চাঁদবদনীর শরীর পড়ে থাকে বাঘের খাঁচায়। মন ছুটে যায় তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে।
বাবা ডাকতেন সূর্যমুখী, মা ডেকেছেন চাঁদবদনী। চাঁদের বদন। সে তো সূর্যকেই কাছে টানবে। সেদিকেই দৃষ্টি দেবে। যদিও সে প্রথা মাফিক সূর্যমুখী, তাকেই দিয়েছে মালা, তবুও তার দৃষ্টি সীমায় লুকিয়ে থাকে দূর আকাশের তারা। মায়ের ডাকা চাঁদবদনী একই সাথে সূর্যমুখী, দূর আকাশের তারার সখী।
ক’দিন ধরে সূর্য ছিল তেজারতে, দেশান্তরে। মাঝে সাঝেই সে ভিনদেশে যায়। সওদার বিকিকিনি করে। আজ লন্ডন, তো কাল দিল্লি কিংবা অন্য কোনও শহরে। এবারেও গেছে তেমন কোথাও। চাঁদবদনীর স্বাধীনতা প্রোষিতভর্তৃকার মতো। সূর্য বাড়ি ফেরে না ছয় দিন। আহা স্বাধীনতা! নেই মালা গাঁথা, দিবাকর বন্দনা। ঘড়ি ধরে বাড়ি ফেরা নেই। মাঝ রাতেই চাঁদ উঠতে হবে এমন কেন? চাঁদ উঠবে যখন তখন নিজের নিয়মে যখন ইচ্ছে হবে। এই ক’দিন চাঁদবদনীর তাই নিয়ম ভাঙার দিন। আমরা সবাই রাজা...।
দু’দিন লেগেছে বেশ। তারপর থেকে আর ভালো লাগেনি। আবারও পরাধীন হতে ইচ্ছে করেছে। সূর্যের অধীন। মন তো কেউ আর পরাধীন করতে পারে না। যখন খুশি যেখানে খুশি উড়ে যায়। শরীর পরাধীন হলেও মনকে কেউই বাঁধতে পারবে না। সে যখন তখন উড়ে যাবে দূর আকাশের তারার কাছে। কিন্তু স্বাধীন শরীরের চেয়ে পরাধীন শরীরেই পূর্ণতার আভাস। পরাধীন শরীরে তার সূর্য সার্বভৌম। সূর্যের হাত চষে বেড়ায় চাঁদবদনীর পাহাড়, উপত্যকার খাঁজ, বক্রতার ভাঁজ। যুবতীর নদীর জলে প্লাবন যখন সাঁতার-ক্লান্ত সূর্য তখন স্নানের শেষে ঘামে। সূর্যের কাছে হেরে যাওয়া এমন পরাধীন শরীরই তার প্রিয়। ছয় দিন পর সূর্য আবার দখল নিয়েছে চাঁদের। দুই দিন মেনে নেয়া যায়। তাই বলে ছয় দিন! কী এমন তেজারত তার এখানে সেখানে? সূর্যকে কতই না অভিশাপ দিয়েছে এই কয়দিনে। দেবে না ই বা কেন? তার তো ‘আমিও নাই দিদিও নাই...’। সূর্য গেছে তেজারতে। আর নক্ষত্র? সে তো পালিয়েছে কবেই দূর আকাশে। চাঁদের কলঙ্ক ছুঁয়ে দেখার কেউই যে নেই কাছে। সূর্য ফিরে না এলে কার কাছে যাবে আগুনমুখী মেয়ে?
প্রথম দু’দিন স্বাধীনতা ভালোই উপভোগ করেছে সে। রুটিনের বাধ্যতা নেই, সূর্যের আগুনে বহ্নিমুখের মতো ঝাঁপ দেয়ার তাড়া নেই। ইচ্ছে হলেই নক্ষত্রের সাথে গল্প করা যায় যখন তখন। দূর্যের শ্যেন দৃষ্টি থাকে না কোথাও। কিন্তু তাই বলে ছয় দিন! নক্ষত্র তো পালিয়েছে সাত সমুদ্রের ওপার। তেরো নয়, তেরোশ’ নদী আর হাজারো পাহাড়। এতো দূরের উত্তাপ বালিকার কাছে পৌঁছাতে পারে না। থেকে বছরে কয়েকটা দিন সে আলো দিয়ে চলে যায়। হায়! সেও তো কাছে নেই। শরীর কুঁকড়ে ওঠা বেদনা কমাবে কে? কে তার ঝরের কাঁপন নেবে ওষ্ঠে, গ্রীবায়? দূরের বাজনা লাভ কি শুনে/ মাঝখানে যে বেজায় ফাঁক...।
তারচেয়ে দিবাকর তার তীরের তীক্ষ্ণ ফলা নিয়ে আসুক। বিদ্ধ হতে চায় যুবতী। তার দিন কাটে না আর। কিশোরী মন আধেক পৃথিবী পার হয়ে যায়। যুবতী শরীর তার মুখিয়ে থাকে সৌরতার আঙ্গুলের খেলার, উত্থিত বন্যতার।
