শেষ রাতে মুষলধারে বৃষ্টি। শ্রাবণের বৃষ্টি।
ডেইরি গেটের এ ওভারব্রিজটি কবে নির্মিত হয়েছে বলতে পারি না। সম্ভবত ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক কায়সার স্যারের মৃত্যুর পর। এখানে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। ব্রিজটির রঙ ঝলসে গেছে। রয়েছে নোংরা আবর্জনাও। আজকাল সবাই তো ওভারব্রিজ ব্যবহার ছেড়েই দিছে। ছাত্রদের তো কখনওই ব্যবহার করতে দেখিনি। ইদানীং ছাত্রীরাও রাস্তায় দৌড় দিয়ে ওয়াল টপকে পার হয়। জীবনের ঝুঁকিটা থেকেই যায়। তবে কারও মরার খবর অবশ্য কানে আসেনি। গেট সংলগ্ন বাজার। আগের থেকে দোকানের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে অধিকাংশই নিম্নমানের। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অবহেলা আর অমনোযোগের কারণে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও উন্নতমানের বাজার গড়ে ওঠেনি।
এরপরও প্রতিবছর বাড়ানো হচ্ছে দোকানের ভাড়া। দোকানগুলোতে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নিম্নমানের খাবার সরবরাহ। আধুনিক মার্কেট নির্মাণের পরিকল্পনাটা কবে আলোর মুখ দেখবে ঈশ্বরই ভালো জানেন।
চাওয়াচাওয়ি করতে করতে দেখলাম ঢাউস আকৃতির হালকা নীল রঙের বাসটি ভেঁপু বাজাতে বাজাতে এগিয়ে আসছে। আমায় দেখেই হয়ত থামল। যাত্রী ছাড়া সাত সকালে বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সৌন্দর্য দেখার মত মানুষের সংখ্যা মনে হয় এখনও বাড়েনি। সুপারভাইজার মাথা নিচু করে বিনীতভাবে শ্রদ্ধা জানাল। সমস্যা হয়েছে কিনা জানতে চেয়ে দুঃখ প্রকাশ করল। করপোরেট সেবা যাকে বলে। ভালোই লাগল। এতক্ষণে মনের ভেতর জমে থাকা রাগগুলো কেমন জানি নরম হয়ে গেল। রাগখানি উত্তপ্ত পানির বাষ্পের মত উধাও হয়ে গেল যখন দেখলাম, কোর্ট টাই পরা সুপারভাইজার বিনয়ে গদগদ হয়ে বলছে, স্যার, এইটা আপনার সিট।
দেখি একটি সুশ্রী মেয়ে পাশের সিটে। মনে মনে খুশিই হলাম। যাক বাবা, অন্তত ছয়টা ঘণ্টা একটু ভালো কাটবে। ঠিকমত বসেছি দেখে সুপারভাইজার চলে গেল। বাসের ভেতর পারফিউমের গন্ধ ম ম করছে। যাত্রীদের কোলাহল নেই। কারও কোনও বাড়তি আগ্রহ নেই কোনও ব্যাপারে। যে যার মত ঘুমাচ্ছে, বই পড়ছে। কেউ বা পত্রিকার পাতায় খুঁজে ফিরছে সারা বিশ্ব। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিলাম। বাসের ভেতর গান বাজছে—
আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে,
আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে,
এই পুরাতন হৃদয় আমার আজি পুলকে দুলিয়া উঠিছে আবার বাজি
নূতন মেঘের ঘনিমার পানে চেয়ে...
