জামিল সাহেব ভয়ে ভয়ে চেকটা ব্যাংকের ক্যাশ কাউন্টারে জমা দিলেন। তার হাতের তালু চটচটে ঘামে ভিজে গেছে।
ব্যাংকের ক্যাশিয়ার সাহেব একবার মুখ তুলে জামিল সাহেবের ঘেমে ওঠা মুখের দিকে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকালেন। ভাবটা এমন যেন এখনই ধমক দিয়ে প্রশ্ন করবেন, ‘এত টাকা দিয়ে কী করবেন? বলেন, নইলে টাকা দিব না। ’ কিন্তু এসবের কিছুই তিনি বললেন না। চেকের পেছনে আরেকটা সিগনেচার নিয়ে টাকা গুনে জামিল সাহেবের দিকে বাড়িয়ে ধরলেন। কাঁপা, ভিজে ওঠা হাতে জামিল সাহেব টাকাটা নিলেন কিন্তু গুনে দেখার জন্য আর দাঁড়ালেন না। কারণ তিনি জানেন এখানে এক লক্ষ টাকা আছে!
মতিঝিল কমার্শিয়াল এরিয়ার একটা নামকরা ব্যাংক থেকে জামিল সাহেব বের হয়ে মাতাল পদক্ষেপে রাস্তার দিকে এগিয়ে গেলেন। মনে হচ্ছে তিনি যেন একটু ভারসাম্যহীন। তার প্যান্টের ডান পকেটে এক লক্ষ টাকা—একশটা হাজার টাকা নোটের বান্ডিল আর অন্য পকেটে চেকের সাথে পাওয়া সেই অদ্ভুত চিঠিটা। যেটা গতকাল বড় সাহেবের কামরা থেকে বেতনের ভাউচার সই করিয়ে বেতনটা পকেটে ভরার পর হাতে পেয়েছেন। তিনি আরেকবার টাকা থাকা পকেটে হাত দিয়ে অনুভব করে বোঝার চেষ্টা করলেন টাকাটা সত্যিই তার পকেটে আছে কিনা! অনুভব করলেন এবং বুঝলেন, ঘটনা সত্য! টাকার বান্ডিল তার পকেটে! কিন্তু পুরো ব্যাপারটা এতটাই অবিশ্বাস্য যে তিনি বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না।
‘আজকের চেকটা যেহেতু সত্য, তার মানে আগামী ৯ দিনের যে ঘটনার কথা বাম পকেটের চিঠিটায় বলা আছে, সেটাও সত্যই হবে!’ একা একা বিড়বিড় করে উঠলেন জামিল সাহেব। ভাবতে ভাবতে তিনি আরও ঘেমে উঠলেন। মাথা কাজ করছে না। সব কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তার চোখে দিশেহারা ভাব। এমন ভাব সাধারণত বধ্য পাগলদের চোখেই দেখা যায় কিন্তু জামিল সাহেব তো আর পাগল নন।
চিঠি পেয়ে প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন, কেউ হয়ত তার সাথে রসিকতা করছে। তাই তেমন গুরুত্ব দেননি। চিঠির সঙ্গে থাকা চেকটা তিনি অবহেলার সাথে তার অফিসের টেবিলটার হাতল ভাঙ্গা ড্রয়ারে ফেলে রেখেছিলেন কিন্তু আজ সকালে মনে হলো, ‘দেখি না চেষ্টা করে, যদি কেউ রসিকতা করে থাকে তবে তো ব্যাংক টাকা না দিলেই তা বোঝা যাবে। ’ এই ভেবেই তিনি চেকটা জমা দিয়েছিলেন এবং অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, টাকা পাওয়া গেছে। তার মানে চিঠিটা মিথ্যে নয়! তিনি হাসবেন না কাঁদবেন বুঝতে পারছেন না।
মতিঝিলের সেনাকল্যাণ ভবনের সামনের ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে পকেট থেকে হলদেটে সাদা রঙের চিঠিটা বের করলেন। জামিল সাহেব লক্ষ্য করলেন তার হাত মৃদু কাঁপছে। চেষ্টা করেও এই কাঁপা বন্ধ করতে পারছেন না। আসল কথা হলো তিনি ভয়াবহ ধরনের উত্তেজিত। চিঠিটা তিনি চোখের সামনে মেলে ধরলেন।