আহা, সূর্য আজ বাঘ হয়ে উঠবে নিশ্চয়। পরাধীনতাই পরম আরাধ্য হয়ে যায় চাঁদবদনীর। স্বাধীনতা চায় না বালিকা। সে আজ পরাধীন হতে চায়। বাঘ তাকে খুবলে খুবলে খাক।
ছয় দিনের অপেক্ষা শেষে মেয়ে আজ আবারও পরাধীনতাই চায়। পরাধীন শরীরে আজ রাতে সে ফিরে যাবে যৌবনের প্রথম রাতে। বাঘের রূপে সূর্য ফিরেছে ডেরায়। ভাবতেই চাঁদবদনী সিক্ত হয়ে উঠে। কিন্তু সেই সিক্ততায় সূর্যের না, নক্ষত্রের স্পর্শ পায়। তার জিভ, নাকের ডগা, অমল আঙুল। ধানমন্ডি কিংবা দক্ষিণ বাড্ডায় ফিরে যায় ভাবতে ভাবতে। অলফেকটরি হ্যালুসিনেশন জুড়ে আঁশটে ঘ্রাণের পারফিউম।
ধ্যান ভাঙে। সন্ধ্যা শেষে রাত পুরনো হয়। চাঁদবদনীর প্রস্তুতি পর্ব শেষ পর্যায়ে পৌঁছে যায়। মাঝে মাঝে তার নক্ষত্রের কথা মনে পড়ে। হয়তো তার রাত গভীর, ঘুমিয়ে পড়েছে অনিবার্য দীর্ঘশ্বাসে। সাত সমুদ্রের ওপারে, তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে দূর আকাশের কোথাও। সত্যিই মনে পড়ে কি? মায়া হয়! হয় কি? আহারে নক্ষত্র! তোর চাঁদকে আজ খুবলে খাবে পুরোনো সূর্য, নতুন দিনের শিব। তুই মর। তুই কচু খা। কী হবে নতুন ফুলশয্যার এই রাতে তোর জন্য এতো মায়া জমিয়ে রেখে! তুই আমার কেউ না, কেউ না।
চাঁদবদনীর শরীর খেলে বাঘের সাথে। সেও বাঘিনী হয়ে ওঠে। শীৎকারে গর্জনে বাঘের খাঁচা কাঁপে। ভেতরে পেট্রোল বোমার উত্তাপ। যুবতী গলনাঙ্কে নামে আগুনে ও জলে একাকার হয়ে। আজ তার শিবের পূজো। সূর্য হয়েছে শিব।
শরীর তার বাঘের খাঁচায়। ক্লান্তিতে আধো অচেতন। কিছুটা চেতন ফিরতেই মন ছুটে যায় তেপান্তরে মাঠ পেরিয়ে। দূর আকাশের তারা জন্য মায়া হয় একটু। আহা, বেচারা অঘোরে ঘুমুচ্ছে তখন। তার মন একবার বাইরে যায়। চাঙ্গির ট্রানজিটে কিংবা সুবর্ণভূমির লাউঞ্জে। কানকটিং ফ্লাইটে উঠি উঠি করে। আরেকবার ফিরে আসে বাঘের খাঁচায়। নক্ষত্রের জন্য মায়া হয় একটু। হয় কি? কোথাও তার স্পর্শ টের পায়? নাকের ডগায়, ঠোঁটের ভাঁজে, অনুপস্থিত অন্তর্বাসের আঙ্গিনায়? এইটুকু মায়া না থাকলে নক্ষত্র যে নিভে যাবে। চাঁদবদনীর যুবতী শরীর নিয়ে সূর্য খেলুক কখনও শিব হয়ে, কখনও বা বাঘ রূপে। নক্ষত্র শুধু তার কিশোরী মন নেবে আজ রাতে। শরীর যে তার নাগালের বাইরে, সূর্যের অধিকারে। অভিশাপ দিতে ইচ্ছে করে। চাঁদবদনী, আমার জন্য তোর মন কাঁদে কি? আজ তোর মন পুড়ে পুড়ে ছাই হবে হয়তো বা। তুই ভস্ম হবি।
মেয়ে ভাবে, শরীর না হয় তার পরাধীন আজ। মনটা স্বাধীনই থাক তবে। মৃতপ্রায় নক্ষত্রের জন্য চাঁদবদনীর মায়া হয় কি একটু? তার শরীর থাকে বাঘের খাঁচায়। মন ছুটে যায় তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে। সূর্যের উত্তাপ ক্ষয়ে গেলে পাশে শুয়ে বেঘোরে ঘুমায় শিব। চাঁদবদনীর পাহাড় জুড়ে সূর্য ডোবায় নাক, নাভিমূলে নক্ষত্র জাগে। ঘুমের মধ্যেই জেগে থাক দূর আকাশের তারা।
চাঁদবদনীর দেহের চিতায় সূর্য পোড়ে, মনের চিতায় দূর আকাশের তারা।
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০১৫