হাজব্যান্ড ইন ম্যানভিল |
ঢাকা থেকে দূর শহরে এসেছি। স্নাতকোত্তর প্রোগ্রামের পরীক্ষার বহিঃপরিদর্শক হিসেবে।
পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ফিরছি উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ বেয়ে। বলতে শুরু করলেন, আমার স্বামীও চাকুরিজীবী। বদলির চাকুরি। এখন পোস্টিং রংপুর জেলায়। আমি বললাম, সে তো বাংলাদেশের আরেক প্রান্তে। আসতে-যেতে তো কষ্ট হয়। তিনি বললেন, আর বলবেন না স্যার, সে তো পাগল। একটু ফাঁক পেলেই ছুটে আসে। আমাদের একটি কন্যা আছে। সে তাঁর পাগল। প্রতিদিন কথা বলা চাই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বাপ-বেটির সেকি সখ্য! আর আপনার? সে আর বলবেন না স্যার বলে লাজুক হাসলেন। গোধূলির আভা ছড়িয়ে পড়ল তাঁর রক্তিম মুখে। একটি সুখি পরিবারের প্রাণবন্ত ছবি ভাবতে ভাবতে তাঁকে বিদায় জানিয়ে ফিরলাম সন্ধ্যায়।
উঠেছি শহরের আত্মীয়ের বাসায়। রাতে খাবার টেবিলে ম্যাডামের সুখগল্পটি বললাম তাঁদের। বাসার গৃহকর্ত্রী খুবই অবাক হলেন। তিনি ম্যাডামকে চিনেন। বললেন, বলেন কী জিবরান ভাই। উনার তো স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়েছে সে অনেক দিন!
ফিরছি রাতের ট্রেনে। দুলছে ট্রেন পু ঝিক-ঝিক। জানালার বাহিরে অন্ধকার, চরাচর মায়াময়।
শিশুকালকে দুগ্ধপান করাচ্ছিলেন, পিতা |
এ ঘটনাটি আমরা প্রায় দিনই দেখতাম। পিতা কুড়িয়ে এনেছেন কুকুর বা বিড়ালের ছানা আর মাতা রে রে করছেন।
আমাদের মাতা ছিলেন বলরামপুরের বিখ্যাত পীরের বাড়ির বড়পীরের বড় মেয়ে। খারিজিপন্থী, রক্ষণশীল। নামাজ অন্যদের পাঁচওয়াক্ত থাকলেও তার থাকত ছয় সাত ওয়াক্ত। রোজা বারোমাস। আর পিতা ছিলেন ঠিক উল্টোটি। বাউল প্রকৃতির—ছন্নছাড়া। তার পূর্বপুরুষ ছিলেন সুফিবাদি। তার বংশের বিখ্যাত ফকির ছিলেন ফকির আজমত শাহ্। এ বাউলিপনা পিতার মনে পুরোটাই বিরাজিত ছিল। অবশ্য এ চরিত্র না পেয়ে পিতার উপায়ও ছিল না। পিতা যখন তার মায়ের গর্ভে তখন তার পিতা মৃত্যুরবণ করেন। মা মারা যান পিতার তিনমাস বয়েসে। ফলে পিতা বড় হতে থাকেন চাচ-চাচির কাছে। শুরুতে চাচা তাকে আদর-কদরের সাথে বড় করতে থাকলেও এক সময় যখন তার চাচার নিজের পুত্র জন্মায় তখন সে আদর খাদে নেমে আসে।
পিতা যখনই কোনও কুকুর বা বিড়ালের ছানা সিদ্ধেশ্বপুর কবরস্থান থেকে কুড়িয়ে আনতেন মাতা আতঙ্কিত হয়ে উঠতেন। তার বিশ্বাস তার ধর্মমতে কুকুর বিড়াল না-পাক প্রাণি। এরা বাড়িতে থাকলে আল্লাহর ফেরেশতারা বাড়িতে আসেন না। ঘর নাপাক হয়ে যায়। ছুঁলে ওজু চলে যায়। ফলে মাতার জন্য এ ছানাগুলো মহা পেরেশানির কারণ হয়ে ওঠে। আর আপত্তির কারণ হচ্ছে আমাদের লালগাই যে দুধ দেয় পিতা বোতলে বোতলে ভরে সেগুলো এ বিড়াল কুকুরছানাগুলোরে খেতে দেন। তারা চুক চুক করে খায়। কেননা, তারা থাকে সদ্য মায়ের দুগ্ধহারা।
আমাদের গ্রামের কবরস্থানটি অবাঞ্ছিত কুকুর-বিড়াল ছানা ফেলার এক মহাস্থান। কার্তিকমাসে যখন কুকুর সম্প্রদায় প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে বা বিড়াল আর্তস্বরে ডাকে—গ্রামবাসীর তখন কবরস্থানের কথাই মনে পড়ে। এরা শীঘ্রই হালি হালি বাচ্চা দেয়। বাচ্চাগুলো যখন মায়ের দুগ্ধপানরত, তখনই হয় ধরার উত্তম সময়। তারা বাচ্চাগুলোকে ধরে বস্তায় পুরে নেয়। মা বেড়াল বা কুকুর কিছুক্ষণ পিছু নেয়। তারপর তাড়া খেয়ে পিছু হটে। গ্রামবাসী বাচ্চাগুলো ফেলে আসে গ্রামের সদ্যভেঙে পড়া কোনও কবরের গহ্বরে। পিতা এগুলোকে সেখান থেকে তুলে আনেন। আর দুধ পান করতে দেন।
একদিন পিতা মাথা নিচু করে কয়েকটি সদ্য কুড়িয়ে আনা বিড়ালছানার মুখে দুগ্ধবোতল ধরে রেখেছেন। তারা চুকচুক করে পানরত। মাতা সেখান হাজির হলেন। তিনি প্রবল আপত্তি তোলেন দুগ্ধের অপব্যবহারে, কড়া ভাষায়। পিতা কথা বলেন না।
তুমি জানো, আমি কত ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছিলাম। মায়ের দুধ খেতে পাইনি। তারপর মানুষ হয়েছি কুকুর-বিড়ালের মত। আজ আমি আমার শিশুকালকে দুগ্ধ পান করাচ্ছি—সজলচোখে পিতা এক সময় মুখ তুলে বলেছিলেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৫