চিঠিতে লেখা—
‘জনাব জামিল সাহেব, প্রথমেই আপনি আমাদের অভিনন্দন গ্রহণ করুন। আমরা আপনাকে দুটি সুখবর দিচ্ছি। প্রথমটা হলো, আপনি মনোনীত হয়েছেন। সৌভাগ্যের! আজ থেকে প্রতিদিন বিকাল ঠিক তিনটায় আপনি আমাদের কাছ থেকে একটি করে চেক পাবেন। যার ধরন হবে ‘ক্যাশ’। প্রথমটা শুরু হলো ‘এক লক্ষ’ টাকা দিয়ে। যেটা এই মুহূর্তে আপনার হাতে।
দয়া করে আমাদের পাগল বা এটাকে কোনও ধরনের সস্তা রসিকতা হিসেবে নেবেন না। আমরা যা বলছি তা সর্বৈব সত্য। কারণ আমরা কখনও মিথ্যা বলি না। আপনি আমাদের ওপর এই ভরসাটুকু নির্দ্বিধায় রাখতে পারেন। যাই হোক, চেক পাওয়ার একটা অলঙ্ঘনীয় শর্ত হলো, এর বিনিময়ে আপনাকে শুধু একটি ছোট্ট কাজ করতে হবে। আর তা হলো, চেক পাওয়ার পরপরই আপনার কাছে যে পরিমাণ টাকাই থাকুক না কেন তার সবটুকু একজন সত্যিকারের দিনহীন মানুষ খুঁজে তাকে দান করতে হবে। যদি আপনি এই শর্ত পালন না করেন, তবে সেটাই হবে শেষ চেক। আপনার জন্য বরাদ্দকৃত পরবর্তী চেকগুলো বাজেয়াপ্ত হবে। অর্থাৎ আপনার কাছে আর কোনও চেক আসবে না এবং প্রাপ্ত চেকের টাকা আপনাকে ভয়াবহ বিপদে ফেলে দিবে। সেটা কিভাবে তা সময়ই আপনাকে বলে দেবে। সুতরাং সাবধান! আমরা আশা করছি আপনি এই সামান্য কাজটা অবশ্যই করতে পারবেন এবং করবেন।
এখন বলি কেন আপনাকে সৌভাগ্য কর্তৃক মনোনীত করা হয়েছে। আমরা গত বিশ বছর যাবত আপনাকে মনিটর করে আসছি। কারণ আপনি আমাদের প্রথম ধাপ ‘বিশ বছর’ আগে খুব সুন্দরভাবে পাশ করেছিলেন। প্রথম ধাপটা কী, জানতে ইচ্ছে করছে তাই না? আপাতত সেটা আপনার না জানলেও চলবে।
প্রথম ধাপটা যেহেতু পাশ করেছেন, তাই, দ্বিতীয় ধাপটা শুরু হলো। সেটি চলল একটানা বিশ বছর। আপনি দরিদ্র এবং প্রচণ্ড অভাবী একজন মানুষ কিন্তু অত্যন্ত নিষ্ঠাবান আর সত্যবাদী। এই বিশ বছরে আপনি একটিও মিথ্যে কথা বলেন নি। এটি একটি বিশেষ গুণ বলে আমরা মনে করি। এটি আমাদের হিসেবে ‘এ’ ক্যাটাগরির গুণ। এর মূল্য অনেক। তাই পুরস্কারও আমরা সেভাবেই দেই। এছাড়াও আরও গুণ আছে, তবে সেগুলো ভিন্ন ক্যাটাগরির। যেমন, ‘বি’, ‘সি’, ‘জেড’ ইত্যাদি। তবে ‘এ’-র সমতুল্য একটাও না। তবে অন্যগুলোও ক্যাটাগরি হিসেবে খুবই মূল্যবান। এসব কথা শুনে আপনার কি মনে হচ্ছে না যে আমরা ছেলেমানুষি টাইপ কথা বলছি? দয়া করে এমন ভাববেন না। তাহলে ভুল করবেন।
এবার দ্বিতীয় সুখবরটি বলছি। আপনি প্রতিদিন যে চেকটি পাবেন তা হবে আগের দিন যেটা পেয়েছেন তার দুইগুণ! এভাবে টানা দশ দিন। সব মিলিয়ে মোট দশটা চেক। ঠাণ্ডা মাথায় টাকার পরিমাণটা ভাবুন একবার। আশা করছি আমাদের এই সামান্য পুরস্কার আপনার কিছুটা হলেও উপকারে লাগবে। ভালো থাকুন, সুখে থাকুন সব সময়।
এইখানেই চিঠিটা শেষ। কোনও নাম বা ঠিকানা কিছুই লেখা নেই।
