যান্ত্রিক কোনও শব্দে অভ্যস্ত নয় এ গ্রামের লোকজন। যান্ত্রিক শব্দ তাদের কাছে গহীন জঙ্গলে বাঘের গর্জনের মতই ভীতিকর মনে হয়।
- ভাইজান কই যান, ভয় পাইলেন নাকি? মুই না রাইফেল দিয়া পাখি মারবার নাকছোম।
চিকন বুদ্ধির মইদাল অনেকটা বাইম মাছের মত। সার্বক্ষণিক কাদার মধ্যে থাকলেও যখন বেরিয়ে আসে তখন তার গায়ে কাদার কোনও চিহ্ন থাকে না ! নাটের গুরু হয়েও সে কারও ক্ষতি করেছে এমন কোনও বড় প্রমাণ গ্রামে নেই। মাস দুয়েক আগে রটে যায় মইদাল থানা সদরে গিয়ে রাজাকার বাহিনীতে নাম লিখিয়েছে। এ নিয়ে গ্রামের বয়স্ক লোকেরা আল্লার কাছে শুকরিয়া আদায় করে। তাদের ধারণা এ গ্রামে এখনও পাক বাহিনী আসে নাই মইদালের কারণে, আর গ্রামের উঠতি বয়সের ছেলেরা—যারা লাঠি নিয়ে চুপি চুপি স্কুল মাঠে যুদ্ধের ট্রেনিং নেয়, তারা ঘোষণা দিয়ে রেখেছে—মইদালকে যেখানে পাবে সেখানেই লাঠির আঘাতে তার মাথা দু ফাঁক করে দিবে। গ্রামের দু প্রজন্মের মাঝে এ নিয়ে কানাঘুষা আছে, এক প্রজন্ম আরেক প্রজন্মকে চুপিসারে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। গ্রামের এ অস্থির বিষয়টি মইদালের কান পর্যন্ত গিয়েছে। যে কারণে সে দুমাস পর গ্রামে এসেছে কাঁধে রাইফেল নিয়ে। তার কাছে রাইফেল আছে বিষয়টি জানান দেয়ার জন্য সে বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তার মোড়ে এসে আকাশে উড়ে যাওয়া পাখির দিকে তাক করে গুলি ছুঁড়ছে। মইদালের হাতে রাইফেল দেখে গ্রামের নেংটো ছেলে মেয়েরা তার পিছনে ধুলো উড়িয়ে দল বেঁধে ঘুরছে। মনে হয় সে যেন হ্যামিলনের সেই বাঁশিওয়ালা। দু একজন বয়োজেষ্ঠ্য লোকের সাথে দেখা হলে সে উর্দুতে বলছে—
- চাচা, কুচ পরোয়া নেহি।
মইদালের এ আন্তরিক সম্ভাষণে বয়স্ক লোক ভীতির চোখে তাকিয়ে তার মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করতে চায় কিন্তু রাইফেলের ভয়ে সে পথে পা না বাড়িয়ে বরং ‘ভালো থাকো বাবা ভালো থাকো’ বলতে বলতে রাস্তা থেকে জমির আইলে নেমে পাট ক্ষেতের ভিতর অদৃশ্য হয়ে যায়। মইদাল এ বিষয়টি বেশ উপভোগ করে। গ্রামের যে লোকেরা পান থেকে চুন খসলে তাকে শাসিয়ে কথা বলত, গরীব ঘরের সন্তান বলে তুই তুকারি করত, তারাই এখন বাবা ছাড়া কথা বলে না। এ দুদিনে মিয়া বাড়ি আর মোল্লা বাড়ি—তাকে দাওয়াত করে খাইয়েছে। মোল্লা বাড়ির ত্রয়োদশী মেয়ে—যার সঙ্গে কথা বলার স্বপ্ন দেখত, সেই মরিয়ম তাকে ভাত বেড়ে খাইয়েছে। রাতের বেলা ঘরে ফিরে মইদাল রাইফেলের গায়ে হাত ঘসতে ঘসতে আপন মনে বলে—
‘তুই যদি আমার সাথে থাকিস রে রাইফেল তবে তোকে এক পাশে আর মরিয়মকে একপাশে রেখে এ ঘরেই সুখের সংসার শুরু করব। ’
