বমির দমক তার আর থামে না। কুটকুট আন্ধারে তখনও ঠাহর করা যায় না, রাত কোন প্রহরে এসে ঠেকল।
বিচ্ছেদের এই মৌসুমে গোটা পাড়া সুনশান। মানুষজন, কুকুর, বিলাই সব ভিটামাটি ছেড়ে লাপাত্তা। কার ডাকে আস্তাবদ্দিন আর রমিজা থেকে গেল, তা শোনার মানুষ তখন আর একটাও নাই। তখন রমিজার বমির দমক শুধু আস্তাবদ্দিন শোনে। বমির দমকে আস্তাবদ্দিন ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও আর কুপি খুঁজে পায় না। আসমানের তারা খোঁজে, কিন্তু সেটারও মরার দশা। বাইষ্যার আসমান আর কত আলো দেয়! রমিজার বমি আর আসমানের ডাক সমান সমান চলে।
আস্তাবদ্দিন খড়ের চালের বাঁশের বাতার ফোঁকরে গুঁজে-রাখা কমলার ছালের খোঁজে হাতড়াতে থাকলে, ঝুরঝুর হয়ে যাওয়া আরবি হরফের আমপারার ছেঁড়া ছেঁড়া পাতা পড়ে। আন্ধারে না বুঝে, নাকের কাছে এনে বাস্না নেওয়ার চেষ্টা করে সে। তার প্রাচীন নাক তাতে কমলার কোনও বাস্না না পেলে, সে আবার হাতড়াতে থাকে।
আস্তাবদ্দিন সেই কমলার ছাল খোঁজে। বিচ্ছেদ তখনও দানা বাঁধে নাই। পেয়ার-মহব্বত কি খোয়াব-স্বপন তখনও ছিল মিলনের। সেসব দিনে আস্তাবদ্দিন—যার কোনও বেটা নাই; বেটি নাই; বউ রমিজার জন্য গঞ্জে দুইখান কমলা কেনে। এই কমলা সে এমনি এমনি কেনে নাই। তারও একটা ঘটনা আছে।
বিয়ের প্রথম রাতে যখন আস্তাবদ্দিন কুপি নিভায় তখন নয়া বৌ রমিজা বলেছিল, আন্ধার বড়ো ডর রাগে।
আর আস্তাবদ্দিন, যার জীবনে কোনও নারী আসে নাই, সেই প্রথম নয়া বউয়ের হাত ধরে বলেছিল, ভালা লাগে কুনটা?
রমিজা চুপ করে থাকলে কিংবা আস্তাবদ্দিনের প্রশ্নের জবাব না দিতে পারলে, আস্তাবদ্দিন আবার তার হাতে চাপ দিয়ে বলে, কইলানা তো ভালা লাগে কুনটা?
রমিজার মুখে কোনও আও নাই দেখে আস্তাবদ্দিন নিজেই বলে, লাল না সাদা?
তখন রমিজা গ্রামের সদ্যযৌবনা কিশোরী কি-বা ভেবে বলেছিল, কমলা।
হয়ত কমলা তার কোনও ছেড়ে আসা খেলার সখীর নাম ছিল, যারা একসাথে কত বিকেল; কি সন্ধ্যা; কি চড়া দুপুর কাটিয়েছে মাথায় তেল দিয়ে, কি লেইস ফিতাঅলার সঙ্গে দরদাম করে, কি কোনও উঠতি তরুণ নিয়ে হিজিবিজি আলাপ করে। এই খবর আমাদের কাছে নাই। কারণ কমলা বলার পর, আর দ্বিতীয়বার রমিজা তার জীবনে কমলা বলে নাই। বললে বলা যায়, হয়ত-বা তার প্রিয় সখী কমলা চিরতরে চলে গেছে, আর আজ এই বিয়ের রাতে তার মনে সেসব দিনের কথা, যা তারা আলাপ করেছিল কোনও অলস দিনে, তার স্মৃতি উড়াল মারে। যাক, রমিজা যেহেতু নিজে থেকে কমলা নিয়ে আর কিছু বলে নাই ঐ তিনটি অক্ষর ছাড়া, তখন আমাদের কী দায় তা খোঁজার! আমরা কেবল বলতে পারি, ‘পৃথিবীতে কে কাহার?’
তখন আস্তাবদ্দিন বলেছিল, কমলা তো কষ্টে থাকে রে বউ, বনবাসে যায়।
রমিজা কিছু ভাবে নাই কিংবা ভেবেছিল, যা সে রাতে আর কোনও কথা না বাড়ায় মুখ ফুটে বের হয়নি। হয়ত বা চোখ ফেটে জল হয়েছিল। আস্তাবদ্দিন কুপি নেভায়, তাই সে খবরও আমাদের জানা হয়নি। আস্তাবদ্দিন সে রাতে নয়া বউরে কমলা খাওয়ানোর খায়েশ করে।
২.