অতিবাহিত কিছুক্ষণ। চুপচাপ। ব্যাগ থেকে আজকের পত্রিকাটা বের করলাম। দেখলাম ফিচার পাতায় চমৎকার ফিচার ছাপা হয়েছে। ভ্রমণ বিষয়ক। বরাবরই আমার পছন্দের। কিন্তু কেন জানি পড়তে ইচ্ছে করল না। পাশের যাত্রীর দিকে আড়চোখে তাকালাম। হাতে একটা বই। মাথাটা কাত করে বইয়ের দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ। শ্যাম্পু করা চুলের একটা অংশ চেহারা ঢেকে রেখেছে অনেকখানি। পুরো মুখটা দেখা গেল না। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে আবার ইতস্ততভাবে তাকালাম তার দিকে। চমকেই উঠলাম মনে হয়। মনে হলো এ যেন কোনও হুর অথবা পরী। বাসে থাকার কথা নয়। সরাসরি আকাশ থেকেই নেমে এসেছে। একটা আকাশি রঙের ওড়নায় মাথা পেঁচিয়ে দুই কাঁধ, বুক পিঠ ঢাকা। কোলের পাশে একটা ছোট্ট ব্যাগ। মেয়েদের সঙ্গে সবসময় অবশ্য ব্যাগ থাকেই। মেয়েটিকে দেখছিলাম একপাশ থেকে। কোনও নড়াচড়া নেই। বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর পর বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছে। হয়ত পড়ার ভেতরে ডুবে আছে।
নিজের কাছেই কেমন মনে হতে লাগল। মেয়েদের দিকে আমি তাকাই কম। বিশ্ববিদ্যালয়ে কত সময় কত সুন্দরী মেয়েদেরই দেখলাম। কিন্তু আজকের অনুভূতিটুকু ভিন্ন রকম। যেকোন মেয়ের চেয়ে এই মেয়েটি আমাকে ভারি আকর্ষণ করতে লাগল। আমার চোখ যেন আর ফিরছেই না। অজান্তেই শরীরটাও অবশ হয়ে যেতে লাগল। চোখ দুটো বড় বেহায়া হয়ে গেল। কপালের নিচ থেকে বেরিয়ে যেন তার সামনে ঝুলে থাকতে পারলেই তার শান্তি। একটু কষ্ট করেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলাম। পত্রিকার পাতায় মুদ্রিত লাইনগুলোর দিকে চোখ বোলালাম আবার। কী পড়ছি জানি না। মন, মগজে সক্রিয় উদ্যোগ। মেয়েটি কী করে। এই বুঝি নড়ে চড়ে বসল। চোখ মেলে তাকাল। এইসব সাত পাঁচ ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে রইলাম। মেয়েটি এক নাগাড়ে বইয়ের ভেতরেই আবদ্ধ। সে কী পড়ছে জানতে আগ্রহ জাগল। গল্প কিংবা উপন্যাস হলে তার প্রতিক্রয়া চেহারায় প্রতিফলিত হওয়ার কথা। আনন্দ, বেদনা, হাসি, ঠাট্টা, লজ্জা, ঘৃণা যাই হোক না কেন—সেটার ছায়া মুখে পড়ার কথা। কে জানে হয়ত ভাব ধরে আছে। এমনটা কল্পনা করতে মন সায় দিল না। সে হয়ত পড়ার ভেতরে ডুবে আছে। তার সাবলম্বী, শান্ত ও নিরুদ্বেগ আচরণে আরও মুগ্ধ হচ্ছি আমি। তবে একটু রাগও হচ্ছিল। মেয়ে মানুষ এত পাথরের মত শক্ত হয় নাকি? হৃদয়হীন! কোথায় একটু চঞ্চল হবে, তা নয়ত কী! এতক্ষণে একটিবারও সে আমার দিকে মুখ তুলে তাকায়নি। যেন সে কোনও পোট্রেটের মডেল। নির্দিষ্ট কাঠামোর বাইরে তার আচরণে ভিন্নতা নেই। সে যেন একটি নান্দনিক মূর্তি। মূর্তির মতই সুন্দর, শান্ত