জুলাই মাসের মাঝামাঝি থেকে আমূল পাল্টে যায় গ্রামের পরিবেশ আর মানুষের জীবন। কী হবে না হবে তা নিয়ে ধনী গরীব, শিক্ষিত অশিক্ষিত সবার মাঝেই চাপা অস্থিরতা। সন্ধ্যা হলেই লোকজন কানে রেডিও লাগিয়ে খবর শোনার চেষ্টা করে। যাদের রেডিও নেই তারা যায় হাটে, গঞ্জে। রেডিও তখন হয়ে যায় জনসভার মাইক। পিনপতন নিস্তব্ধতায় খবর শুনে ঘরে ফিরে একরাশ অনিশ্চয়তা নিয়ে ঘুমুতে যায়। খাকি পোশাকের আর্মি জলপাই রঙের গাড়ি নিয়ে যে কোনও দিন ঢুকে পড়বে গ্রামে—এমন খবর আসছে চতুর্দিক থেকে। ঘরবাড়ি হারিয়ে উদ্ভ্রান্ত মানুষগুলো যখন বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে পিপীলিকার মত দল বেঁধে ছুটে চলে—তখন তারা এমন সব তথ্যই দিয়ে যাচ্ছে। মিলিয়ে যাওয়া গুলির শব্দ আরও স্পষ্ট হয়েছে যা উঠোনে বাশের গাইট ফাটানো শব্দের মতই মনে হয় আর ধোঁয়ার কুণ্ডলি তো পাশের ইউনিয়নের বুক চিরে অনিশ্চিত আকাশের দিকে উঠে যায়।
কুটি পাড়ার রহিম গাজী এর মাঝে শুরু করেছে আরেক কারবার। বর্ষার পানিতে টইটুম্বুর চারদিক। পোগাইল বিলের পানি পুবালি বাতাসে তোলা ঢেউ নিয়ে আছড়ে পড়ছে বাড়ির সামনের রাস্তায়। পানি এতটাই বেড়েছে যে ঢেউয়ের তালে রাস্তায় মাঝে মাঝে কচুরি পানা উঠে পড়ছে। ঢেউয়ের তালে তালে নৌকা বাইয়ে বিলের ওপারের ধোঁয়া ওঠা হিন্দু বাড়ির সমস্ত মালামাল জড়ো করছে এবাড়ির উঠোনে। কাসার প্লেট বাটি, হাড়ি পাতিল, ঘর গেরস্থালির প্রায় সব জিনিসপত্র থরে থরে উঠোনে সাজিয়ে রাখছে। রহিম গাজির ভেজা কাপড়ের পোটলার মাঝে সোনা দানা থাকা অস্বাভাবিক নয় কারণ এগুলো সে বিশেষ যত্ন সহকারে বাড়িতে রেখে আসছে। লুটপাটের এসব মালামালের কথা জিজ্ঞেস করলে এমনভাবে তাকায় যে বাড়ির সব মানুষের অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায়। যারা এর প্রতিবাদ করার সাহস রাখত—তারা বন্দুক নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন এলাকায়। শোনা যায় কেউ কেউ সীমানা পাড়ি দিয়ে চলে গেছে ওপারে।
গ্রামে শুরু হয়েছে ডাকাতের উপদ্রুপ। এর মাঝে তিনচারটি বাড়ি ডাকাতি করে কোনও প্রতিরোধ না পেয়ে তাদের সাহস গেছে বেড়ে। সবাই বলাবলি করছে এবার ডাকাতি হবে মোল্লা বাড়িতে। ডাকাতির ভীতি পৌঁছে গেছে মোল্লাবাড়ির অন্দর মহল পর্যন্ত। তিল তিল করে জমানো গহনা রক্ষায় অন্দর মহল তৎপর। এ ভীতি স্পর্শ করে আফসার মোল্লাকেও, তিনি শরণাপন্ন হন মইদালের। যদিও রাজাকার মইদালকে তার পছন্দ না। সুযোগ পেলেই এখন সে সদর মহল অন্দর মহলে ঘোরাঘুরি করে, যা আগে কল্পনাও করা যেত না। কিন্তু সময় খারাপ তাই সে নিজেই মইদালকে প্রস্তাব দেয় রাইফেলসহ স্থায়ীভাবে বৈঠকখানায় থাকার জন্য। মইদালও কথা না বাড়িয়ে লুফে নেয় সে প্রস্তাব। দিনকাল যা পড়েছে তাতে তার রাইফেলটি