বিহান
___________________________________
নগ্ন তুমি যেন তোমার নগ্ন একটা হাত—এমনই সহজ;
এমনই পেলব, মৃন্ময়, ছোট্ট, স্বচ্ছ, গোল।
ধরেছো চন্দ্ররেখা, রেখেছো আপেলবীথিকা,
নগ্ন তুমি যেন এক নগ্ন শস্যকণা—তেমনই একহারা।
কিউবায় নেমে আসা নীল যামিনীর মতো নীল নগ্ন তুমি;
লতাগুল্ম তারাদের রেখেছো তোমারই কেশভারে।
নগ্ন তুমি বিস্তীর্ণ, হলুদ
সোনালি গির্জায় দেখা গ্রীষ্মের মতো।
তোমার একটা নখ যেমন খুদে, তুমি নগ্ন তেমনই;
সূক্ষ্ম, গোলাপরাঙা, বাঁক তাতে আছে,
সকাল জন্মাবার আগে যেমনটা থাকে,
যার পরে চলে যাও পাতালপুরেতে।
পোশাকের, রুটিনের দীর্ঘ এক সুড়ঙ্গ ধরে,
তোমার দীপ্তিখানি নিভু-নিভু হয়; জামা প’রে নেয়, ঝরায় পত্রালী,
এবং হয়ে যায় শুধু নগ্ন একটা হাত, আরও একবার।
সবচেয়ে দুঃখের লাইনগুলি আজ রাতে লিখতে পারি
___________________________________
সবচেয়ে দুঃখের যে লাইনগুলি, আজ রাতে লিখতে পারি আমি তা-ই।
যেমন, লিখতে পারি, ‘তারাচ্ছন্ন রাত্রি আর
নীল নীল তারাগুলি দূরে বসে শুধু কাঁপছে’।
আকাশের বুক জুড়ে রাতের বাতাস ঘুরে ঘুরে পাক খাচ্ছে,
আর কী জানি কী গাইছে।
সবচেয়ে দুঃখের যে লাইনগুলি, আজ রাতে লিখতে পারি আমি তা-ই।
তারে ভালোবাসতাম, কখনও বুঝি বা সে-ও বাসত আমারে।
এমনই রাত্রিতে তারে জড়িয়ে রাখতাম রাতভর।
বারবার চুমু খেতাম তারে
সীমাহীন আকাশের তলে।
সে আমারে ভালোবাসত, কখনও বা আমিও বাসতাম তারে।
কেমনে কেউ না-বাসে ভালো ঐ ব্যাপক, অচঞ্চল চোখদুটিরে?
সবচেয়ে দুঃখের যে লাইনগুলি, আজ রাতে লিখতে পারি আমি তা-ই।
যে-ই ভাবি, আমার সে নাই। যে-ই অনুভব জাগে, তারে আমি হারিয়েছি।
অনন্ত রাত্রির ধ্বনি যে-ই শুনি, তারে ছাড়া যে রাত্রি অনন্ততর—
আত্মার ’পরে ঝরে কবিতার লাইন, মাঠের উপরে ঝরে যেমনে শিশির।
যে প্রেম আমার তারে পারেনি রাখতে ধরে—তাতে কী বা আসে যায়?
রাতটা তারায় ভরা, আর আমার কাছে নাই। নাই। সে তো নাই।
হ, এইটুকুই।
দূরে কে জানি গান গায়।
দূউউউরে।
তারে হারিয়ে প্রাণের আমার আর শান্তি নাই।
চোখ বলে খুঁজে আনি তারে, টেনে আনি কাছে।
মন তার সন্ধানে, আর সে-ই নাই সাথে মোর!
আহারে, সেই একই রাত্রি সেই একই গাছেদের শাদা করে রাখে,
সেই একসময়ের দুইজনা আমরা, আর একই রইলাম কই?
আমি তারে আর ভালোবাসিনা, হ—বাসি না নিশ্চয়ই, তবুও কী ভালোটাই না বেসেছিলাম!
কেমনে বাতাসের খোঁজে থাকত কণ্ঠ এই, যদি ছোঁয়া যায় তার শ্রুতি একটুকু।
অন্য কারোর। অন্য কারোরই সে হবে। আমার চুমুর আগে সে যেমন ছিল।
তার স্বর, তার দ্যুতি ঠিকরানো দেহ, তার অনন্ত চোখ।
তারে আর ভালোবাসিনা, হ—তবু যেন বাসিও বা ভালো।
ভালোবাসা এইটুকু; ভুলে যাওয়া দীর্ঘ, দীর্ঘ এত।
এমনই রাতভর জড়িয়ে রাখতাম বলে তারে,
প্রাণের আমার শান্তি নাই, শান্তি নাই—প্রাণ হারিয়েছে তারে।
যদিও এ-ই শেষ। আমারে দেওয়া তার এ-ই শেষ ব্যথা।
তার তরে লেখা মোর শেষ কবিতা।
প্রেম
___________________________________
কী সমস্যা বলো তো তোমার! কী সমস্যা আমাদের?