সে রাতের পর অনেক দিন যায়, অনেক রাত যায়, কিন্তু আস্তাবদ্দিনের আর কমলার কথা মনে থাকে না। রমিজাও কমলার কথা ভুলে যায়। কিংবা রমিজা আর আস্তাবদ্দিন কেউ আর রাতে কুপি নেভানোর পর কোনও আলাপ করে না।
আজ এই আন্ধার রাতে যখন রমিজা বমি করতে করতে মরে যাওয়ার আলামত দিচ্ছে, তখনও আস্তাবদ্দিন কমলার ছাল হাতড়াচ্ছে। তখন ভাবতে হয়, যদিও সে কমলার ছাল পায় তাহলে তার বাস্না থাকবে কি-না। রমিজার বমির দমক আগের মতো আর নাই। হয়ত বা আছে, কিন্তু সেটা নিঙড়ানোর শক্তি আর নাই।
তখন এই বিচ্ছেদের মৌসুমে রমিজার বমির কারণ খুঁজতে হয়। তখন রমিজার বেগুন চারার হদিশ পাওয়া যায়। আরও জানা যায় যে, আস্তাবদ্দিনের বেগুন ভর্তার বড়ো সখ। ক্ষেত থেকে ধরে আনা চুচ্চুড়া মাছের সাথে বাড়ির বেগুন, রমিজার রান্না আর খাওয়ার পর আস্তাবদ্দিনের ভরপেট ঘুম।
তখন তার খেয়াল পড়বে—
ক্ষেতের চুচ্চুড়া মাছ বাড়ির বাইগুন
খায়া দায়া বুড়াবুড়ি ধরিল নাচুন।
এই শোলকটা সকাল বিকাল রমিজাকে আস্তাবদ্দিন শোনাত। যখন বলত তখনও তারা বুড়াবুড়ি হয়নি।
তো রমিজার মনে বেগুন লাগানোর গোপন ভালোবাসা এসে ভর করে, যখন আস্তাবদ্দিনের এই শোলক শুনতে থাকে।
রমিজা বেগুন চারা লাগায়। চারা বাড়তে থাকে তো বাড়তেই থাকে। তারপর একসময় চারা আর বাড়ে না। তখন রমিজার বেগুন গাছের কুঁকড়ে যাওয়া শুরু হয়। এভাবে প্রত্যেক বছর রমিজা বেগুন চারা লাগায়। চারা বাড়তে থাকে তো বাড়তেই থাকে। তারপর একসময় আবার বেগুন গাছের কুঁকড়ে যাওয়া শুরু হয়। রমিজা প্রত্যেক বছর বেগুন গাছের চারা লাগাতে থাকে, চারার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রমিজার বয়স বাড়তে থাকে। এভাবে চলতে চলতে রমিজার কালো চুলে পাক ধরে।
আস্তাবদ্দিনের নজর বেগুন চারার দিকে পড়ে। সে ভাবে, রমিজা বেগুন চারার খেদমত করতে করতে তার কালো চুল সাদা হয়ে গেছে। তখন সে বলে, বেগুন তার আর ভালো লাগে না। আস্তাবদ্দিনের মুখে একথা শুনে রমিজার আর নিন্দ্ ধরে না। জমাট আন্ধারে রাতের পর রাত জেগে থাকে। আস্তাবদ্দিন রমিজার কষ্ট বুঝতে পারে। বেগুন চারা আর যাতে কুঁকড়ে না যায়, সেই খোঁজে বের হয় আস্তাবদ্দিন। খুঁজতে খুঁজতে আস্তাবদ্দিন বছরের পর বছর পার করে দেয়। এক সময় হতাশ হয়ে পড়ে। তখন কে যেন তাকে বলে, ‘খোঁজ করিলে খোদার নাগাল পাওয়া যায়। ’ আস্তাবদ্দিন আবার খোঁজ করে রমিজার বেগুন চারা কুঁকড়ে যাওয়ার কারণ। রমিজা তখনও বেগুন চারা লাগাতে থাকে।
এমনই এক সময় বিচ্ছেদের মৌসুম আসে। তখন আস্তাবদ্দিনও বেগুনচারা কুঁকড়ে যাবার কারণ আর দাওয়াই পায়। দাওয়াই হাতে আস্তাবদ্দিন বাড়ি ফিরে। শিশিভরা দাওয়াই নিয়ে আস্তাবদ্দিন যখন ফিরে তখন সে দেখে রমিজার কালো চুল আর নাই। সে তার নিজের বয়স বুঝতে পারে। শিশিভরা দাওয়াই সে মাটির দেওয়ালের টাকে রাখে। আর ধীরে ধীরে রমিজাকে তার মাজেজা বলে।
সেই মৌসুমে আবার সে হাটে যায়। তারপর সে যখন ফেরে তখন অনেক রাত। আন্ধারিয়া সে রাতে রমিজার কাশির দমক ওঠে। রমিজা যখন কাশতে কাশতে আর দম নিতে পারছিল না, তখন তার দাওয়াইয়ের মাজেজা মাথায় আসে।
রমিজার মাথায় যখন দাওয়াইয়ের কথা ঘুরে, তখন আস্তাবদ্দিন শানবান্ধা দিঘির ঘাটে হাঁটু পানিতে নেমে দীর্ঘদিন দাওয়াই খুঁজতে গিয়ে পায়ে জমে থাকা ধুলা কচলায়। আস্তাবদ্দিনের এই পা কচলানো যখন চলতে থাকে, তখন জলের ঝিঁঝিঁরা তার আগে পিছে পাক দিয়ে রমিজার খবর জানাতে সমস্বরে গীত ধরে—
তোমার বউ বিষ খায়
তোমার বউয়ের জীবন যায়
নিজ হাতে আনছো বিষ
সেই দিকে নাই তোমার দিশ
শিগ্গির তুমি বাড়িত যাও
তোমার বউয়ের জান বাঁচাও
নিজ হাতে আনছো বিষ
সেই দিকে নাই তোমার দিশ...