রক্ষা করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। তার বাড়িঘরের যে অবস্থা—সে ঘর থেকে যে কেউ চুরি করে নিতে পারে তার রাইফেল। আর তা যদি হয় সে হয়ে যাবে সম্পদ হারানো লোকের মত দেউলিয়া। আফসার মোল্লাসহ কেউ তখন আর তাকে পাত্তাই দিবে না। যে মরিয়ম এখন তার সাথে কথা বলার জন্য সুযোগ পেলেই কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করে সেও হয়ে যাবে আগের মত। বছর তিনেক আগে বইয়ের মধ্যে করে একটা চিরকুট দিয়েছিল মরিয়মকে। চিরকুট পেয়ে মরিয়ম তা তুলে দিয়েছিল তার বড় ভাইয়ের হাতে। ষণ্ডামার্কা বড় ভাই তাকে ডেকে নিয়ে পুল থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল খালে। গভীর খালের স্রোতের টানে পানি খেতে খেতে সে চলে গিয়েছিল অনেক দূর।
মইদালের কাজ এখন মোল্লা বাড়ি পাহারা দেয়া। দিনের বেলা বৈঠকখানায় শুয়ে বসে থাকা আর রাতের বেলা রাইফেল নিয়ে বাড়ির এপ্রান্ত থেকে ও প্রান্তে হেটে বেড়ানোই তার কাজ। মাঝে মাঝে হাকডাক করে, উঠোনের বারান্দায় কেউ আসলে তার সাথে গল্প করেই কেটে যায় তার রাত। বাড়ির মসজিদে হুজুর আজান দিতে উঠলে সে চলে যায় বিছানায়। এসবের কারণে আশেপাশের সকল অবস্থাপন্ন বাড়িতে ডাকাতি হলেও মোল্লা বাড়িতে তার সামান্য আঁচড়ও পড়ে নি। এ নিয়ে অন্দর মহলে মইদালের কদর বেড়ে গেছে। বাড়িতে মাছ রান্না হলে তার মুড়োটা এসে পড়ে মইদালের বৈঠকখানার ঘরে, মইদালের জন্য নতুন তোশক চাদর মশারি বানিয়ে আনা হয় হাট থেকে, না চাইতেই সকাল বিকেলে চা পানি এসে পড়ে তার ঘরে। আড়ালে থেকে এ সবের তদারকি যে মরিয়ম করে—তা সে বুঝতে পারে।
মাঝে মাঝে রাতের বেলা মোল্লা বাড়িতে আসে চেয়ারম্যানের ভাই ফরিদ। সে মুক্তিযুদ্ধে যায় নি, কেন যায় নি তার কোনও ব্যাখ্যাও তার কাছে নেই। তবে মাঝে মাঝেই বলে, সবাই যুদ্ধে গেলে ইউনিয়ন দেখে শুনে রাখবে কে। তবে নিজের ইউনিয়ন দেখে শুনে রাখার পাশাপাশি অন্য ইউনিয়নের অবস্থাপন্ন লোকজনের অশান্তির কারণ যে সে—তা এ ইউনিয়নের কেউ না বললেও পাশের ইউনিয়নের লোকজন অবলীলায় বলে ফেলে। মইদাল যখন বাড়ির উঠোনের এপ্রান্ত থেকে ও প্রান্তে হাঁটাহাঁটি করে তখন কোনও কোনও দিন ফরিদ এসে তার সাথে গল্প শুরু করে দেয়। মইদালের সাথে ফরিদের সামাজিক অবস্থানের বিস্তর ফারাক, সে থানা সদরে গিয়ে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের কাছে নামও লেখায় নি। তারপরও কেন সে আসে মইদাল তা বুঝতে পারে না। গত সপ্তাহে এসে সে বলে—
- আমার খুব শখ রাইফেল চালানো শিখি,
- শিখে কী করবা, মুক্তি বাহিনীতে নাম লেখাবা?
- না, একটা বিদ্যা জানা থাকল, আর রাতের বেলা রাইফেলটা চালানো শিখে ভোরে তোকে দিয়ে যাব। এতে তোরও লাভ হবে!
