চমৎকার। জবাকে দেখলেই গুনগুন করে ‘অমন ডাগর ডাগর চোখে কেন কাজল দিলে...’ গানটি গেয়ে উঠত।

আসলামের গানের সুর জবার মনের শান্ত দিঘিতে তরঙ্গ ছড়িয়ে দিত। নিজেদের অজান্তেই কখন কবে জানি দু’জন দু’জনের হৃদয়ে বাঁধা পড়ে গেল। কিন্তু এ-ও কি সম্ভব? কোথায় আসলামদের সামাজিক অবস্থান আর কোথায় জবা! চম্পা ভাবী জানতে পেরে তাদেরকে আশ্বাস দিলেন,
- সবাইকে রাজী করানোর দায়িত্ব আমার। তবে আসলাম, তোমার বাবার ব্যবসাটা ঠিকমত বুঝে নাও। আর জবাও আরেকটু বড় হোক। মাত্র তো ১৩ তে পা...।

প্রজাপতির ডানায় ভেসে ভেসে দিন কাটছিল জবার। এমন মধুর সময় বুঝি আগে আসেনি, কোনওদিন। কিন্তু দেশের অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে লাগল। ১৯৭১-এর মার্চ মাস। যে আসলাম কোনওদিন একটা মিছিলে যায়নি, সে কি না গ্রামের অন্য ছেলেদের সাথে যুদ্ধে চলে গেল! যাবার আগে একটু সময়ের জন্য জবার সাথে দেখা করতে এলো। কি জানি কী বলতে এসেছিল, ভালো করে কিছুই বলতে পারল না। শুধু বলল,
- জবা, অপেক্ষা করো, স্বাধীন দেশে আমাদের সুখের সংসার হবে...

সেই থেকে শুরু হলো অপেক্ষার পালা। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। যে কোনও সময় নাকি হানাদার পাকিস্তানীবাহিনী আক্রমণ করতে পারে। গ্রামের অবস্থাপন্ন লোকেরা, যাদের যাওয়ার জায়গা ছিল, তারা দূরে চলে যেতে শুরু করল। চম্পা ভাবীরাও চলে গেলেন তার ভাইয়ের বাসায়। ভাবী যাবার আগে বললেন,
- পারলে তোকেও সাথে নিতাম রে জবা। কিন্তু বুঝিস তো আমরাই এতগুলি মানুষ। ভাইয়ের সরকারি কলোনির ছোট্ট বাসা...
বলতে বলতে ভাবীর গলা ধরে আসে। জবা তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
- আমি তো অতখানি আশাও করি না ভাবী। আপনারা ভালো থাইকেন।

এপ্রিলের ২ তারিখ, ভোর হতে চলেছে। জবা সারারাত ঘুমায়নি। আজকাল তার দু’চোখে একেবারেই ঘুম আসে না। ছোট মামা রাতে গ্রাম পাহারা দেন। সেদিনও পাহারা দিয়ে ফিরেছেন, কিন্তু চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ।
- গাঙ্গের ওই পারেই মিলিটারি ক্যাম্প বসাইছে। যে কোনও সময় কিছু একটা হইতে পারে, সাবধানে থাকতে হইব।

ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে গুলির শুব্দে মানুষজন দিকবিদিকশূন্য হয়ে ছোটাছুটি শুরু করল। মামারা যে যার মত বের হয়ে গেল। জবাকেও তাদের সাথে নিতে চাইল। কিন্তু সে বলল,
- কোনওখানে যামু না মামা। নানাভাই চলতে পারে না। তারে নিয়া আমি বাড়িতেই থাকুম। আপনারা যান, আমাদের নিয়া চিন্তা কইরেন না।

জবা যাবে না। কারণ তার বিশ্বাস, আসলাম তার কাছে আসবে। তখন তাকে না পেয়ে যদি ফিরে যায়? নানাভাইকে নিয়ে একা বাসায় থেকে যায় জবা।

সেদিন সন্ধ্যায়ই নানাভাইকে চোখের সামনে মেরে ফেলে হানাদার বাহিনী। আর জবাকে ধরে নিয়ে যায় ক্যাম্পে। জবার জীবনে নেমে আসে ভয়ঙ্কর অন্ধকার। তারপর ৮ টা মাস জবার জীবনে কী ঘটেছে তার বর্ণনা দেয়ার ক্ষমতা তার নেই। তার সাথে এমন অনেক অভাগী মেয়ে ছিল। তাদের মধ্যে রহমত চাচার মেয়ে লাভলীও একজন। গ্রামের সবচেয়ে মেধামী মেয়ে। সবাই জানে লাভলী কিছুদিন পর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাবে। একেকটি মেয়ের জন্য কি ভয়ঙ্কর ছিল সেই সময়। এরচেয়ে মরে যাওয়াই তো ভালো ছিল। জবা তার জীবনের আর কোনও মানে খুঁজে পায় না । আসলামকেও ভুলে যেতে চায় চিরদিনের মত। কী হবে মনে রেখে? সে কি আর ফিরে পাবে প্রজাপতির ডানায় ভেসে যাওয়া সেই জীবন?

