‘তুমি যদি গাছ হতে পারতে তবে কোন গাছ হতে?’
একবার ক’বছর আগে এক লেখালেখির ওয়ার্কশপে এরকম একটি প্রশ্ন ছিল। তখন বিলেতে বসন্ত ছিল।
আমাকে এ প্রশ্নের উত্তর নিয়ে একটি সুশ্রী লেখা হবে। স্বাদে গন্ধে স্পর্শে মাতোয়ারা। কিন্তু সে তো পরের কথা—আগে জানতে হবে আমি কী গাছ হতে চাই। যে বৃক্ষ ভালো লাগে তা নিয়ে হলে তো এখনই লিখে ফেলতাম চল্লিশ লাইন। পারি তো ওই একটি কাজই। কিন্তু আমাকে ভাবতে হবে কেন হতে চাই তাও। অর্থাৎ তার দ্রব্যগুণও লাগবে।
আমার চারিদিকে এত সুন্দর সুন্দর ফুলবতী গাছ, এদের দেখে থ হয়ে থাকি। কিন্তু এদের দেখে তো আমি বড় হইনি। এরা কেউ তো আমার না। বাতাসে রোয়ানের টিয়া রঙের নরম পাতা দুলে উঠলে আমাদের গ্রামের বাড়ির পেছনের মৎসগন্ধা ঘাট পাড়ের কামরাঙা গাছের কথা মনে পড়ে যায়। এপ্রিলে মাউন্টেন বুশ দেখে মনে পড়ে যায় নীল ক্ষেতে রোকেয়া হলের সামনের বেগুনী জারুল।
খুব ভেবে দেখলাম আমাদের দেশে বৈশাখ শেষ হয়েছে। এখন সেখানে বাংলার ফলবতী মাস জৈষ্ঠ। মিষ্টফলের মাস। যার এক কানি জমি আছে তারও নিজের গাছের পাকা আম রাতের বেলা টুক করে টিনের চালে পড়ে। শব্দ শোনা মাত্রই আলো নিয়ে ঘুম চোখে সে আম খুঁজে আনে বাড়ির কিশোর, পরদিন আমের মধু নিংড়ে হাত ডুবিয়ে দুধভাত খাবে। এই তো এই একটাই মাস। আর কাঁঠালের কথা কী বলব! দেশের মানুষ সারা বছরে যেমন তেমন, তারা এ সময় অন্তত একটি কাঁঠাল নিয়ে হাট থেকে বাড়ি ফেরে। এ এমনই এক ফল যে পাকা কাঁঠালের গন্ধে বাড়ি ম ম করা মানেই পার্টি টাইম আসছে। হাতে তেল মেখে মা যখন একটি সুগন্ধি কাঁঠাল ভাঙ্গার প্রস্তুতি শুরু করেন ছেলে মেয়েরা গোল হয়ে বসে। তারপর মা খুলে খুলে দেন সেইসব অমৃত তুল্য সোনা রঙ কোশ। ছেলেমেয়ে, শ্বশুর শাশুড়ি, অতিথি সবাই মিলে শক্ত কোশ খায় কচকচিয়ে শব্দ তুলে, দাঁতের ফাক দিয়ে গল গল করে চলে আসে মধুর রস। নরমটাকে দুধের সঙ্গে খাওয়ার জন্য তোলা হয়। অর্ধপুষ্ট সুমিষ্ট ‘চাবি’ চুষবার জন্য চলে গুচ্ছের বাঁকে বাঁকে হাতড়ানো। তারপর হয় বীজ দিয়ে হালুয়া ও তরকারি। বৃষ্টির দিনে গরম গরম বীজ পোড়া। বাকি টুকু গা, গরুর। কাঁঠাল গাছের কিছুই যায় না বাকি। পাতার গায়ে তেল মাখিয়ে তৈরি হয় পিঠা ও পাঁপড়ের সত্ত্ব। আর কাঁঠাল কাঠে তৈরি হয় ভালো ঘুমের জন্য উৎকৃষ্ট পালংক। আর গাছে যে পরিমাণ ফল ধরে! ঘাটে ঘাটে গলায় গলায়। একটি ফলে সারা বাড়ির পেট ঠাণ্ডা। এসব মনে হতেই জোরে চিৎকার দিয়ে বলেছিলাম আরেক জীবনে আমি কাঁঠাল গাছ হব। মনে মনে বললাম, এ জন্যই এ ফল আমাদের জাতীয় ফল।
আমাদের সারা বছরের মাসগুলোও চিহ্নিত হয়ে আছে সে মাসের দ্রব্যগুণে। সে সময় আমরা কী খাই, কোন উৎসব করি, আমাদের গায়ে কেমন লাগে, কেমন হয় আমাদের চেতনা। আমাদের জাতীয় উৎসবগুলোর ফল হিসেবে বস্তুগুণ সবচেয়ে যার বেশি, সেটা নববর্ষের মাস—বৈশাখ। নববর্ষ আমাদের কাঁঠাল গাছ। এর সবটুকু আত্মসাৎ করতে পারলেই আপনি বাঙালি। অথবা এর সবই যদি হয়ে থাকে আপনার উত্তরাধিকার তবে এই আপনার ‘ফ্ল্যাগ শিপ’ ইভেন্ট। আপনি আরবের পোশাক পড়ুন, আর পশ্চিমের র্ধম পালন করুন—আপনার নৃতাত্ত্বিক পরিচয় যে বাঙালি সেটার উত্তরাধিকার ছাড়তে পারবেন না। ছাড়ানো যায় না। আপনি এড়িয়ে গেলে মসে করাবে অন্যে। এ উৎসবে কাউকেই যায় না ফেলা—কেউ থাকে না দরোজার বাইরে দাঁড়িয়ে উপোষ।
উনিশশ বায়ান্নতে উপ্ত বীজের প্রশ্নচিহ্ন’র গোড়ায় রক্তজল ঢেলে ঢেলে যে আমরা হেঁটেছি র্দীঘ। সে গাছ বড় হয়ে হয়েছে বনষ্পতি। সে উৎসব এই বৈশাখি উৎসব। বিভিন্ন আন্দোলনে রঙে ও রেখায় আমাদের দেশের যে জাতীয় চরিত্র সৃষ্টি করেছি—নানান বাঁকে ঘুরে ঘুরে আমরা যে মোহনায় এসেছি তারই অন্যতম প্রতিসরণ এই বাংলা নববর্ষ উদযাপন—এই বৈশাখি মেলা। আর সে কারণেই আজ দেশ ও বর্হিবিশ্বের বাঙালিরা অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করেন। বিদেশ বছরের প্রথম দিন নানাবিধ কারণে করা যায় না বলে—এ এখন নবর্বষ পালন উৎসব পালিত হয় অন্য সময়ে—কিন্তু হয়ই। একমাত্র এরই মাধ্যমে বাঙলাদেশের বাঙালির পরিচিতি ঠিক ততটাই পরিস্ফূট করা সম্ভব হয় যতটা হলে বহির্বিশ্বে আর সবার কাছ থেকে আমাদের জাতিসত্তাকে আলাদা করা যায়—সনাক্ত করা যায়।
সংগ্রামী ও অত্যাচার জর্জরিত এ জাতি বিভিন্ন আন্দোলনে রঙে ও রেখায় আমাদের দেশের যে চরিত্র সৃষ্টি করেছে তার অন্যতম প্রতিসরণ ঘটে এই বাংলা নববর্ষ উদযাপনে। সকল ধর্ম, বর্ণ, নৃ-গোষ্ঠি, সম্পদবান, সম্পদহীন, বিভিন্ন নেশা ও পেশার সকলের এ অনুষ্ঠান। আর তারই জন্য বহির্বিশ্বের বাঙালিরা বাংলা নববর্ষ উদযাপন করতে থাকেন বাংলা নতুন বছরের শুরু থেকে প্রায় জৈষ্ঠ মাস ছাড়িয়ে এমনকি আষাঢ় অবধি।