ও স্নিগ্ধ। যতই ভাবছি, ততই দুর্বল হয়ে পড়ছি। আকর্ষণ বাড়ছে। মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ছি। তার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল। যেকোন মানুষই হয়ত দেখামাত্র তার সঙ্গে ভাব জমাতে চাইবে। কী করা যায় ভাবতে লাগলাম। রবীন্দ্র সঙ্গীতের তালে তালে আমাদের বাসটিও লক্ষ্যপানে এগিয়ে চলেছে। কতদূর চলে এসেছি বুঝতে পারছি না। অবশ্য জানতেও ইচ্ছে করছে না। পাশাপাশি বসে থাকতেই ভালো লাগছে। তবে পরিচয়টা হলে, কথা বলতে পারলে যাত্রাটা আরও উপভোগ্য হয়ে যেত। তবুও একবার ঘড়ির দিকে চোখ বোলালাম। প্রায় দু’ঘণ্টা পার হতে চলেছে। বুঝতে পারছি সময়টা খুবই কম। অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা গন্তব্যে পৌঁছে যাব। মনটা উচাটন ও মরিয়া হয়ে পড়ল। মনে জিদ চাপল। কথা বলার জন্য অস্থির হয়ে গেলাম। কোনও সংকোচ ও জড়তা ছাড়াই কথা বলার জন্য প্রতিজ্ঞ হয়ে গেলাম। সিটে হেলান দেওয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে বসলাম। গলাটা কেশে নিলাম। নিজের পরিবর্তন দেখে আরও অবাক হয়ে গেলাম। আশ্চর্য লাগল নিজেকে দেখে, কত কম নিয়ন্ত্রণ নিজের ওপর! কত কম জানি নিজের সম্পর্কে। আপাতত আর ভাবতে ভালো লাগল না। কথা বলার জন্য মনটা মরিয়া হয়ে উঠল। বুকটা আবেগে উথলে উঠল। যা আছে কপালে, সরাসরি কথা বলব। দরকার হলে দ্বিধা ফেলে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে প্রসঙ্গ বের করব। মনে হলো, আগে পরিচিত হয়ে নেই। পরে ভাবলেই হবে।
এক্সকিউজ মি, শুনছেন!’—তাকিয়ে হতাশ হয়ে গেলাম। এ যে দেখি ঘুমিয়ে পড়েছে। কথা বলা কি আর হবে না। বাস থেকে কোথায় বা নেমে যায়, ভাবতেই অস্থিরতা আরও বেড়ে গেল। কিন্তু এ যে সৌন্দর্যের আরও ভিন্ন মাত্রা। দেখেই পাগল হয়ে যাওয়ার অবস্থা। চুলগুলো মুখের ওপর থেকে সরে গেছে। পুরো অবয়বখানি এখন স্পষ্ট। বাসের গান যে কখন বন্ধ হয়ে গেছে খেয়ালই করিনি। তবে বাইরে সম্ভবত বৃষ্টিটা ভালো হয়ে গেছে। রোদ্রজ্জ্বল আবহাওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। মাঝে মাঝে বাসের ভেঁপু বাজার শব্দ। ভাবনায় ছেদ পড়তে চায়। কিছুক্ষণ পর দৃষ্টিটা আবারও ঘুমন্ত মানুষটির ওপর চলে আসে। এত স্নিগ্ধ, মায়াভরা, মিষ্টি মুখ আগে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। ফর্সা, পরিষ্কার রঙে স্বর্ণালী ছটা। হালকা পেইন্ট করা মুখের ত্বক, সতেজ, মসৃণ, টানটান। রূপ যেন তার সারা অবয়বে লুটোপুটি খাচ্ছে। হালকা লম্বাটে মুখখানিতে চোখ দুটো পুতুলের মত। চিকন ভুরু। ছোট্ট নাকটা মুখের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে। চেহারায় একটু মিষ্টি আদুরে ভাব। অপলক দৃষ্টিতেই তাকে দেখতে লাগলাম। এ দেখা যেন শেষ হবার নয়। যতই দেখি, ততই অবাক হই। আবিষ্ট হয়ে যাই। অবশ হয়ে যায় ভাবনাগুলি। নিয়ন্ত্রণটা ক্রমশই হারিয়ে ফেলি। এসির ঠাণ্ডা বাতাস তাকে যেন আরও বেশি স্তিতধী করে তুলেছে। চেহারায় প্রশান্তির ছাপ। কোনও রূপ হতাশা কিংবা ব্যর্থতা তার মাঝে নেই। ঘুমের মাঝেই ডান হাত দ্বারা মাংসল নাকটা বেশ কয়েকবার ঘসে নিল। ঘসা খেয়ে নাকটি একটু লালই হয়ে গেল। নিশ্বাসের সঙ্গে নাকটা একটু কুঁচকে উঠছে। মানুষ ঘুমালে তাকে শিশুর মত দেখায়। চেহারায় স্বর্গীয় একটা ভাব দেখা যায়। মেয়েটির মুখ স্বর্গীয় সৌন্দর্যের আবেশে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে।
মনের ভাবনা নিজের অনেক ভেতরে চলে যেতে চাইছে। মনে হচ্ছে, কত দিনের চেনা সে। আগে হয়ত যুগধরে ছিলাম একই সঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মনে একধরনের অহংবোধ ছিল। মেয়েদের পাত্তা দিতাম কম। তারা আমাকে খুব অহঙ্কারী মনে করত। কারও সঙ্গে কখনওই এজন্য গভীর সখ্য গড়ে ওঠেনি। তবে আজকে সব অহঙ্কার কোথায় যেন হারিয়ে গেল। অবাকই হলাম বেশ। কী ভাবছি, কী করছি জানি না। নিজের অসংলগ্ন কিংবা অস্বাভাবিক আচরণ টের পাওয়ার মত অবস্থা তখন অনুপস্থিত। কেমন এক ধরনের আচ্ছন্নতায় পেয়ে বসে আমাকে।
হঠাৎ করে বাসটি ক্র্যাক করে ব্রেক চাপল। মেয়েটির ঘুম ভেঙে গেল। যেন হাজার বছরের ঘুম। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিল সে। তাকাল আমার দিকে। বুকের ভেতরের কয়েক ঝলক বিদ্যুৎ তরঙ্গ যেন ঝলক দিয়ে প্রবাহিত হলো পুরো শরীরে। মুহূর্তের দৃষ্টিক্ষেপ। এরপর নিজেকে গুছিয়ে নিতে শুরু করল সে। সুপারভাইজার জানাল, বাস এখন সিরাজগঞ্জ নাইটিঙ্গেল রেস্তোরাঁয়। বিশ মিনিটের বিরতি। গোছানোর সময় মেয়েটির হাতে বইটির দিকে তাকালাম। পাবলো নেরুদার অনুস্মৃতি। সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইলাম না।
বেশ পড়াশোনা করেন মনে হচ্ছে?’—তাকাল আরেকবার। হাসল শুধু। ভেতরটা আরেকবার চুরমার হয়ে গেল। ‘আমি অয়ন। জাহাঙ্গীরনগর থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করেছি। বিসিএসে ফরেন ক্যাটাগরিতে হলো সম্প্রতি। ’ মেয়েটি হাসল শুধু। ‘আমি নীলা। ’ বলেই চুপ। ‘চলেন নামি। ফ্রেশ হতে হবে। ’ সম্বিত ফিরে পেলাম। ও, হ্যাঁ, তাই তো। বাসের ভেতরে তাকিয়ে দেখি ফাঁকা। তবে মেয়েটির আন্তরিকতা ও সরলতা দেখে মুগ্ধ। রেস্টুরেন্টে বসে একসঙ্গে নাস্তা। অল্প সময়েই আলাপ জমে উঠল। বেশ মিশুক মেয়ে। তবে কেন যে এতক্ষণ কথা বলিনি, নিজের ওপরই রাগ হলো। তার সহজ সরল কথাবার্তা। কোনও অহমিকা ছাড়াই। বেশ সুন্দর ও সাবলীলভাবে গুছিয়ে কথা বলে। অবাক আর সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে গেলাম। বাস ছাড়ার সময় হয়ে গেল। বাসের জন্য পা বাড়ালাম। ভেতরে ভেতরে বেশ পুলক, উত্তাপ ও উৎসাহ অনুভব করলাম।