ঝিঁঝিঁরা আস্তাবদ্দিনের চারপাশে ঘুরে ঘুরে এই খবর বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। আস্তাবদ্দিন তখনও হাঁটু পানিতে নেমে পা কচলাতে থাকে।
ক্লান্ত ঝিঁঝিঁর স্বর যখন নিচে নেমে আসে, তখন জোনাকিরা হাজির হয়। জোনাকিরা আস্তাবদ্দিনের মাথার চারপাশে ঘুরে ঘুরে গীত ধরে—
জীবের জন্য আনছো দাওয়া
ভালোবাসার ছিল চাওয়া
তুমি কি বোঝো না
রমিজা আর বাঁচে না
প্রেম-পিরিতির এই জীবন
এক নিমিষে হয় পতন
জীবের জন্য আনছো দাওয়া
ভালোবাসার ছিল চাওয়া...
জোনাকিরা যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখনও আস্তাবদ্দিন তার পা কচলাতে থাকে। জোনাকির ক্লান্তি দেখে, পেঁচা প্রাচীন বৃক্ষের ফোকর থেকে বের হয়ে আসে। এবার পেঁচাও রমিজাকে বাঁচানোর জন্য গীত ধরে—
যাও ক্যানে হে বাড়িত তোমরা
আর না করি দেরি
বউখান তোমার পড়ি আছে
যাইবে বুঝি মরি
তোমরা যাও ক্যানে হে বাড়ি।
এই সুরে বলার পরও যখন আস্তাবদ্দিন পানি থেকে ওঠে না, তখন পেঁচা তার সুর বদল করে।
তোমাক ভালোবাসি বউখান বেগুনও লাগাইল
সেই চারাতে পানি দিয়া যৌবনও কাটাইল
তবুও তার বেগুন চারায় ফুল না ফুটিল
সেই দুঃখেতে কালো কেশে পাকও ধরিল
তবুও সে ভালোবাসার নিশান না ছাড়িল।
আর তোমরা কি-না দিঘির ঘাটোত আছেন গো খাড়াইয়া
আর তোমার বউয়ের জান আজরাইল নেয় টানিয়া
এখনও সময় আছে ধরো বাড়ির ঘাটা ধরো হে...
পেঁচা যখন সুর বদল করে, তখন জলের মাছরা এসে সুরের তালে তালে আস্তাবদ্দিনের পায়ে জমে থাকা ধুলা পরিষ্কার করে।
এবার আস্তাবদ্দিন বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়। ততক্ষণে রমিজার বমির দমক তুঙ্গে। আর মেঘের গজরানিতে কুপিও নিভে গেছে। আস্তাবদ্দিন আগুনের খোঁজ করে, কিন্তু আগুনের নাগাল সে পায় না। তখন তার মনে পড়ে কমলার কথা। সে রমিজার বমি থামাতে কমলার ছাল খোঁজে। যে কমলার কাহিনী শুরু হয় বাসর রাতে, আজ আবার সেই কমলার খোঁজে তার হাত চলে। রমিজা নিস্তেজ হয়ে পড়লে আস্তাবদ্দিনের মনে পড়ে জন্ম-মৃত্যু-বিয়া এই তিনে কারও হাত নাই। তখন সে আবার মনে করে—রমিজা জানত নাকি যে, কোনও এক রাতে তার বমির দমক উঠবে আর সে-রাতে আস্তাবদ্দিন কমলার ছাল খুঁজবে, তাই সে বাসর রাতে কমলার কথা বলেছিল।
আস্তাবদ্দিনের আরও মনে পড়ে সে বলেছিল, কমলা বনবাসে যায়। তখন আস্তাবদ্দিনের হাতে বেগুন চারার দাওয়াইয়ের শিশি ঠেকে। শিশিটা খালি দেখে তার কলিজা ছ্যাত করে ওঠে, আর তাতে তার বুকের ডিবডিবানি বলে, তাইলে কি রমিজা এই দাওয়াই খায়েছে। দেওয়ালের টিকটিকিরা টিকটিক করে উঠলে, আস্তাবদ্দিন মুখে হাত দিয়ে রমিজার দিকে ফিরে। তার চোখ রক্তজবার মতো হয়ে ওঠে। তখন আন্ধার আরও নিকষ হয়, যেমন হয় রমিজার মুখ। তখন মূলত বিচ্ছেদের মৌসুম চলছিল দেশে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০১৫