দুঃখ, কষ্ট, বেদনা আর চরম হতাশার এক মিশ্র ভাব জামিল সাহেবের মুখে একটা অসম্ভব ভঙ্গিমা ধারণ করিয়ে দিল। তার চোখে মুখে কেমন যেন অস্বাভাবিক ভাব! পাগল হয়ে যাচ্ছেন কিনা বুঝতে পারছেন না। তিনি রাস্তার ফুটপাতে বসে পড়লেন। ভাবছেন, আমার বোধহয় পাগল হয়ে যাওয়াই ঠিক হবে! নতুবা বাকি জীবন আর ঘুমুতে পারব কিনা সন্দেহ। কারণ, ভয়াবহ এক আক্ষেপ ভূতের মত তাড়া করে বেড়াবে আমাকে!
ভাবছেন না, কেন? তাহলে চলুন, এক দিন পেছনে যাই।
ছোট বেসরকারি একটা কোম্পানিতে জামিল সাহেব সাড়ে আট হাজার টাকা বেতনে চাকরি করছেন ক্যাশিয়ার হিসেবে। চাকরির বয়স বিশ বছর। শুরু করেছিলেন আট শ’ টাকায়। সেটাই বাড়তে বাড়তে আজ এইখানে এসে ঠেকেছে। তবু, এত কম টাকায় ঢাকা শহরে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভবের কাছাকছি। প্রতিনিয়ত হাজারটা ‘নাই নাই’ তাকে হিংস্র হায়নার মত খামচে ধরে খুবলে খুবলে খেয়ে যাচ্ছে কিন্তু এই চাকরিটা ছেড়ে যে আরেকটা বেশি বেতনের চাকরি নেবেন—সেই সাহসও তিনি ছাপ্পান্ন বছর বয়সে দেখাতে পারছেন না। চেষ্টা যে একেবারেই করেননি তা কিন্তু নয়। তবে, বেশি বয়সের অজুহাত বা অন্য লোক আছে বলে অথবা বিশ্বাস করা যায় কিনা ইত্যাদি ভেবে কেউ তাকে সে সুযোগ দেয়নি। তাই মুখ বুজে এই কোম্পানিতেই নামমাত্র বেতনে পড়ে আছেন। সবাই বলেন, জামিল সাহেব সৎ মানুষ, মিথ্যা বলেন না, নিষ্ঠাবান আর মানুষের দায়ে দফায় একেবারে জানপ্রাণ দিয়ে সাহায্য করেন। অবশ্য যতটুকু তার সামর্থ্য ততটুকু। এটুকুই বা কে করে? কিন্তু এসব অমূল্য গুণ তাকে আসন্ন অর্থনৈতিক লাঞ্ছনার হাত থেকে বাঁচানোর কোনও রাস্তা বাতলে দেয়নি। স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে তিনি একরকম ডুবেই যাচ্ছেন। তার পরিবারের সবাই বুঝে গেছে তার সংসারের নৌকায় একটা না, বরং বেশ কয়েকটা ফুটো হয়ে গেছে। তাই সবাইকে নিয়ে ডোবার মত অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছেন জামিল সাহেব।
এমনি সময়ের এক বিরক্ত বিকেলের তিনটায়, যখন বেতনের সেই মহার্ঘ্য সাড়ে আট হাজার টাকা পকেটে ভরে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলেন, তখনই চেক আর চিঠিটা হাতে পেলেন। অবাক হয়ে কিছুক্ষণ চেকের দিকে তাকিয়ে থেকে বিরক্তভাব নিয়ে চিঠিটা পড়লেন। পড়েই মেজাজটা অসম্ভব খারাপ হয়ে গেল। রসিকতা করার তো একটা মাত্রা থাকা উচিত। তাই না? কারও অভাব অনটন নিয়ে এমন সস্তা রসিকতা জামিল সাহেব সহ্য করতে পারছিলেন না। তাই রাগের ঠেলায় অদৃশ্য কারও ওপর তিনি ভীষণ চটে উঠলেন। কয়েকটা খারাপ গালিও দিলেন। ঘণ্টা খানেক মেজাজ খারাপ থাকার পর তিনি এ নিয়ে আর ভাবতে চাইলেন না কিছু। মনে মনে বললেন, ‘থাক্ ওসব ড্রয়ারে পড়ে। পরে খুঁজে বের করব কার হারামিপনা এটা!’