লাভের কথা শুনে তার চোখ চিকচিক করে ওঠে। তবুও ‘চেয়ারম্যানের নিষেধ আছে হাতিয়ার হাতছাড়া না করার’ বলে ফরিদকে সে নিবৃত করার চেষ্টা করে। অবশ্য শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান তাকে বারবার বলে দিয়েছে অস্ত্র হাতছাড়া না করতে। দিনকাল যা পড়েছে তাতে এ অস্ত্র দিয়ে যে কোনও কাজ করা সম্ভব। তারপরও চেয়ারম্যানের ভাই বলে কথা। শুধুমাত্র রাতের কিছুটা সময়ের জন্য সে যেভাবে চাইছে তাতে আর না করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া ফরিদের আশ্বাসে চকচকে কিছু টাকা তার চোখের সামনে ভাসতে থাকে, বিনা ঝুঁকিতে এমন সম্পদ সে পায়ে ঠেলতে চায় না। এভাবে গত দু সপ্তাহে তিনবার তার কাছ থেকে রাইফেল নিয়ে ভোরের আগেই তা ফেরৎ দিয়েছে ফরিদ। প্রতিবার রাইফেল ফেরত পাওয়ার পর মইদালের মনে হয়েছে রাইফেলটি আসলে সোনার ডিম পাড়া হাঁস।
এর মাঝে হাটে গ্রামে গঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের আনাগোনা বেড়ে যায়। এখন তারা প্রায় প্রকাশ্যে চলাফেরা করে। গত সপ্তাহে যখন মাসিক হাজিরা দিতে থানা সদরে গিয়েছিল, তখন সে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের মাঝেও সাবধানী ও শঙ্কার ভাব লক্ষ্য করেছিল। অস্ত্র সাবধানে রেখে নিজেকে বাঁচিয়ে চলারও পরামর্শ দিয়েছিল সে। পাক সেনারা থানা সদর থেকে তাদের ক্যাম্প গুটিয়ে নিয়ে চলে গেছে জেলা সদরে। থানা সদর থেকে আসার সময় সে লক্ষ্য করেছে, যে সকল বাড়ির চালে বা গাছের উপর আগে চাঁদ তারার পতাকা উড়ত সেসকল গাছে বা চালে এখন পতপত করে উড়ছে লাল সবুজ পতাকা। রাস্তার ধারে জটলা বেঁধে মানুষ যুদ্ধের খবরাখবর সংগ্রহ করছে, তাদের চোখেমুখে এখন উৎকণ্ঠার পরিবর্তে ঠাঁই পেয়েছে আনন্দ উল্লাস, তা যেন সকালের সোনা রোদে বর্ষার টইটুম্বুর বিলের পানির ওপর আলোর ঝলকানি। । এসব জটলা যখন সে অতিক্রম করে তখন তার ভিতর একটা ভীতি কাজ করে, যে কারণে মাঝেমাঝেই তার সাইকেলের হ্যান্ডেল বাঁকা হয়ে তা জটলার মধ্যে ঢুকে পড়তে চায়। অগত্যা সাইকেল থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে সে জটলা পার হয়।
যুদ্ধ প্রায় শেষ। পাক বাহিনীর অবিরাম ঠুসঠাস মিলিয়ে যাওয়া গুলির শব্দ আর শোনা যায় না। তার পরিবর্তে রাত্রির অন্ধকার ভেদ করে হঠাৎ হঠাৎ গর্জে ওঠে রাইফেল। সকালের আলো ফোটার সাথে সাথে সবাই ভিড় করে গর্জনের উৎসস্থলে। দেখা যায় তা হয়ত জমি সংক্রান্ত বা এলাকার প্রভাব বিস্তারে কোনও প্রতিপক্ষ পড়ে আছে রাইফেলের পিতলের বিচি বুকে নিয়ে। । এ প্রতিহিংসার আতঙ্কে আছে মইদাল। পাক বাহিনী বা রাজাকার বাহিনীর পরাজয় বা মুক্তিবাহিনীর বিজয় নিয়ে তার কোনও মাথা ব্যথা নেই, তার ভীতি নিজের নিরাপত্তা নিয়ে। এলাকার ছেলেরা যারা যুদ্ধ থেকে সবে ফিরতে শুরু করেছে তারা শাসিয়ে গেছে আফসার মোল্লাকে, মইদালকে যেন বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়। আফসার মোল্লাও কাল বিলম্ব না করে বের করে দিয়েছে তাকে। মইদাল এখন তার ভাঙ্গা বেড়ার খড়ের ঘরে রাইফেলটাকে আকড়ে ধরে থাকে।