দেশ স্বাধীন হবার পর মামাবাড়ীতে ফিরে আসে জবা। কিন্তু পাড়া-প্রতিবেশি, মামীদের কথায় টিকে থাকাই দায়,
- এই মেয়ে বাড়িতে থাকলে সমাজে মুখ দেখাইতে পারুম না।
কোথায় যাবে জবা? সে জানে না কোথায় হবে তার ঠিকানা। লোকমুখে খবর পায় যুদ্ধে তার ভাইটি শহীদ হয়েছে। শুনে কান্নাও পায় না জবার। মনে মনে বলে,
- মইরা বাঁচছে...। আমার মত কষ্টের জীবন তো আর কাটাইতে হইব না ।
চম্পা ভাবীরা শহর থেকে ফিরে এলেন। জবাকে জড়িয়ে ধরে তিনি কাদতে কাদতে বলেন,
- দেখিস, আসলাম ফিরে এলে তোর দুঃখের দিন ফুরাবে। আসলাম খুব ভালো ছেলে। ও তোকে ফেলে দেবে না।
ভাবীর কথায় জবা হাসে। হঠাৎ করে যেন ভাবীর চেয়ে জবার বয়স বেড়ে গেছে অনেক। ও এখন অনেক কিছুই বুঝতে পারে, যা আগে বুঝত না।
কিছুদিন পর আসলাম যুদ্ধ জয় করে ফিরে আসে। কিন্তু চম্পা ভাবীদের বাসায় আর আসে না। কয়েকদিন অপেক্ষা করে ভাবী নিজে থেকেই আসলামকে খবর দেয়। আসলাম এসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে,
- মা বলেছেন, তোমাকে বিয়ে করলে তার মরা মুখ দেখতে হবে। আমি তাকে কষ্ট দিতে পারব না, জবা। তবে কথা দিচ্ছি, এ জীবনে বিয়ে করব না। তুমি দেখে নিও।
আসলামের কথা শুনে জবা হাসে । সবার কথা শুনেই আজকাল জবা হাসে। শুধু হাসে। কারণ সে কাঁদতে ভুলে গেছে অনেক আগেই। মিলিটারি ক্যাম্প তার চোখের সব জল কেড়ে নিয়েছে।

সবাই মুখ ফিরিয়ে নিলেও চম্পা ভাবী তা করেন নি। তিনি যেন আরেক জন্মে জবার মা ছিলেন। ভাবী জবাকে একটা কাজ যোগাড় করে দেন। দিন যায়, রাত পোহায়। কোনও মতে বেঁচে থাকা যাকে বলে। স্তব্ধ হয়ে যায় জবা। প্রয়োজন ছাড়া কারও সাথে কথা বলে না। এমনকি আসলামের কথাও কোনও দিন কারও কাছে জানতে চায় না। চম্পা ভাবী বলতে চাইলেও সে বাধা দিয়ে বলেছে,
- থাক ভাবী, আমি ভুইলা যাইতে চাই আমার অতীতরে।

৪৪টি বছর কেটে গেছে বৈচিত্রহীনভাবে। জবা আর আগের মত কাজ করতে পারে না। ঘরে বসে আশপাশের বাসার মেয়েদের জন্য সেলাইয়ের কাজ করে। তাতে তার এক পেট চলে যায়, কোনও রকমে।

আজ পড়ন্ত বিকেলে বাচ্চা একটি মেয়ে বাইরে থেকে ডাকে,
- নানী, আপনার সাথে একটা লোক দেখা করতে আসছে। বাইরে আসেন।
জবা ভাবে, কে আবার এলো এই অসময়ে? চোখে চশমাটা দিতে দিতে বাইরে এসে দাঁড়ায়।
- কেমন আছো জবা?
আবছা আলোতে মুখটা ভালো করে দেখতে না পেলেও কণ্ঠস্বরে মানুষটাকে চিনতে কোনও অসুবিধা হয় না। জবা অবাক হতে ভুলে গেছে, বহুদিন আগে। কিন্তু আজ সে বিস্মিত না হয়ে পারে না। কেমন বুড়ো হয়ে গেছে মানুষটা! সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারে না। জবা বলে ওঠে,
- আসলাম ভাই, আপনি?
আসলাম কোনও উত্তর দেয় না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। জবা জিজ্ঞেস করে,
- কেমন আছেন?
আসলাম বলে,
- গত সপ্তায় মা মারা গেছেন।
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ করে থাকে। আসলাম একটা দীর্ঘশাস ছেড়ে বলে,
- এখন আর আমাদের বিয়েতে কোনও সমস্যা নাই জবা।
জবা মনে মনে ভাবে, লোকটার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে! কী বলছে এসব? আসলামই আবার বলে,
- জীবনের অবশিষ্ট সময়টুকু কি আমরা একসাথে কাটাতে পারি না?
জবা কী উত্তর দেবে বুঝতে পারে না। আসলামের মুখের দিকে তাকিয়ে তার অযাপিত জীবনের কথা ভাবতে ভাবতে, কখন জানি দৃষ্টি ঘোলা হয়ে আসে।



বাংলাদেশ সময়: ১২৩৭ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।