১৯৮৪ (নাইনটিন এইটি ফোর)—বিখ্যাত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক, সাহিত্য সমালোচক ও সাংবাদিক জর্জ অরওয়েলের অমর গ্রন্থ। ১৯৪৯ সালে তার মৃত্যুর এক বছর আগে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়।
___________________________________
শুরু থেকে পড়তে ক্লিক করুন
দ্বিতীয় খণ্ডের ২২তম কিস্তি
___________________________________
স্যাকারিন খেতে খেতে চিনি নামের বস্তুটার কথা ভুলেই গিয়েছিল উইনস্টন। পকেটে এক হাত ঢুকিয়ে আর অন্যহাতে রুটি আর জ্যাম নিয়ে জুলিয়া কামরাটির এদিক ওদিক পায়চারি করে চলেছে, বইয়ের বাক্সটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল, গেইটলেগ টেবিলটিকে কিভাবে সারাই করা যায় তা ঠিক করল, ভাঙ্গা হাতলওয়ালা চেয়ারটিতে একবার বসে দেখল কতটা আরাম তাতে আর খুটে খুটে দেখল ১২ ঘণ্টা ডায়ালের ঘড়িটি। সবকিছুই করে চলল এক ধরনের বিমোহিত ভাব নিয়ে।
কাচের পেপারওয়েটটি হাতে করে বিছানার দিকে এলো যাতে অপেক্ষাকৃত আলোতে এটি ভালো করে দেখা যায়। উইনস্টন তার হাত থেকে ওটি নিয়ে নিল আর এর ভেতরে বৃষ্টির পানির ফোঁটার মত বুদবুদগুলো আবারও মুগ্ধ হয়ে দেখল।
‘জিনিসটা কী, বলো তো?’—বলল জুলিয়া।
‘এটিকে আমার কিছুই মনে হয় না—মানে আমি বলতে চাই, কখনওই কোনও কাজে এটি লেগেছে বলে আমার বোধ হয় না। আর ঠিক সে কারণেই জিনিসটি আমার পছন্দ। এটি স্রেফ এক টুকরো ইতিহাস যা ওরা পাল্টে দিতে ভুলে গেছে। এটি শত বছর আগের একটি বার্তা, তবে সে বার্তা—স্রেফ যে পড়তে পারবে তার জন্যই। ’
‘আর ওই যে ওদিকে টানিয়ে রাখা ছবিটি’—উল্টো দিকের দেয়ালের দিকে দৃষ্টি হেনে বলল জুলিয়া। ‘ওটাও কি শত বছরের পুরোনো?’
‘তারও বেশি। আমি বলতে চাই অন্তত দুইশ’ বছরের পুরোনো। কেউ আসলে বলতেও পারবে না। এখন এই যুগে আর এর জন্ম ইতিহাস জানা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। ’
ছবিটির দিকে এগিয়ে গেল জুলিয়া। ‘এখান থেকেই ইঁদুরটা নাক বের করেছিল’ বলেই ছবিটির ঠিক নিচে গর্তের ওপর লাথি বসাতে লাগল। ‘এটা কোন জায়গা, মনে হচ্ছে আগে কখনও স্থানটি দেখেছি’—এবার ছবির দিকে তাকিয়ে বলল সে।
‘ওটা একটা গির্জা, অন্তত বলা চলে, গির্জাই হবে। নাম ছিল সেইন্ট ক্লেমেন্ট’স ডেনস। ’ মাথায় এলো মি. চ্যারিংটনে ছড়াটি। আর আধেকটা নস্টালজিক হয়ে উচ্চারণ করল:
অরেঞ্জেস অ্যান্ড লেমন্স, সে দ্য বেলস অব সেইন্ট ক্লেমেন্ট’স!
আর তাকে ভীষণ বিস্মিত করে দিয়ে জুলিয়া আওড়াল:
ইউ ও মি থ্রি ফার্দিংস, সে দ্য বেলস অব সেইন্ট মার্টিন’স,
হোয়েন উইল ইউ পে মি? সে দ্য বেলস অব ওল্ড বেইলি—
এই লাইনটির পরে কী ছিল মনে করতে পারছি না। তবে মনে আছে ছড়াটি শেষ হয় এভাবে, “হিয়ার কামস অ্যা ক্যান্ডল টু লাইট ইউ টু বেড, হিয়ার কামস অ্যা চপার টু চপ অফ ইওর হেড!”