হচ্ছে কী আমাদের সাথে?
আমাদের প্রেম যেন নিষ্করুণ দড়ি এক
বজ্রআঁটুনিতে বাঁধে যত, জখমে আমাদেরকে বিদীর্ণ করে।
আর, জখমকে যদি চাই
পিছে ফেলে যেতে,
আলাদা আলাদা হয়ে যেতে,
নতুন গিঁটের আঁটে বাঁধে আমাদের; শাস্তির বিধান দেয়
রক্ত বহাবার আর যুগলে পোড়ার।
তোমার কী অসুবিধা বলো তো? যতবার তোমাকে দেখি
কিচ্ছু পাই না...নাঃ। শুধু দুটি চোখ পাই
আর সব চোখেদের মতো; একখানি মুখ পাই
তলিয়ে গিয়েছে আমার অতীত সহস্র মুখচুম্বনের মাঝে, বরং ওইগুলি ছিল সুন্দরতর।
আর কী? একটা শরীর? আর সব ভুলে যাওয়া শরীরের মতোই,
পিছলে গিয়েছে যারা বিস্মৃতির দিকে, আমার শরীরের তল দিয়ে।
কতখানি শূন্য হয়ে পৃথিবীতে ঘুরেছো যে তুমি
গমরঙা একখানা কৌটার মতো
বায়ুহীন, শব্দহীন, সারবস্তুহীন!
বেহুদাই তোমার মাঝে গভীরতা খুঁজেছি আমি,
ভেবেছি ডুববে তাতে আমার অক্লান্ত বাহুদুটি
যারা শুধু দিনমান খুঁড়ে যায় মাটির তলাঃ
তোমার ত্বকের তলা, তোমার চোখের তলা,
কিচ্ছু নাই, নাঃ।
হালকা উত্থিত তোমার দুইটা বুকের তলে
ফটিকস্বচ্ছ এক স্রোত বয়ে যায়—
হাবা স্রোত জানে নাকো কেন বয়, কেন গান হয়।
কেন, কেন, কেন,
বলো প্রিয়, কেন?
একটা কুকুর মরেছে
___________________________________
আমার কুকুরটা মরে গেছে।
দাফন করেছি তাকে বাগানের মাঝে
জং ধরা একখানা মেশিনের পাশে।
ওখানেই একদিন মিলন ঘটবে জানি মোর সাথে তার,
আজকে যদিও সে চলে গেছে আউলা, লোমশ—
ঠাণ্ডা নাকটা লয়ে, আকাট ও সহবতহীন,
জড়বাদী বলে আমি বিশ্বাস করি নি কভু
আকাশের শিকায় তুলে রাখা কোনও স্বর্গে।
মানুষের তরে তুলে রাখা সে কি? হাঃ—
তো, জানি স্বর্গে নাই মোর প্রবেশাধিকার।
তবে হ্যাঁ—কুকুরকুলের লাগি তুলে রাখা আছে স্বর্গ এক;
আমার কুকুরটা যেথা আমারই অপেক্ষাতে রবে
দোস্তিতে গদগদ, লেজ নেড়ে ঘুর্ণিত পাখার মতোন।
হেঃ—দুনিয়াবি দুঃখ নিয়ে কিছু বলব না
সঙ্গী হারানো হাবিজাবি—
সেবাদাস হয়নি কো যে-বা।
কর্তৃত্ব না-ফলানো শজারুর মতো
তার সাথে দোস্তি ছিল—নক্ষত্রের সাথে হয় বন্ধুতা যেমন, নিঃসঙ্গ বিধুর,
এক্সট্রা খাতির কিছু ছিল না কো, মাখামাখি
বাহুল্যবর্জিতঃ
জামা বেয়ে ওঠে নাই কখনও সে
আগ্রহে ভরে নি মোরে পশমে, খুজলিতে,
আমার হাঁটুতে কভু ঘষে নি শরীর
যৌনক্ষুধিত বাকি কুকুরের মতো।
না গো, আমার কুকুর শুধু অপলক চাহনিতে
চাহিদা মতোন ঢেলে দিত মনোযোগ,
যতটা পাত্তা পাওয়া প্রয়োজন ছিল মোর,
আমার মতোন এক ফালতু লোকেরও তাতে প্রত্যয় হতো—
কুকুর হিসাবে তার অনেক সময় এতে হলো অপচয়।
তবুও সে দু’টি চোখ—আমার চোখেরও থেকে বহু শুদ্ধতর,
অপলক আমাতেই পেতে রাখা ছিল
একলা আমারই তরে সংরক্ষিত যেন।
টুকুস, লোমশ তার জীবনটা ছিল
হামেশা আমারই পায়ে, জ্বালাত না মোটে,
প্রশ্নও করত না মুখ ফুটে কভু।
