এসো হে বৈশাখ... দিয়ে ছায়ানট ষাট দশক থেকে পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষকে বরণ করে। এখন সেই সাথে যুক্ত হয়েছে নানান আয়োজন।
আর এভাবেই তো যেন নৌকা থেকে গ্রামের গরুগাড়ি চড়ে শহরে এসে, শহর থেকে ট্রেনে চড়ে রাজধানীতে এসে, আর রাজধানী থেকে উড়োজাহাজে উড়ে প্রবাসেও ছড়িয়ে পড়েছে বৈশাখি উৎসব। তাই টরন্টো, টোকিও, লন্ডন, নিউইর্য়ক, রোম, সিডনি—বিশ্বের বিভিন্ন শহরগুলো এখন মুখরিত হয়ে ওঠে বাঙালিদের বৈশাখি উৎসবে। প্রবাসে কর্মব্যস্ততা এবং জীবন সংগ্রামে হাঁপিয়ে উঠে, বিদেশি সংস্কৃতির মধ্যে হাবুডুবু খেতে খেতেও নিজস্ব শেকড়ের সন্ধানে বৈশাখের এসব আয়োজন। বিশেষ করে দেশের বাইরে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের কাছে এটা তাদের আদি উৎসব ও আত্মপরিচয়ের স্মারক হয়ে ওঠে।
কানাডায় বহুজাতিক সংস্কৃতির প্রবর্তক পিয়েরে ট্রুডো। (যিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু হিসেবে সন্মাননা পেয়েছেন। ) তাই কানাডায় বিভিন্ন দেশের মানুষ তাদের ‘ব্যাক হোমে’র সংস্কৃতি পালন করে। যা দেশটিতে একটি নতুন মাত্রা সৃষ্টি করে।
বিদেশে মিশ্র সংস্কৃতির মধ্যে পিতৃপুরুষদের ঐতিহ্য বা সংস্কৃতি প্রকাশও এক ধরনের অহংকার, গৌরব। কারণ, বিভূঁইয়ে তৃতীয়/ চতুর্থ/পঞ্চম প্রজন্মরা পর্যায়ক্রমে মিশ্র-সাংস্কৃতিক স্রোতে হারিয়ে ফেলে আত্মসংস্কৃতির অস্তিত্ব। সেজন্য শুধু স্বদেশ বা মাতৃভূমির স্বার্থেই নয়, বিশ্ব সংস্কৃতির স্বার্থেই প্রতিটি জাতি-গোষ্ঠী-সম্প্রদায়ের নিজ নিজ সংস্কৃতিকে চর্চার মাধম্যে বাঁচিয়ে রাখা একান্ত আবশ্যক।
কানাডায় সকল সম্প্রদায়ই নিজেদের নতুন বছর নিজস্ব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যদিয়ে বরণ করে। তবে চাইনিজদের নববর্ষ উৎযাপন চোখে পড়ার মত। এদিকে শিখ সম্প্রদায় কর্তৃক আয়োজিত বাংলা নতুন বছর বরণের উৎসব উপলক্ষে বৈশাখি শোভাযাত্রায় যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার। কানাডার পশ্চিমের ব্রিটিশ কলম্বিয়া প্রদেশের ভ্যাঙ্কুভার নগরীর গুরুদুয়ারা থেকে শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। বৈশাখি শোভাযাত্রায় প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও ব্রিটিশ কলম্বিয়া প্রদেশের প্রিমিয়ার ক্রিস্টি ক্লার্ক উপস্থিত ছিলেন। *১
প্রধানমন্ত্রী হারপার গত বছর এক চিঠিতে প্রবাসী বাঙালিদেরকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে বার্তা দিয়েছিলেন। বার্তায় তিনি বলেন, ‘পহেলা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষে, আমি সবাইকে অত্যন্ত আন্তরিকভাবে উষ্ণ শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আজ রাতের উৎসব পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে একত্রে মিলিত হবার, এবং যে বছরটি গত হয়েছে তার ঐতিহ্যকে প্রতিফলিত করার সুযোগ সৃষ্টি করা। আপনাদের জীবনে প্রতিফলিত অতীত ঐতিহ্য ও আচারানুষ্ঠান আমাদের দেশেও অবদান রাখছে। আমি বাংলাদেশ হেরিটেজ অ্যান্ড ইথনিক সোসাইটি অব আলবার্টার প্রশংসা করতে চাই, নববর্ষ উদযাপনে তাদের উদ্যোগ ও অব্যাহত প্রচেষ্টা গ্রহণের জন্য এবং তাদের মধ্যে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক বন্ধন গড়ে তোলার জন্য। ’ *২
বাংলা নববর্ষের কাছাকাছি শনি-রবি ছুটির দিনে অটোয়া, টরন্টো, মন্ট্রিয়াল, আলবাট্র, সাচকাচুয়ান, ভ্যাঙ্কুভারের বিভিন্ন সংগঠন ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেয়। বাংলা পাড়াগুলো জমে উঠে বৈশাখি মেলায়, কবিতা-গানে-নাচের নানান আয়োজনে। অথচ এক যুগ বা এক দশক আগেও এত ব্যাপক হারে বৈশাখি উৎসব পালিত হতো না। ঘরোয়াভাবে বন্ধুবান্ধব আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে পান্তা ইলিশ খাওয়ার মধ্যেই একসময় এ উৎসব সীমাবদ্ধ ছিল। আর এখন ৫ ডলার/১০ ডলার টিকিট কেটে প্রবাসীরা বৈশাখের অনুষ্ঠান উপভোগ করে।
বিগত ৩/৪ বছর ধরে দেখছি, প্রচণ্ড শীত ও তুষারপাত শেষ হয়ে বরফ গলে অপরূপ সবুজে ছেয়ে যায় পৃথিবীর অন্যতম সেরা শহর টরন্টো। আর টরন্টোবাসীও গা ঝারা দিয়ে জেগে ওঠে শীতসমগ্র থেকে। ফলে বৈশাখি উৎসব প্রাণ পায় ভিন্ন মাত্রা।
প্রতি বছরই, বাংলাদেশ থেকে আসছেন খ্যাতিমান শিল্পীরা। রুনা লায়লা, আলমগীর, বেবী নাজনীন, শুভ্র দেব, এন্ড্রো কিশোর, কুমার বিশ্বজিৎ, তপন চৌধুরী, কনক চাপা, তারিন, হায়দার হোসেন, শাহনাজ বেবী, জিনাত জাহান মুন্নি, মিলারা এসে উৎসবের অনুষ্ঠানগুলোকে জীবন্ত করে। ক্ষণিকের জন্য হলেও গানে গানে মনে হয় প্রবাসে মিনি বাংলাদেশ।
ঢাকার রমনার উৎসবের মত না হলেও প্রবাসী বাঙালিরা সেজেগুজে বিশেষ করে নারীদের শাড়ি পরা মনে করিয়ে দেয় কুমার বিশ্বজিতের গানের কলি: ‘এক দিন বাঙালি ছিলাম রে’...
___________________________________
তথ্যসূত্র:
১. ডেইলি ভ্যাঙ্কুভার সান, এপ্রিল ১৭, ২০১১, ভ্যাঙ্কুভার, কানাডা।
২. অন লাইন দেশে বিদেশে, ১৯শে এপ্রিল ২০১৪, টরন্টো।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৫