এটা কোনও গোপন সংকেতের দুটি ভাগ হবে। তবে ‘দ্য বেলস অব ওল্ড বেইলি’র পরে আরেকটি পঙ্ক্তি থাকার কথা। মি. চ্যারিংটনের মগজ থেকে সেটা খুঁড়ে বের করা সম্ভব হলেও হতে পারে। তবে তার জন্য তাকে মওকা মত পেতে হবে।
‘তোমাকে কে শিখিয়েছে?’—প্রশ্ন উইনস্টনের।
‘আমার দাদাভাই। যখন ছোট্ট মেয়েটি ছিলাম দাদাভাই আমাকে এগুলো খুব শোনাতেন। আমার যখন আট বছর বয়স তখন তাকে বাষ্পায়িত করা হয়—অর্থাৎ গুম হয়ে যান। আমি জানি না, এই লেবুটা দেখতে কেমন’—টানা বলেই চলল জুলিয়া। ‘কমলা দেখেছি। হলুদ রঙের গোল এক ধরনের ফল। চামড়া মোটা। কিন্তু লেবু দেখিনি। ’
‘লেবুর কথা আমার স্মরণে আসছে’—বলল উইনস্টন। পঞ্চাশের দশকে বাজারে খুব দেখা যেত। ওগুলো খেতে টক। ঘ্রাণ নিলেও তোমার দাঁত ধরে আসবে। ’
‘আমি বাজি ধরতে পারি, ওই ছবির পেছনে ছারপোকার আখড়া হয়েছে’—বলল জুলিয়া। ‘একদিন নিচে নামিয়ে ভালো করে পরিষ্কার করে দেব। আমার ধারণা এখন আমার চলে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। তবে তার আগে মুখের রঙ ধুয়ে ফেলতে হবে। ফালতু একটা জিনিস! তোমার মুখেও লিপস্টিকের দাগ লেগে আছে। ওগুলোও মুছতে হবে। ’
আরও কয়েক মিনিট বিছানায় পড়ে থাকল উইনস্টন। কামরাটি ধীরে ধীরে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে আসছে। যেদিকটা দিয়ে আলো আসছে সেদিকে ঘুরল আর শুয়ে শুয়ে তাকিয়ে থাকল কাচের পেপারওয়েটটার দিকে। ভেতরে বসানো কোরালটিতে যতটা না আকর্ষণ তার চেয়ে বেশি আকর্ষণ কাচের অংশে। বলা যায় বাতাসের মত স্বচ্ছ। মনে হবে কাচের উপরিতলটি ঠিক আকাশের মত। একটা ছোট পৃথিবী এই কাচের ভেতরে স্থান করে নিয়েছে। উইনস্টনের মনে হলো, ইস্ যদি এই কাচের ভেতরে ঢুকে পড়া যেত। আর সত্যি বলতে কী, মনে মনে সে আসলে কাচের ভেতরেই ঢুকে পড়ল। তার সঙ্গী হয়ে ভেতরে ঢুকেছে মেহগনির বিছানা, গেটলেগ টেবিল, ঘড়ি, স্টিলের খোঁদাই করা চিত্রকর্ম আর এই কাচের পেপারওয়েটি নিজেও। পেপারওয়েটটিই যেন পুরো কামরা আর সে তার ভেতরে। ওই কোরাল যেন জুলিয়ার জীবন, আর তার নিজেরও, যা স্ফটিকের কেন্দ্রস্থলে চির অবস্থান নিয়ে আছে।
দ্বিতীয় খণ্ডের ২৪তম কিস্তির লিংক
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ৯, ২০১৫
টিকে/
শিল্প-সাহিত্য
প্রতিদিনের ধারাবাহিক
১৯৮৪ | জর্জ অরওয়েল (খণ্ড ২ কিস্তি ২৩) || অনুবাদ: মাহমুদ মেনন
অনুবাদ উপন্যাস / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।