সমুদ্র ফেঁড়ে ওঠা এই বদ্বীপে বিভিন্ন সময়ে অনুপ্রবেশ করেছে ভিনদেশি লেবাস ও ধর্ম। আর আমাদের জাতিসত্তার চিহ্নায়নে বাঙালিয়ানার স্থানে যুক্ত হয়েছে নানান বিভ্রান্তি। দেশ থেকে উপ্ত সে বিষ ছড়িয়েছে বিদেশেও। আমরা রিব্রান্ডেড হতে যাচ্ছিলাম একটি জঙ্গী জাতি হিসেবে। তখন আমরা দায়ে ঠেকেই একটি সার্বজনীন অভিব্যক্তির খোঁজ করেছি বছরের পর বছর। যেখানে দেশের কেউই বাদ না যাই। বাংলা নববর্ষ উদযাপন আসলে তাই। এ আমাদের অবয়বে পরিচয় তিলক। সাইন পোস্ট। যাতে আমাদের পোশাক আশাক, আহার আচরণ, আপ্যায়ন আমোদ, রুচি ও রাগ, সঙ্গীত ও সাহিত্য, ইতিহাস ও ঐতিহ্য, চেতনা ও চাঞ্চল্য—সবই মূর্ত হয়ে ওঠে। আমাদের দেশ চিহ্নিত হয় মৌলবাদী নয় মানবধর্মবাদী এক অসাম্প্রদায়িক, আনন্দপ্রিয় প্রাচীন জাতিগোষ্ঠী হিসেবে।
সেই যে আইয়ুব মোনায়েম আমলে রবীন্দ্র সঙ্গীত বন্ধ করার চেষ্টার বিরুদ্ধে মানুষ প্রতিবাদ করেছিল আর রমনার বটবৃক্ষের নিচ থেকে শুরু হয়েছিল ছায়ানটের আয়োজনে পয়লা বৈশাখ উদযাপন—আজ তা অন্যতম জাতীয় উৎসব। এখন সময় এসেছে দেশের জাতীয় দিবসগুলোর রঙ শুধু নয় তার আত্মাটাকে ধারণ করে এগিয়ে যাওয়া। বিশেষ করে বিদেশে। মঙ্গল শোভাযাত্রায় নতুনত্বের লোভ না করে মোটিফগুলোর পুনরাবৃত্তির মাঝে তা শক্তপোক্ত ভাবে স্থাপন করা। জাতীয় খাবার, পোশাক, শিক্ষা, আচরণ, আইকন সবই এ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করেই হওয়া উচিত। বাংলাই আসল কুসুম। মাল্টিকালচারের নামে বাজেট আসতেই পারে। কিন্তু তা এসেছে তো বৈশাখি মেলার জন্যই। এর থিম তো আমাদেরই নববর্ষই—তাই না? এখানে আমাদের বিষয় আশয় হতে হবে—ধর্ম নিরপেক্ষতা, স্বাধীনতার মূল চেতনা, বহুজাতিকতা—এসবই। বাংলাদেশের সাহিত্য শিল্প শিক্ষারই প্রতিসরণ এখানে সবার কাম্য। সুন্দর লাগলেই ওই গাছ আমার বলে বেয়ে উঠতে হবে না। তোরা যে যা বলিস ভাই আমার কাঞ্চন বর্ণ কাঁঠাল ফল চাই। ওই আমাদের মধুগাছ। আর তাতেই দেশে ও বিদেশে একটি ইতিবাচক চিহ্নায়নে আমাদের দেশ এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশের ছায়া পৃথিবীর আর সব দেশ থেকে আলাদা করা যাবে। বাংলাদেশ সুসংবাদ হিসেবে পৃথিবীতে রিব্রান্ডেড হবে। এ ভরা চকচকে আকাশের নিচে নতুন প্রজন্মের কাছে উত্তরাধিকারের চর জাগবে। তারা হবে আমাদের স্বপ্ন নদীর নাইয়া।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৫