আফসার মোল্লা তার মেয়ের বিয়ে দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। মইদাল গত পাঁচ ছয় মাসে যে উপকার করেছে তার প্রতিদান তো সে চাইতে পারে—প্রতিদানের হাত যেন তার মেয়ে পর্যন্ত না আসে সেজন্যই এ তড়িঘড়ি উদ্যোগ। অবশ্য মইদালকে নিয়ে সে চিন্তিত নয়, মইদালের নিজেরই এখন ত্রাহী অবস্থা, যে কোনও দিন রাত্রির অন্ধকার ভেদ করা রাইফেলের গর্জনে সে নাই হয়ে যেতে পারে। আর হাত যদি সে তার মেয়ে পর্যন্ত বাড়ায় তাহলে আফসার মোল্লা নিজেই এমন উদ্যোগ নেবে। এখন তো আর এমন অবস্থা নেই যে এর জন্য থানা পুলিশ সামলাতে হবে।
মরিয়মের বিয়ে ঠিক হয়ে যায়, পাত্র কুটি পাড়ার রহিম গাজীর ছেলে। রহিম গাজী এখন কুটিপাড়ার অবস্থাপন্ন গেরস্থ। বিলের ওপারের হিন্দু পাড়ার সমস্ত ধন সম্পদ যে এখন তার হাতে এটা সকলেই জানে। তাই আফসার মোল্লার প্রস্তাব যখন রহিম গাজী গ্রহণ করে—তখন সে আল্লার কাছে শুকরিয়া আদায় করে বিয়ের আয়োজনে তড়িঘড়ি শুরু করে দেয়।
বিয়ে হবে শুক্রবার বাদ জুম্মা। তার আগে থেকেই শুরু হয় অনুষ্ঠানাদি। রাস্তার মোড়ে বের হয়ে মইদাল শীতল চোখে দেখে বিয়ের সকল আয়োজন। জুম্মার নামাজের পর আফসার মোল্লা তার মেয়ের বিয়ের কথা এই প্রথম জনসমক্ষে ঘোষণা করে তাতে সামিল হওয়ার জন্য সকলকে আমন্ত্রণ জানায়। সবার সাথে মইদালও পায় সে আমন্ত্রণ। নামাজ শেষে বাড়িতে এসে রাইফেল কাঁধে নিয়ে দাঁড়ায় রাস্তার মাথায়। রাইফেল দেখে রাস্তার নেংটো ছেলেরা তার পিছু নেয়। খোলা আকাশের দিকে লক্ষ্য করে পাঁচ সাতটি গুলি ছোঁড়ে সে। আকাশ বিদীর্ণ করা সে শব্দে বাড়ির ঝোপঝাঁড় থেকে ঝাকে ঝাকে পাখি উড়ে যায় আর মোল্লা বাড়ির বিয়েতে আসা লোকজন ভয়ে দিকবিদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। মইদাল মাথা নিচু করে ঢুকে পড়ে ভাঙ্গা বেড়ার ঘরে।
পরেরদিন সকালে স্কুলমাঠে গ্রামের শান্তি ভঙ্গের অপরাধে মইদালের বিচার শুরু হয়। রাতেই এ বিচারের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে আফসার মোল্লা। অনেক অভিযোগের সাথে যখন বলা হয় মইদালের কাছে থাকা রাইফেল দিয়ে ডাকাতিসহ সে অনেক অপকর্ম করছে; তখন সে তার মৃদু প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে কিন্তু বিচারে আসা লোকজনের শোরগোলে সে প্রতিবাদ বিচারের সভাপতি এলাকার চেয়ারম্যানের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। সভা শেষে চেয়ারম্যান একক সিদ্ধান্তে বলে দেন, যেহেতু রাইফেল বিপদজনক অস্ত্র তাই এটি অল্পশিক্ষিত কারও হাতে থাকা ঠিক না। পরবর্তী সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত এটি থাকবে ফরিদের হেফাজতে। এলাকার দু একজন যুদ্ধ ফেরত ছোকরা ফরিদের ব্যাপারে আপত্তি তুললেও তা ধোপে টিকল না।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ৭, ২০১৫
টিকে/