বাস ছাড়ল। আর ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই রাজশাহীতে পৌঁছে যাব। আমার বন্ধুদের বেশ কয়েকজন রাজশাহীতে পড়াশোনা করে। বিসিএসের প্রস্তুতির কারণে তাদের সঙ্গে যোগাযোগটা কমে গেছে। ফরেইন ক্যাটাগরিতে চাকরি। ব্যস্ত থাকতে হবে প্রতিনিয়ত। হাতে কিছু অবসর আছে। তাই একটু ঘুরতে যাচ্ছি। ক্রমাগত বলেই গেলাম।
- বিসিএস, বাহ, জীবনেও এত পরিশ্রম করতে পারি না। আপনি তো জ্ঞানের রাজ্য। এত পড়াশোনা করেন আপনি। দেখে কিন্তু আপনাকে সিম্পলই মনে হয়। ভালো লাগছে এত বড় অথচ সিম্পল মানুষের সঙ্গে কথা বলে।
ভেতরে ভেতরে আরেকবার উচ্ছ্বসিত হলাম। আরে না, কী যে বলেন! মধুর আলাপচারিতা। গল্পে গল্পে গোটা বিশ্ব। মনে যখন যা আসছে, তখন তাই আলোচনার বিষয়। খুব গভীরভাবে আমরা আলাপ করছি। অথচ সহজ সরল বাক্যে। মনে হচ্ছে কতদিনের চেনা। নীলা যখন বলছে তখন অবাকই হচ্ছি। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি তার দিকে। মনে হচ্ছে চিৎকার করে আনন্দ প্রকাশ করি। আনন্দে। গর্বে।
ভাবছি, পড়া শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তো চাকরির ব্যবস্থা হয়ে গেল। তবে এবার ঘরণীর ব্যাপারটিও চিন্তা করা যায়। নীলাকে দেখে ভাবনা আরও দুর্বিনীত হয়ে উঠল। তবে মুখে প্রকাশ করতে পারলাম না। কে যেন বাইরে থেকে আমার স্নায়ুতন্ত্রকে থামিয়ে দিল। অনেক কিছু বলতে গিয়েও কিছুই বলতে পারলাম না।
আশ্চর্যরকমের মেয়ে। কথা না বললে কী সুবোধ মনে হয়। অথচ একবার শুরু করেছে, আর থামার নাম নেই। তার বর্ষা ভালো লাগে। কদম ফুল তার প্রিয়। জীবনানন্দের প্রেমের কবিতা তাকে ছুঁয়ে যায়। নীল আকাশ তার মন কাড়ে। কোনও কিছুতে তার বিরক্তি নেই। ডান হাতটা দিয়ে প্রায়ই মাংসল নাকের ডগা ঘসে নিচ্ছে বারবার। ভাবছি স্বপ্নের কথা। আম্মু প্রায়ই বলে, একটা বউমার কথা। ছোট বোনটার গোঁ, একটা ভাবী চাই। আব্বুরও মৌনসম্মতি। বিশেষত যখন বিসিএসের রেজাল্টটা হয়ে গেল। মার কথা। এবার আর তো বাধা রইল না বাবা। শুভ কাজটা শিগগিরই করে ফেল। দুইটা নাতনির খুব শখ। এখন আর লজ্জা নেই। আজকেই আম্মুকে বলব। নীলা। স্বপ্নে হয়ত তোমাকেই দেখেছিলাম। কাশফুলের বনে তোমার সঙ্গেই তো খেলেছিলাম লুকোচুরি। রঙধনুর সাত রঙে তোমাকেই সাজিয়েছিলাম। তুমি কি মনে করতে পার? নিরুদ্দেশভাবে স্বগতোক্তির মত আওড়াচ্ছিলাম। চোখ বড় বড় করে তাকাল সে। সম্বিত ফিরে পেলাম। বাসে তেমন কোনও শব্দ নেই। ভলবো বাসের কল্যাণে নাগরদোলার মত সুখানুভূতি। বাসের ভেতরে শীতল বাতাস গড়াগড়ি খাচ্ছে। নীলার চোখে স্নিগ্ধ পরশ।