এরপর নানান ধান্দায় তিনি একরকম ভুলেই গেলেন সে দুই অদ্ভুত কাগজের কথা। অফিস শেষ করে বাসায় চলে গেলেন। বউয়ের হাতে বেতনের টাকাগুলো দিয়ে তিনি খেয়ে দেয়ে ঘুমের আয়োজন করতে লাগলেন। আর মনে মনে ভাবতে লাগলেন, কিভাবে এই মাসে তার মেয়ে জবার ভার্সিটির টাকাটার ব্যবস্থা করা যাবে। মেয়েটা এমন গুণী যে বলার নয়। পড়েছে একটা ফকির বাবার হাতে। আফসোস, বিরাট আফসোস! আরও হাজারটা অভাবের মারের কথা ভাবতে ভাবতে তিনি একসময় ক্লান্ত দেহে ঘুমিয়ে পড়লেন। সকালবেলা অফিসে গিয়ে ড্রয়ার খুলে যখন সেই চিঠি আর চেকটা আবার দেখলেন, তখন মনে মনে ভাবলেন, ‘দেখি না চেষ্টা করে, যদি কেউ রসিকতা করে থাকে তবে তো ব্যাংক টাকা না দিলেই বোঝা যাবে!’
সেনাকল্যাণ ভবনের পাশেই ফুটপাতে একটা ছোটখাট ভিড়ের জটলা। সবাই বলাবলি করছে, বয়স্ক একজন মানুষ নাকি কিছুক্ষণ আগে মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। পানি টানি দিয়ে তাকে সুস্থ করা হয়েছে কিন্তু তার কথা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। একবার হাসছেন আবার ছোট বাচ্চাদের মতন কেঁদে উঠছেন। বোধহয় মাথা খারাপ হয়ে গেছে বুড়ো মানুষটার! কী সব বলছে, চেক, চিঠি, ডবল ডবল টাকা, অনেক টাকা দিব, আমাকে গতকালটা ফিরত এনে দাও... ইত্যাদি ইত্যাদি নানান অসংলগ্ন কথা। পাগল তো, তাই কত কিছুই বলে, কান দিতে নাই। অত্যন্ত সৎ পরামর্শ। ভিড়ের সবাই একমত হলেন যে বুড়ো মানুষটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। তাই ধীরে ধীরে মজা দেখতে আসা লোকদের সংখ্যা এবং সেই সাথে ভিড়টা হালকা হতে লাগল।
সুতরাং জামিল সাহেবের ঘটনা বিবেচনায় এটুকু বলা যায়, যদি এমন কোনও চিঠি আপনিও কখনও পান, এই ধরেন যার রঙটা হালকা হলদেটে সাদা—মানে পেতেই তো পারেন, বলা তো যায় না, খবরদার, ভুলেও সেটাকে অবিশ্বাস করবেন না! কে জানে, হয়ত অদৃশ্য কোনও কিছু এই মুহূর্তে আপনাকেও মনিটর করছে! হয়ত আপনারও পরীক্ষা চলছে। আর সেই পরীক্ষায় অবিশ্বাস্যভাবেই যদি উত্তীর্ণই হয়ে যান—সহজভাবে সেটা মেনে নেওয়াই ভালো!
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ৫, ২০১৫
টিকে