আহা, কত কতবার তার লেজ দেখে হয়েছে ঈর্ষা
সাগরবেলায় তাকে নিয়ে পথ হেঁটেছি যখন—
কাউলাদ্বীপের সেই একাকী শীতের ঋতুতে,
অতিথি পাখির দল যেখানে আকাশ ছেয়ে ছিল
লোমশ কুকুর আমার কেমন লাফাল ঝাঁপাল,
সাগরের প্রাণশক্তি তার মাঝে সংক্রমিত ছিল।
ঘুরঘুরে অভ্যাসে শুঁকে আর শুঁকে
উত্থিত স্বর্ণালী লেজে
সমুদ্রের ফোয়ারাকে করল মোকাবেলা।
মাস্তিতে, মাস্তিতে, মাস্তিতে।
শুধু সারমেয়রাই যে সুখী হতে জানে
বেহায়া বিন্দাস স্ফূর্তিতে।
আমার যে কুকুরটা মরে গেছে, তারে বিদায় দেবার কিছু নেই,
সে আমারে, আমি তারে, মিথ্যা বলি না আজ; মিথ্যা বলি নি কোনওদিনই।
সে যে আজ চলে গেছে, কবর দিয়েছি আজ তাকে,
এটুকুই, এটুকু বটে। এর বেশি আর কিছু নেই।
রেলগাড়ি যে স্বপ্নে ছিল
___________________________________
স্টেশনে শুয়ে শুয়ে ট্রেনগুলি স্বপ্ন দেখছিল
ইঞ্জিনহীন, ঘুমন্ত, অসহায় শুয়ে শুয়ে।
ভোরবেলা ভিতরে গেলাম আমি, একটু কিন্তু-কিন্তু করেঃ
গোপন যা কিছু আছে, নামলাম তার সন্ধানে,
বগিতে হারিয়েছে যা, ডুবেছে যাত্রার বাসী গন্ধে,
বিগত শরীরদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে
ভাবলাম কত একা আমি এই অচল গাড়িতে।
ভিতরের বাতাসটা থিকথিকে, চুপসানো একতাল
মরা বাক্যালাপ, ফেরারী স্তব্ধতায় ছিল নিস্তরঙ্গ হয়ে।
নিখোঁজ আত্মারা বুঝি পড়ে ছিল সিটের তলায়,
তালা-নাই চাবিরা যেমন।
দক্ষিণ থেকে ওঠা জেনানা সওয়ারিগণ
ফুলের স্তবক আর মুরগির ভারাক্রান্ত যারা—
হয়ত বা খুন হয়েছিল,
হয়ত বা তারা ফিরে গিয়ে কেঁদেছিল,
পুষ্পানলে তারা বুঝি খাক করেছিল
এক-একটা বগি,
আমি বুঝি সেই তাদের সহযাত্রী হলাম,
ভাবলাম, হয়ত বা যাত্রার বাষ্প,
ভেজা ট্রেনলাইন, সকলই জীবন্ত আজি
এ অচল গতিহীন ট্রেনে, আর
আমি এক ঘুমন্ত সওয়ারি
কপালের দোষে আজ সতর্ক অস্থির।
সিটে বসা আমি, আর ট্রেন চলছিল
এই শরীরের মাঝ দিয়ে, ধ্বংস—ধ্বংস ক’রে আমার পরিসীমাগুলি,
হঠাৎ সে হয় আমার শৈশবের ট্রেন,
কাকভোরে ছেয়ে থাকা ধোঁয়া,
তিক্ত, মধুর গ্রীষ্মকাল।
অন্যান্য ট্রেন হয়ে কারা ভাগছিল,
বগিগুলি বিষাদকণায় গিজগিজ,
কালো কালো পিচে বগি ঠেসে রাখা যেন,
এমনেই গতিহীন ট্রেনটা
এগোতে থাকল
সেই এক সকালে—যে সকাল ক্রমাগত
ব্যথা বাড়াচ্ছিল আমার হাড্ডিকে ঘিরে।
একলা ট্রেনে আমি ছিলাম একাকী,
সে একাকীত্ব আমার একলার নয়,
শত একাকীত্ব এসে মেলা করেছিল,
তাদেরও ইচ্ছা ছিল দূরযাত্রার,
প্ল্যাটফর্মে পড়ে থাকা গরীবগুলির প্রায়ই সাধ হয় যেমন।
প্রাণহীন ধোঁয়া হয়ে আমি ট্রেনে বসে
তাদের ধারণে বড় অক্ষম হই,
অসংখ্য মৃত্যুতে অভিভূত,
নিজেকে বেদিশা লাগে এই এক আনোখি যাত্রায়—
ক্লান্ত হৃদয় আমার চলমান এতে, বাদবাকি সবকিছু নিরেট নিশ্চল।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৪, ২০১৫