নীলার কথা শেষ হতে চায় না। মনে মনে হাসলাম। যা আছে এখনই বলে নাও। বিয়ের পরে আমার কথা শুনবে। মনের ভেলায় দেখলাম, নীলা লাল বেনারসি পরে বসে আছে। টুকটুকে লাল বউ। অদৃশ্য অপসৃয়মাণ। বেশ মজার। মানুষ তো স্বপ্নের ওপরই বাঁচে। কল্পনার ভিতের ওপর দাঁড়ায় তার বাস্তবতা। বন্ধুরা অনেকেই ঈর্ষা করবে। নীলাই তখন হেসে যুক্তি দিয়ে তাদের পরাজিত করবে। বুদ্ধিমতি মেয়ে। উপস্থিত বুদ্ধি, কথা বলার দৃঢ়তা, উপস্থাপনা মুগ্ধকর। যেকোন মানুষকেই অভিভূত করবে। আচ্ছা, যোগাযোগের ঠিকানা, ফোন নম্বর নিতে হবে। তার দিকে তাকাতেই মিষ্টি হাসিতে ভরে ওঠে তার মুখ। অমলিন হাসি। ইচ্ছে হয়, সারাজীবন বসে বসে নীলার হাসি দেখি। সুপারভাইজার কখন যে বলে ফেলেছে, ‘আমরা নিরাপদেই নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছে গেছি। তাদের পরিবহনে ভ্রমণ করার জন্য তার ধন্যবাদ’—সেসব কিছু কানেই ঢোকেনি। দেখি সবাই ব্যাগ নিয়ে নামতে ব্যস্ত। সবার মধ্যে অলিখিত এক প্রতিযোগিতা। কে আগে নামবে। আমি অনড় হয়ে থাকি।
নীলার তাড়ায় বুঝতে পারি। নামতে হবে। মনে হলো নিচে নেমেই নাম্বারটা নেব। বাস থেকে নামতেই গরম বাতাস গায়ে লাগে। বৃষ্টির বদলে রাজশাহীতে কড়া রোদ। দিনদিন আবহাওয়ারও পরিবর্তন ঘটছে। একই সময়ে কোথাও বর্ষা, কোথাও কাঠফাটা রোদ। প্রকৃতির প্রতি মানুষের নির্বিচারে নিষ্ঠুর আচরণের প্রতিফলন। সুন্দর ও বাসযোগ্য পৃথিবীর জন্য প্রকৃতির প্রতি সহনশীল হওয়া প্রয়োজন। নীলার ফোনটা বেজে ওঠে। কাকে যেন নির্দেশনা দিয়ে দেয়। বাসস্ট্যান্ডে আসার জন্য। সে যেই হোক। মনের ঘরণীকে তো পেয়েছি। ফোন নম্বর সংগ্রহ! একটু বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যাই। কিভাবে চাইব নাম্বারটি। ভাবি, কোনওভাবে নাম্বারটি নিয়ে নেই। আজকেই নীলাকে জানাবে পছন্দের কথা। পারিবারিক অবস্থার পাশাপাশি নিজের উজ্জ্বল ক্যারিয়ারের বিপরীতে নীলা বেশ মানানসই। আপত্তি অনাবশ্যকীয়ই মনে হয়। সহসা একটা লাল রঙের প্রাইভেট কার এসে দাঁড়ায় আমাদের গা ঘেঁষে। মেজাজটা খিচড়ে যায়। ব্যাটা ড্রাইভার, চোখে দেখো না! গাড়ি থেকে নেমে আসে হ্যান্ডসাম এক যুবক। সঙ্গে ফুটফুটে একটি বাবু। ৩ বছর হবে হয়ত তার বয়স। স্বপ্নে ছেদ পড়ে। আম্মু বলে বাবুটা নীলার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পরম প্রশান্তি। মায়ের বুক সন্তানের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ। পরিচয় করিয়ে দেই। এ হচ্ছে আমার হাজব্যান্ড। হাত বাড়িয়ে দেন ভদ্রলোক। চরম অনিচ্ছায় বাড়িয়ে দেই হাতখানি। তার হাতের তুলনায় নিজেকে ছোট মনে হয়। কার্ড বের করে দেন। সুযোগ হলে বাসায় চা খাওয়ার দাওয়াত দেয় নীলা। গাড়িটা মুহূর্তেই উধাও হয়ে যায়। রিকসাওয়ালা বলে ওঠে, ‘মামা, যাবেন নাকি?’
বাংলাদেশ সময়: ১৪২২ ঘণ্টা, এপ্রিল ৮, ২০১৫